× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শ্রদ্ধা

প্রবা প্রতিবেদন

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:১৬ পিএম

আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:০৮ পিএম

শ্রদ্ধা

এস এম সুলতান

নড়াইলের মাছিমদিয়ার এক অতিদরিদ্র পরিবারে জন্ম এস এম সুলতানের। তার বাবা তখনকার জমিদারবাড়িতে যেসব নতুন দালান উঠত তার নকশা তৈরি করতেন। জন্মসূত্রে বাবার এই অঙ্কনপ্রতিভা সুলতান লাভ করেছিলেন। তবে পিতামাতার সামাজিক অবস্থানের ফলে এক বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশে তাঁর শৈশব কেটেছে। কিন্তু তাতে যেন শাপে বর হলো। তাঁর মতো যারা বৃহত্তর সমাজে ঘৃণিত, অস্পৃশ্য হিসেবে লাঞ্ছিত, সেই নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যেই খুঁজে নিলেন আপনজনদের। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার আর্থিক সঙ্গতি তাঁর ছিল না। তবুও বেশ কটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তাঁকে ঠিক টানত না। বাউন্ডুলেপনার মাঝেই একদিন চলে গেলেন দেশের বাইরে। সেখানে নিজস্ব ঢঙে এবং উপকরণে নির্মাণ করলেন নিজের শিল্পজগৎ। পাশ্চাত্যে এস এম সুলতান যে যশ কুড়িয়েছিলেন তা দিয়েই থিতু হতে পারতেন। দেশ-বিদেশের খ্যাতি তাঁকে গ্রাম থেকে দূরে রাখতে পারেনি। তাঁর চিত্রকলার বিষয়বস্তু ছিল আলাদা। তিনি শহর আঁকতেন না। তথাকথিত আধুনিক চিত্রকলার অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের ধরন তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি সেভাবেই ছবি এঁকেছেন যা সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। তিনি আঁকতেন মানুষ, কৃষক, নারী, শিশু, গাছপালা, গ্রামের দৃশ্যএসব। তাঁর ছবি দেখলেই বোঝা যায় প্রকৃতির প্রতি তাঁর সমর্পণ কেমন ছিল।

বড় এক শিল্পীর নামযশ নিয়ে এস এম সুলতান অবশেষে এলেন  পাকিস্তানে। ততদিনে আমেরিকার শিল্পী সম্মেলন থেকে শুরু করে নানা ইউরোপীয় দেশে তাঁর প্রদর্শনী শেষ। কিন্তু পাকিস্তানে এসে তাঁর ভালো লাগল না। চলে গেলেন উড়িষ্যায়। সেখানে তাঁর ভালো লাগার মতো অনেক কিছুই ছিল। শুরু হলো তাঁর যাযাবর জীবন। বাড়ি নেই, ঘর নেই, চালচুলোর ঠিক নেই। অথচ এমন সুদর্শন যুবকের ঢেউ খেলানো চুল আর হাতে থাকা বাঁশের বাঁশি নিয়ে যেখানেই যান, মানুষকে আপন করে নেন। এই যাযাবর সময়ে অনেকটা দরবেশের বেশভূষা নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন নানা স্থানে। বিভিন্ন বাড়ির শিশুরা এসে এই অদ্ভুত লোকটিকে ডেকে নিয়ে যেত। তারা জানত, লোকটিকে বললেই এঁকে দেবে সুন্দর কিছু না কিছু। শিশুদের আবদার রাখতেই ময়লা বা ছেঁড়া কাগজে এঁকেছেন অসংখ্য ছবি। 

সুলতান সাধারণ কোনো মানুষ ছিলেন না। তিনি চাইলে বিলাসী জীবনযাপন করতে পারতেন। নিজের খ্যাতি ও সমাদরকে পুঁজি করে সবার মধ্যমণি হয়ে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি সবকিছু ছেড়ে গ্রহণ করেছেন সংগ্রামের পথ, কষ্টের পথ। 

নভেরা আহমেদ
নভেরা আহমেদ (১৯৩৯-২০১৫) একজন খ্যাতনামা ভাস্কর। তাঁকে বলা হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথম বাংলাদেশি আধুনিক ভাস্কর। নভেরার পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের আসকারদিঘির উত্তর পাড়ে। বাবার চাকরিসূত্রে কলকাতায় কেটেছে তাঁর শৈশব। লেখাপড়া ও শিল্পের সঙ্গে পরিচয় হয় সেখানেই। ভারত ভাগের পর তাঁর পরিবার চলে আসে বাংলাদেশে। 

১৯৫০ সালে আইন শিক্ষার জন্য তাঁকে লন্ডনে পাঠানো হয়। কিন্তু শিল্পী হবার শৈশবের মনোবাসনা থেকে তিনি সিটি অ্যান্ড গিল্ডস্টোন কার্ভিং ক্লাসে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ভর্তি হন ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইনের মডেলিং ও স্কাল্পচার কোর্সে। সেখান পাঁচ বছর মেয়াদের ডিপ্লোমা কোর্স করার পর ১৯৫৫ সালে তিনি ইতালির ফ্লোরেন্স ও ভেনিসে ভাস্কর্য বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন।

ভাস্কর হিসেবে নভেরা আহমেদের মূল প্রবণতা ফিগারেটিভ এক্সপ্রেশন। তাঁর কাজের প্রধান বিষয়বস্তু নারী প্রতিমূর্তি। তবে নারী প্রতিমূর্তি নির্মাণে তিনি বিমূর্ততার দিকে ঝুঁকেছেন। নভেরা তাঁর শিল্পকর্মে একঘেয়েমি কাটাতে পরবর্তী সময়ে ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছিলেন। নভেরার বেশকিছু ভাস্কর্যে আবহমান বাংলার লোকজ আঙ্গিকের আভাস পাওয়া যায়। লোকজ ফর্মের সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ও ঘটেছিল। বাংলার আবহমান টেপা পুতুলের ফর্মকে সরলীকৃত করে তাকে দক্ষতার সঙ্গে বিশেষায়িত করেছেন তিনি।

নভেরার প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল ১৯৬০ সালের ৭ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে। নভেরার দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে ব্যাংককে। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে জুলাইয়ে তাঁর তৃতীয় একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল প্যারিসের রিভগেস গ্যালারিতে। সর্বশেষ ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে তাঁর পূর্বাপর কাজের একশ দিনব্যাপী একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়।

তাঁর উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে পরিবার, যুগল, ইকারুস, জেব্রাক্রসিং, লুনাটিক টোটেম, মেডিটেশন ইত্যাদি। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।

নভেরা জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন ফরাসি দেশে। সেখানকার জীবন আমাদের কাছে অজানা থেকে গেছে। ফলে মৃত্যুর পরও নভেরার প্রতি তাঁর ভক্তদের আগ্রহের কমতি নেই।


জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী (১৫ নভেম্বর ১৯৪৩-২৮ এপ্রিল ২০২০) ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক, খ্যাতনামা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর বর্ণাঢ্য, কর্মময় জীবন এ দেশকে নানাভাবে করেছে আলোকিত। স্বাধীনতার পর এ দেশে যত বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই জামিলুর রেজা চৌধুরী কোনো-না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন। যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মাসেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা সাবওয়ে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলেও ছিলেন তিনি।

স্নাতক শেষ করার পরপরই প্রভাষক হিসেবে বুয়েটে যোগ দেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। এরপর যুক্তরাজ্য থেকে স্নাতকোত্তর শেষে আবার তিনি বুয়েটে ফিরে আসেন। ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক হন। দীর্ঘদিন তিনি বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। একই সময়ে ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এই ১০ বছর তিনি বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি) পরিচালক ছিলেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ছিলেন। ২০১০ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়। 

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর ৭০টির বেশি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পিএইচডি গবেষণার সময় তিনি বহুতল ভবনের ‘শিয়ার ওয়াল’ বিশ্লেষণের একটি সহজ পদ্ধতি বের করেছিলেন, যা পরে কোল অ্যান্ড চৌধুরীস মেথড হিসেবে পরিচিতি পায়। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগে এটি পাঠ্য। বহুতল ভবন, কম খরচে ভবন নির্মাণ, ভূমিকম্পরোধী ভবনের নকশা, ঘূর্ণিঝড়রোধী বাড়ি নির্মাণসহ নানা বিষয়ে তাঁর গবেষণা আছে।আছে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট স্বর্ণপদক, আছে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে পাওয়া সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি। 

সেলিম আল দীন
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার জনপদে সংস্কৃত কিংবা ইউরোপীয় নাট্যরীতিতে প্রভাবিত নাট্যচর্চার বিস্তৃতি ঘটেছিল। ‘বিজাতি’ ও ‘পরজীবী’ হিসেবে চিহ্নিত এই নাট্যচর্চার বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শম্ভু মিত্র প্রমুখের মাধ্যমে বাংলা নাট্য-আঙ্গিক বিকশিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় সেলিম আল দীন দেশজ নাট্য-আঙ্গিকের নানা শৈলীকে নতুন রূপে সৃষ্টি করেন। ফলে ক্রমান্বয়ে বাংলা নাটকের অত্যাবশ্যক রূপ হিসেবে নির্ণীত হওয়া ইউরোপীয় সংলাপাত্মক নাটকের গড়ন-বৈশিষ্ট্য ভেঙে যায়। আর বাঙালির জীবনে প্রাচীনকাল থেকে পরিবাহিত হয়ে চলা কথা-নৃত্য-গীতের অপ্রয়াস যাতায়াতের মধ্য দিয়েই বিকশিত হয় বাংলা নাটক। সেলিম আল দীনের নাটকের পূর্বে এরূপ কোনো নাট্যকারের রচনায় দেশজ নাট্যরীতির প্রয়োগ-সম্ভাবনা দেখা যায়নি। নাটক রচনায় সেলিম আল দীন ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের রচনারীতি ও পরিবেশনা-শৈলীর এক নব্যরূপ নির্মাণ করেন। তিনিই দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব, ফিউশন তত্ত্বের প্রবক্তা এবং নিউ এথনিক থিয়েটারের উদ্ভাবনকারী। তাঁর নাটকে ঔপনিবেশিক নাট্য-শৃঙ্খলার বিপরীতে দেশজ-নাট্যরীতির মাধ্যমে উন্মোচিত হয় আধুনিক বাংলা নাটকের নবধারা। তিনি প্রমাণ করেন যে, শুধু বাংলা ভাষায় লিখলেই বাংলা নাটক হয় না; বরং বাঙালির সংস্কৃতিজাত নাট্য-নন্দন ভাবনা কাঠামোর স্বতন্ত্র ও স্বকীয় ব্যবহারেই বাংলা নাটকের গড়ন-গঠন বিকশিত হওয়া প্রয়োজন।

সেলিম আল দীন অত্যন্ত সফলভাবে আধুনিক বাংলা নাটকের বিকাশ-পরিক্রমায় ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যধারার উপাদানগুলোর মধ্যে কথা-নৃত্য-গীতের বহুমাত্রিক ব্যবহার করেছেন। তাঁর নাটকের বর্ণনা, সংলাপ প্রভৃতির মধ্যেও ঐতিহ্যবাহী নাট্যের ‘গীতলতা’, ‘গীতময়তা’ ও ‘কাব্যময়তা’র অপরিহার্য সংযোগ দেখা যায়। সেজন্য তিনি যেমন ঐতিহ্যিক বাংলা নাটকের বিনির্মাণে স্বতন্ত্র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তেমনি বাঙালির দ্বৈতাদ্বৈত শিল্পরীতির বিস্তৃত ভূমিকেও নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেন। নাটকের বিষয়-প্রেক্ষাপট নির্বাচনে তিনি যেমন নতুনত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি নাট্যঘটনা উপস্থাপনেও অভিনব রীতি-পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। তাঁর নাটক বাংলার গ্রামীণ জনপদের মানুষ, তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের আবহমান চিত্র।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা