× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

চিত্রকল্পের জীবনানন্দ

তুহিন ওয়াদুদ

প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৫৮ পিএম

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৩৪ পিএম

চিত্রকল্পের জীবনানন্দ
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) বাংলার প্রকৃতিকে এক অপরূপ মুগ্ধতা নিয়ে অবলোকন করেছেন। কাব্যে রূপ দিয়েছেন আরও নিপুণ বিন্যাসে। তাঁর দৃষ্টিলব্ধ প্রকৃতি ভাব আর ভাষায় ভর করে কাব্যশিল্পে এক অভিনব জগৎ সৃষ্টি করেছে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে কোনো কোনো ঋতুর প্রতি তাঁর ছিল অধিক মুগ্ধতা। তেমনি এক ঋতু হচ্ছে হেমন্ত। বাংলার সাধারণ মানুষ ঋতু পরিক্রমায় হেমন্তকে আলাদা করে খুব বেশি মনে রাখে না। জীবনানন্দ দাশের মতো আর কোনো কবিকে হেমন্ত ঋতু নিয়ে এত বেশি কবিতা রচনা করতে দেখি না। এক কথায়, হেমন্ত ঋতুকে নিয়ে বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি কবিতা রচনা করেছেন জীবনানন্দ দাশ।

বাংলার প্রকৃতির রঙ-রূপ-রসের এক অপরূপ সমন্বয় ঘটেছে তাঁর কবিতায়। জীবনানন্দ দাশ নিজের কবিতা সম্পর্কে বলেছেন‘আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা ইতিহাস ও সমাজ-চেতনার, অন্য মতে নিশ্চেতনার; কারও মীমাংসা এ কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার; সুররিয়ালিস্ট। আরও নানা রকম আখ্যা চোখে পড়েছে। প্রায় সবই আংশিক সত্যকোন কোন কবিতা বা কাব্যের কোন কোন অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়।’ (জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা এর মুখবন্ধ)

জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু হয়েছে হেমন্ত ঋতুতে। পথ চলতে ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন এবং কদিন পরই মৃত্যুর কালো চিরনিদ্রায় শায়িত হন। তাঁর সবচেয়ে পছন্দের ঋতুতে তাঁর মৃত্যুটা কাকতাল অথবা আনমনে ঋতুভাবনায় তাঁর দুর্ঘটনা ঘটে। তাঁর কবিতায় তিনি কতখানি হেমন্ত প্রভাবিত ছিলেন সেই অনুসন্ধানই এ রচনার সাধারণ উদ্দেশ্য। তাঁর ঝরা পালক (১৩৩৪), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৩৪৩), বনলতা সেন (১৩৪৯), মহাপৃথিবী (১৩৫১), সাতটি তারার তিমির (১৩৫৫), বেলা অবেলা কালবেলা (১৩৬৮) প্রভৃতি কাব্যে বাংলার রূপবৈচিত্র্য শিল্পিত রূপে বিন্যস্ত। 

অধিক মাত্রায় হেমন্ত প্রভাবিত কবিতাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি, দক্ষিণা, সেদিন এ ধরণীর, তার নির্জন স্বাক্ষর, মাঠের গল্প, অনেক আকাশ, পরস্পর, অবসরের গান, জীবন, প্রেম, পিপাসার গান, মৃত্যুর আগে, কুড়ি বছর পরে, শঙ্খমালা, বেড়াল, দুজন, অঘ্রান প্রান্তরে, আবহমান, নিরালোক, সিন্ধুসারস, আট বছর আগের একদিন, মনোবীজ, প্রেম অপ্রেমের কবিতা, ঘোড়া, গোধূলিসন্ধির নৃত্য, হাঁস, চক্ষুস্থির, স্বভাব, সোনালি সিংহের গল্প, তিমির হননের গান, নাবিকী, সময়ের কাছে, জনান্তিকে এবং রূপসী বাংলা কাব্যের ১৬, ১৭, ২২, ৩০, ৩৮, ৪১, ৪৬, ৫২ সংখ্যক কবিতা।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বিরহকাতর কবিচিত্তের ভারাক্রান্ত হৃদয়ের ছবি অঙ্কিত হয়েছে। কবি তাঁর প্রিয়জনকে প্রকৃতির বিভিন্ন রূপের মধ্যে সন্ধান করতে গিয়ে বলেছেন‘হেমন্তের হিম মাঠে, আকাশের আবছায়া ফুঁড়ে/বকবধূটির মতো কুয়াশায় শাদা ডানা যায় তার উড়ে!’ সেদিন এ ধরণীর কবিতায় শোকের মধ্যে ডুবে ধরণীর সঙ্গে নিজের বিচ্ছেদ রচিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে কবি যেন জগন্মাতার স্থবির কান্না শুনতে পান। জগন্মাতা তাঁকে বিচ্ছেদের পথ থেকে বিরত থাকার কথা বলেন এবং তাঁকে কাছে ডাকেন‘ডেকেছিল ভিজে ঘাসহেমন্তের হিম মাস, জোনাকির ঝাড়,/আমাকে ডাকিয়াছিল আলেয়ার লাল মাঠ, শ্মশানের খেয়াঘাট আসি।’ নির্জন স্বাক্ষর কবিতার সঙ্গে কবির বাস্তবজীবনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই কবিতায় কবি হেমন্তের পাতা ঝরার মতো জীবন থেকে ঝরে পড়ার কথা বলেছেন।

প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর কবি নিজেকে হেমন্তের পাতা ঝরার মতো করে ঝরে গেলে কী হতে পারে, সেই কথা বলেছেন। বাস্তবে কবি সত্যি সত্যি হেমন্তে জীবন থেকে ঝরে গেছেন। কবিতায় তিনি বলেছেন‘হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন/পথের পাতার মতোন তুমিও তখন/আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন/সেদিন তোমার।’ মাঠের গল্প কবিতার পেঁচা অংশে হেমন্ত ঋতুর নিখাদ বর্ণনা উঠে এসছে‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে/শুধু শিশিরের জল;/অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে।’ কবি এখানে বেদনার নীলকণ্ঠের আভায় আভাসিত হলেও হেমন্তের রূপ বর্ণনাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তিনি এ কবিতায় হেমন্তের একাধিক চিত্রকল্প তৈরি করেছেন শব্দের ব্যঞ্জনায়। হেমন্তকালে ফসল কাটার মৌসুম, শীতের রেখা ফুটে ওঠে এ কালে, গাছের পাতা ঝরে পড়ার পূর্বে হলুদ রঙ ধারণ করে, এ সময় হালকা কুয়াশা ছিন্ন করে চাঁদের আলো পৃথিবীতে এলে যে মেঘবরণ আলো তৈরি হয়, শান্ত নদী, ফসল কাটার পর পড়ে থাকে খড় নাড়াসবকিছুই এ কবিতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। অবসরের গান কবিতার মধ্যেও হেমন্ত ঋতুর বিচিত্র সৌন্দর্যকে কবি তুলে এনেছেন। কবির ভাষায়‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে।’ হেমন্তে রোদের রঙ কবির কাছে শিশুর লাল গালের মতো নরম মনে হয়, ধানের স্তন থেকে যেন শিশির ঝরে, শস্যের গন্ধে ভরে থাকে পৃথিবী। এসব কিছুর সৌন্দর্য যেন শীত এসে শেষ করে দেয়। পিপাসার গান কবিতায় কবি পৃথিবীর প্রতি অশেষ ভালো লাগার কথা ব্যক্ত করেছেন। পৃথিবী ছেড়ে প্রয়াণ পরবর্তী সময়ে তিনি আর পৃথিবীর বুকে ফিরবেন কি না, এই জিজ্ঞাসা থেকে তিনি করুণ আর্তিসহ নানান বেদনার রঙ এঁকেছেন এ কবিতায়। তিনি আর ফিরতে না পারলে যে কারণে তাঁর খারাপ লাগবে তার মধ্যে‘হেমন্ত বৈকালে/উড়ো পাখপাখালীর/ উঠানের; পেতে থাকে কান/শোনো ঝরা শিশিরের গান/অঘ্রানের মাঝরাতে;’। হেমন্তের রোদের মতো, ফসলের স্তন কিংবা কার্তিকের ভোরের রূপের কথা ব্যক্ত হয়েছে। কবি গত হলে পরে যে শূন্যতার মধ্যে পতিত হবেন, যে শূন্যতা পিপাসার জন্ম দেবে, সেই কথা বলতে গিয়ে তিনি হেমন্ত ঋতুকে একই কবিতার বহুসংখ্যক চরণে স্মরণ করেছেন। কুড়ি বছর পরে কবিতায় কবি তাঁর গত হওয়া জীবনের পরিবর্তে পার্থিব জগতেই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলে কুড়ি বছর পরের সময় সম্পর্কে কল্পনার জগৎ নির্মাণ করেছেন। 

কুড়ি বছর পরের সেই সময়ের কথা বলতে গিয়েও তিনি হেমন্তকে ভোলেননি। মৃত্যুর পর এবং বেঁচে থাকা জীবনে বর্তমান কালে এবং ভবিষ্যৎ কালের ভাবনায় সর্বত্রই তিনি হেমন্তকে তাঁর চৈতন্যে ঠাঁই দিয়েছেন। কুড়ি বছর পরে কবিতায়‘আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!/আবার বছর কুড়ি পরে/হয়তো ধানের ছড়ার পাশে/কার্তিকের মাসে।’ শঙ্খমালা কবিতায় দেখি কবিকে এক নারী সন্ধান করছে এবং তাঁকে যখন পেয়েছে সে কবিকে কীভাবে খুঁজেছে সেই কথা বলতে গিয়ে হেমন্ত উপেক্ষিত হয়নি। এখানেও হেমন্ত ঋতুর ব্যঞ্জনাময় উপস্থিতি। কবিতার ভাষায়‘খুঁজেছি নক্ষত্রে আমিকুয়াশার পাখনায়/সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক/জোনাকির দেহ হতেতোমারে খুঁজেছি সেইখানে/ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রানের অন্ধকারে/ধানসিঁড়ি বেয়ে বেয়ে।’ অঘ্রান প্রান্তরে কবিতায় কবিচিত্তের করুণ সুর বেজে উঠেছে। প্রিয়তমার সঙ্গে বিচ্ছেদকে কবি হেমন্ত ঋতুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। হেমন্ত ঋতুতে পাতা ঝরে গিয়ে যে বিবর্ণ প্রকৃতির জন্ম নেয়, সেই ঋতু আসার পূর্বেই কবির ব্যক্তিগত জীবনে সেই বিবর্ণ প্রকৃতি নেমে এসেছে। অঘ্রান প্রান্তরে নাম শব্দটির আড়ালে কবির সে চেতনারই অনুরণন বেজে ওঠে। আট বছর আগের একদিন কবিতায় এক আত্মহননকারীকে নিয়ে কবিতার যে চরণ বিন্যাস সেখানে হেমন্তের বিকালকে মহান করে তুলে ধরা হয়েছে। আত্মহননের কারণ যাই হোক না কেন কবির বিস্ময় হচ্ছে যে‘জীবনের এই স্বাদসুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের/তোমার অসহ্য বোধ হ’ল;’।
হেমন্ত ঋতুর ত্রিমাত্রিক রূপ প্রকৃতির মধ্যে বিশেষত্ব দান করে। এক. বেদনার পথ নির্মাণ করা। কারণ হেমন্ত ঋতুতেই সবুজ গাছের পাতা হলুদ হয় ঝরে পড়ার জন্য। দুই. হেমন্ত ঋতু বাঙালির জীবনের ইতিবাচক অর্থে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ নবান্নের দেশে নবান্নের ঋতুও হচ্ছে হেমন্ত। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির মধ্যে বাঙালির দারিদ্র্য মোচন, স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা সবকিছুই লুকিয়ে থাকে নতুন ধানের সঙ্গে। তৃতীয় বিশেষত্বটি হচ্ছে, শরৎ ঋতুর পরে এবং শীতের পূর্বে পৃথিবীর যে পরিবর্তিত রূপ সৌন্দর্য, তা একেবারেই ভিন্ন। হেমন্ত ঋতুর ত্রিমাত্রিক চরিত্রের মধ্যে বিকশিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের কবি ভাবনা।
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা