× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আবেদ ভাইয়ের দায়বদ্ধতা ও প্রাসঙ্গিকতা

হোসেন জিল্লুর রহমান

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:৪৮ পিএম

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৩৮ পিএম

আবেদ ভাইয়ের দায়বদ্ধতা ও প্রাসঙ্গিকতা

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ফজলে হাসান আবেদের অবদানের স্বীকৃতি প্রকারান্তরে সামাজিক ও বেসরকারি খাতের অবদানের স্বীকৃতি। গত পঞ্চাশ বছরে এই ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আগামীর অর্জন ও আকাঙ্ক্ষা নিশ্চিত করতেও সামাজিক ও বেসরকারি খাতের কার্যকর ভূমিকা রাখার সহায়ক পরিবেশ অব্যাহত রাখা সমপরিমাণ জরুরি। সামাজিক ও বেসরকারি উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পরিপূরক। যখনই এই সমগ্র সমাজ তথা ‘হোল- সোসাইটি’ অ্যাপ্রোচ কার্যকর হয়েছে তখনই সুষম উন্নয়ন বেগবান হয়েছে। তাঁর অর্ধশতাব্দীর নিরলস সাধনা এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করেছে

প্রচলিত যেকোনো মানদণ্ডেই ফজলে হাসান আবেদ সফল ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হবেন। দুবছর আগে এই দিনে তিনি যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, তাঁর বহুমুখী অর্জনের জন্য তখন তিনি দেশে-বিদেশে, তৃণমূল থেকে উপরি-কাঠামোতে সর্বত্র স্বীকৃতি, প্রশংসা ও শ্রদ্ধার জোয়ারে ভেসেছিলেন। সত্যিকার অর্থে এটি তাঁর প্রাপ্য ছিল। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আবেদ ভাইয়ের বহুমাত্রিক অর্জনের সুদীর্ঘ তালিকা এতই সুপরিচিত যে তা পুনর্ব্যক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যেই স্বীকৃতি আরও বেশি নজর কাড়ার মতো ছিল ব্র্যাকের আনুষ্ঠানিক পরিমণ্ডলের বাইরে, তা ছিল সাধারণ মানুষের পর্যায়ে।

আমি পরিচিত-অপরিচিত অনেক তৃণমূলের মানুষকে এভাবে বলতে শুনেছি- ‘একজন ভালো মানুষ চলে গেলেন যে সব সময় সাধারণ মানুষের ভালো করার কাজে মনোযোগী ছিলেন।’ সবকিছুর ঊর্ধ্বে আবেদ ভাইয়ের এই ‘নিয়ত’-এর জায়গাটিই অধিক প্রণিধানযোগ্য। ‘নিয়ত’ ধারণাটির প্রচলন উন্নয়ন আলোচনায় তেমন নেই। ধারণাটি উন্নয়নের টেকনোক্রেটিক চিন্তাধারার সঙ্গে যায় না। বরং যেই প্রতিপাদ্যগুলোকে ‘নিয়ত’ আলোকপাত করে তা হলো-বিশ্বাসযোগ্যতা, মনোবাসনা, ব্রত। আবেদ ভাইয়ের লিগ্যাসিকে তাই আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। নিশ্চয়ই সফল প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সফল উন্নয়নকৌশল উদ্ভাবন আবেদ ভাইয়ের অন্যতম অর্জন। কিন্তু যে আদি কথাটি আরও অধিকতর স্মরণযোগ্য তা হচ্ছে এই ‘নিয়ত’-এর কথাটিই, যার শুরু ৭০-এর জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড ভোলার আক্রান্ত জনপদে। পরবর্তী পাঁচ দশকের নিরলস সাধনাই ছিল ভাগ্যবিড়ম্বিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনে এই ব্রতকে কার্যকরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাই আবেদ ভাইয়ের দ্বিতীয় প্রয়াণ দিনে তাঁর অর্জনের কথায় সীমাবদ্ধ না রেখে তাঁর সাধনার ওপর নজর দেওয়াও জরুরি।

এই উপলব্ধি আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারিতায় আরও উজ্জ্বল হয়ে আছে যখন ২০১৯-এর মাঝামাঝি আবেদ ভাই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ডায়াগনসিস পেলেন। সার্জারির মাধ্যমে জীবন কিছুটা প্রলম্বিত করার একটি সম্ভাবনা থাকলেও অসম্ভব দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে আবেদ ভাই তাঁর শেষ অধ্যায় রচনা করলেন। ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের এই নিদারুণ মুহূর্তেও আবেদ ভাই প্রাধান্য দিলেন তাঁর ব্রতকে, নিজেকে নয়। শুধু প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার বিষয়টি নয়, প্রাধান্য দিলেন প্রতিষ্ঠানের ‘সেন্স অব মিশন’কে প্রজ্বলিত করতে। বাংলাদেশে, বিশ্বে।

প্রতিষ্ঠান গড়াই বাংলাদেশে সবচেয়ে কঠিন কাজ। কার্যকর প্রতিষ্ঠান, বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান, নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। এ কাজটিই আবেদ ভাই করে গেছেন। তাঁর ছিল ‘হ্যান্ডস অন অ্যাপ্রোচ’। সব কর্মকাণ্ডের ওপর সার্বিক নজর রাখতেন। কিন্তু এই নজর প্রতিষ্ঠানের বিকাশের প্রয়োজনে নিছক খবরদারির জন্য নয়। সাশ্রয়ী বিকাশ, মেধাভিত্তিক বিকাশ। প্রতিষ্ঠানই কিন্তু মূল লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য ছিল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কল্যাণকর ফলাফলের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করা। উন্নয়নও কিন্তু জোর-জবরদস্তির ব্যাপার হয়ে যেতে পারে। আবেদ ভাই খুবই গুরুত্ব দিতেন মাঠ থেকে শোনার। যার ভাগ্যোন্নয়নের বিষয়, তার কথা না শুনে কীভাবে উন্নয়ন আগাতে পারে? এই মৌলিক বিষয়টি নিয়ে আবেদ ভাই সর্বদা সজাগ ছিলেন। আবেদ ভাই থেকে এই শিক্ষার বিষয়টি এখন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে, কারণ সময় বদলাচ্ছে। নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে চলে এসেছে- যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ, নিরাপদ খাদ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, যুব/কিশোর-কিশোরী এজেন্ডা ইত্যাদি। শোনার সংস্কৃতি জোরদার করেই নতুন সমাধানের অন্বেষণ করতে হবে। এটিই আবেদ ভাইয়ের শিক্ষা।

দায়বদ্ধতা ও প্রাসঙ্গিকতা যদি ব্র্যাকের দুই অবশ্যপালনীয় নীতি হয়, তবে আমার দৃষ্টিতে তৃতীয়টি হচ্ছে উপযুক্ত ফলাফলের স্পৃহা। স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার যে বোধ আবেদ ভাই সঞ্চারিত করেছিলেন তা কতিপয় ইচ্ছার নিছক ঘোষণা নয়। সকল সৃজনশীল শক্তি ও শ্রম ব্যয় করতে হবে এমনভাবে, যার দ্বারা ব্র্যাক যে লাখ লাখ নারী, পুরুষ ও শিশুর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের সকলের জন্য কল্যাণমূলক, পরিমাপযোগ্য এবং টেকসই ফলাফল নিয়ে আসা সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, এর দ্বারা ব্র্যাকের সামর্থ্যও বিকশিত হবে, যা কল্যাণমূলক পরিবর্তন আনতে কার্যকর প্রভাবক হিসেবে সংস্থাটির ভূমিকা ধারাবাহিক ও জোরদার করবে।

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আবেদ ভাইয়ের অবদানের স্বীকৃতি প্রকারান্তরে সামাজিক ও বেসরকারি খাতের অবদানের স্বীকৃতি। গত পঞ্চাশ বছরে এই ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আগামীর অর্জন ও আকাঙ্ক্ষা নিশ্চিত করতেও সামাজিক ও বেসরকারি খাতের কার্যকর ভূমিকা রাখার সহায়ক পরিবেশ অব্যাহত রাখা সমপরিমাণ জরুরি। সামাজিক ও বেসরকারি উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পরিপূরক। যখনই এই সমগ্র সমাজ তথা ‘হোল-সোসাইটি’ অ্যাপ্রোচ কার্যকর হয়েছে তখনই সুষম উন্নয়ন বেগবান হয়েছে। আবেদ ভাইয়ের অর্ধশতাব্দীর নিরলস সাধনা এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করেছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ত্রাণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ব্র্যাকের যাত্রা শুরু। কিন্তু পরিস্থিতি যেমন বদলায়, তেমনি প্রয়োজনও বদলায়। পরের ৪০ বছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদচারণা ঘটেছে ব্র্যাকের। কিন্তু এই পদচারণা কোনো অর্থে এলোপাতাড়ি ছিল না। তৃণমূলের কথা শোনার প্রতি আবেদ ভাই সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি সহজ এবং মৌলিক। যার জীবনে আপনি পরিবর্তন আনতে চান তার কথাই যদি না শোনেন, তাহলে কী করে বুঝবেন কোথায় এবং সবচেয়ে কার্যকর কোন উপায়ে নিজের মনোযোগ ও শক্তি ব্যয় করবেন? আশির দশকে শিশুমৃত্যু রোধে ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে সফল উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে নারীদের বেশি সন্তান গ্রহণের পেছনের যে কারণ সেটারও যৌক্তিক সমাধান হয়েছিল। তারা ছয়-সাতটি করে সন্তান নিতেন, কারণ তাতে শেষ পর্যন্ত কয়েকটি বাঁচার সম্ভাবনা থাকত। শিশুমৃত্যু কমে যাওয়ায় তাদের সন্তান হারানোর উদ্বেগ কমে এলো। সন্তানসংখ্যা কমে আসায় নারীর ওপর সাংসারিক চাপও বেশ খানিকটা লাঘব হলো। এর ফলে নতুন ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার অবসর মিলল তাদের। নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ বাড়ল এতে। ১৯৯০-এর দশকে এসে সরকার থেকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন জোরদার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। গ্রামপর্যায়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যের কারণে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে থেকে যাওয়া শিশুদের বিষয়টি তখন উন্মোচিত হলো। আবেদ ভাইয়ের নেতৃত্বে ব্র্যাক তখন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করার মাধ্যমে সেই সমস্যা সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

আবেদ ভাই যখন ২০১৯-এর জুলাইতে ব্র্যাক বাংলাদেশ বোর্ডের চেয়ারপারসন পদে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, প্রথমে বিস্মিত হয়ে পরেতাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম আমার ওই পদে করণীয় সম্বন্ধে তাঁর কোনো বিস্তারিত পরামর্শ আছে কি না। তিনি আসলে ওই উত্তরের পথে হাঁটেননি। আমি নিজ থেকে পরে বুঝলাম যে তাঁর ‘মেসেজ’ অন্য ধরনের। তিনি আস্থা রাখছেন যাদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তারা তাদের সময়ের প্রেক্ষিতে ও সম্মিলিত বুদ্ধিতে ‘করণীয়’ চিহ্নিত করবেন। তিনি বরং গুরুত্ব দিলেন ‘করণীয়’ তালিকা তৈরির চেয়ে ব্রত, নিয়ত, ‘সেন্স অব মিশন’ প্রজ্বলিত করতে। ওপার থেকে তাঁর স্মিতহাসি তাই ভরসা দিচ্ছে ও আহ্বান জানাচ্ছে সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ ও শ্রম আঁকড়ে ধরে বহুদূর যাওয়া যায়, যেতে হবে। কারণ অতিমারি-উত্তর পৃথিবীতে এবং বাংলাদেশে ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের সংখ্যা অগণিত। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের পবিত্র কাজ কাঁধে তুলে নেওয়ার দায়িত্ব আজকের প্রজন্মেরই।

শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁকে স্মরণ করছি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা