× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিস্ময়কর ধানশিল্পী হরিপদ কাপালী

পাভেল পার্থ

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:১৭ পিএম

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৪৬ পিএম

বিস্ময়কর ধানশিল্পী হরিপদ কাপালী

গ্রামবাংলার লাখো- কোটি স্বীকৃতিহীন কৃষকেরই একজন হরিধানের উদ্ভাবক হরিপদ কাপালী। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের আসাননগর গ্রামের এই কৃষক ‘বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন প্রক্রিয়ার’ মাধ্যমে হরিধান উদ্ভাবন করেন। জাত উদ্ভাবনে বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন একটি বহুল প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ।

হাজার বছর ধরে কৃষক নারী-পুরুষরাই উদ্ভাবন করেছেন এবং করে চলেছেন শস্য ফসলের হাজারো জাত। একেক অঞ্চলে উদ্ভাবিত সে জাতের একেক নাম তারাই রেখেছেন। কিন্তু এমন নথি ও দলিল নেই, কোন কৃষক বা কোন একদল কৃষক কোন জাতটি উদ্ভাবন করেছেন তার। যেমন-হাওরাঞ্চলের একটি গভীর পানির ধান রাতা কিংবা রাঙামাটির পাহাড়ি জুমের ধান খবরক। এসব ধানজাত কে উদ্ভাবন করেছে? হয়তো কোনো

প্রমাণসাপেক্ষ কোনো উত্তর নেই। আবার অধিপতি জ্ঞানব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কিংবা আমলাতান্ত্রিক বাহাদুরি এসব প্রমাণ পছন্দও করে না। মানে এরা কৃষক, জেলে, মজুরের উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। তাদের মতে, ধানজাত উদ্ভাবন করবেন একজন উদ্ভিদ প্রজননবিদ বা কৃষিবিজ্ঞানী। জুম-জমিনের একজন কৃষক তো ‘চাষা’, সে কেন উদ্ভাবক বা প্রজননবিদ হবে? বৈষম্যমূলক এমন দৃষ্টিভঙ্গির ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে কৃষকের জ্ঞান ও শ্রমের মজবুত পাটাতন প্রমাণ করে চলেছেন গ্রামবাংলার অনেক কৃষক। নিয়ানডার্থাল, জুরাসিক, লোহাযুগ বা মৌর্য আমল নয়। পাল, সেন বা মোঘল সাম্রাজ্য নয়। ব্রিটিশ, পাকিস্তান বা সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ নয়। এখনও কৃষকদের এই জাত উদ্ভাবনের চর্চা টিকে আছে। এখনও কৃষকরা কেবলমাত্র ‘চাষা’ নন, প্রমাণ করে চলেছেন তারা ধানশিল্পী এবং একেকজন বিস্ময়কর বিজ্ঞানী। খাগড়াছড়ির ফকুমার ত্রিপুরা উদ্ভাবন করেছেন ফকুমার ধান, সুনামগঞ্জের নুয়াজ আলী ফকির চুরাক ধান, গাইবান্ধার রঞ্জু মিয়া সোহাগ-৪ ধান, ঝিনাইদহের মকবুল হোসেন মকবুল ধান। তালিকাটি এভাবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। তবে শতসহস্র জাত উদ্ভাবন করেও কৃষকরা উদ্ভাবক ও প্রজননবিদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। 

গ্রামবাংলার লাখো-কোটি স্বীকৃতিহীন কৃষকেরই একজন হরিধানের উদ্ভাবক হরিপদ কাপালী। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের আসাননগর গ্রামের এই কৃষক ‘বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন প্রক্রিয়ার’ মাধ্যমে হরিধান উদ্ভাবন করেন। জাত উদ্ভাবনে বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন একটি বহুল প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। যেখানে কোনো বাছাইকৃত জাতের বীজ আলাদা লাগিয়ে সেখান থেকে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য দেখে কোনো সারি বাছাই করে পরপর কয়েক বছর চাষ করা হয়। এভাবে পরপর কয়েক বছর চাষ করার ভেতর দিয়ে একটি বিশুদ্ধ জাত নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট অনেক ধানজাত এই পদ্ধতিতে উদ্ভাবন ও ছাড় দিয়েছে। যেমনÑ ব্রিধান-৫ মানে হলো দুলাভোগ নামের এক স্থানীয় ধানের বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন। ১৯৭৬ সালে ধানজাতটি ছাড় দেওয়া হয়। ব্রিধান-২৬ হলো খাসকানি ধানের বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন। হরিপদ কাপালী তাই করেছিলেন। তবে এতে তার দীর্ঘদিনের ভালোবাসা, শ্রম, স্বপ্ন এবং সৃষ্টিময়তার এক প্রবল হাতছানি জড়িয়ে ছিল। মা সুরধনী বিশ্বাস ও বাবা কুঞ্জলাল বিশ্বাস শৈশব থেকেই হরিপদকে শিল্পীর স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই দেখা যায়Ñ বাবলা কাঠ দিয়ে কৈশোরেই হরিপদ তৈরি করেছেন ময়ূর-লাঙল, সর্প-মই, কারুকাজ করা হুক্কা, নকশা পিঁড়িসহ নানা শৈল্পিক কৃষি উপকরণ। হরিপদের আর কোনো ভাই-বোন ছিল না বলে তার শৈশব ও কৈশোর কাটে চারধারের জমি, জলা আর জনজীবনের সঙ্গে খেলায় খেলায়। বাঁশের টুকরির ভেতর পাটের ভেজা বস্তা, তার ভেতর জাগ দিয়ে রাখা হতো ভেজা ধানবীজ। ধীরে ধীরে গরম পেয়ে অঙ্কুরিত হতো বীজদানা। প্রকৃতির এমন সব পরিবর্তন তার চিন্তাজগতে নাড়া দিয়েছিল। 

হরিপদ দেখেছেন তার দাদু, এমনকি বাবার সঙ্গে তিনি কিছুদিন চাষ করেছেন মেঘনাল, বিরবল, সুরথা, খরচামুড়ি, ঘৃত্ত্যকলা, ভইশদল ধান। হরিপদের প্রথম যৌবনে নিজের চোখের সামনে একে একে খুন হয়ে যায় সব দেশি ধানের জাত। মাঠ-ঘাট দখল করে ফেলে উচ্চ ফলনশীল বীজ। মাটির তলা থেকে জল টেনে তুলে, সার, বিষ দিয়ে এক হুলস্থুলের কৃষি উন্নয়ন শুরু হয়। হরিপদ দেশি জাত বাঁচাতে নানা সময় তর্কে জড়িয়ে পড়েন কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাদের একটাই হিসাব- ধানের ফলন বেশি দরকার, দেশি জাতে ফলন কম। হরিপদ খুঁজে বেড়ান তার আদি ধানজাতের গুণাবলি, মাঠে-ময়দানে পড়ে থাকেন। খুঁজে খুঁজে কিছু জাত সংগ্রহ করেন, কখনও এক জাতের সঙ্গে আরেক জাতের মিলন ঘটান। কত পরীক্ষা আর কত নিরীক্ষা! ১৯৭০ সালে একবার এমন এক ভিন্ন ধানজাত খুঁজে পান। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিশাল আখ্যানে সেই ধান যেন কোথায় হারিয়ে যায়। এরপর আরও কয়েকবার কিছু জাত নিয়ে তিনি পরীক্ষা করেন। শেষমেশ সফল হন ১৪০৯ বাংলায়। তার উদ্ভাবিত এক ধানজাতকে কৃষক সমাজ নাম দেয় ‘হরিধান’। ফলন, স্বল্পব্যয়ী ও টিকে থাকার বিস্ময়কর গুণের সমন্বয়ে এই হরিধান খুব সহজেই অল্প সময়ে বাংলাদেশের কৃষিজমিনে পৌঁছে যায়। যদিও এই ধানবীজ ও ‘হরিধানের’ নামের সুনাম নিয়ে কিছু প্রভাবশালী বীজ ব্যবসায়ী ও কোম্পানি নানা প্রতারণামূলক বাণিজ্য ও একতরফা মুনাফা লুটে চলেছে। 

১৪০৫ সালে ভুঁই (জমিন)-এর আগাছা বাছতে গিয়ে এই ধানের চারা খুঁজে পান হরিপদ কাপালী। নিজেদের পারিবারিক জমিন রত্নাখালের ধারে কদমতলার কুঁড়ো বিল জমিন বা ভাগাড়ের ভুঁইয়ের বুনো ঘাসের ভেতর থেকেই পাওয়া গিয়েছিল হরিধানের আদি রূপকে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের বিশুদ্ধ সারি নির্বাচনের মাধ্যমে এই জাত সামাজিকভাবে ছাড় পায়। ১৪০৯ সালে সামাজিকভাবে গ্রামের মানুষ এর নাম দেয় হরিধান। গ্রামের পর গ্রাম, জেলার পর জেলায় এই ধান ছড়িয়ে পড়ে। দৈনিক জনকণ্ঠ, প্রথম আলো, চ্যানেল আইতে হরিধান নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের ভেতর দিয়ে হরিধান নিয়ে একটা সাড়া তৈরি হয়। নারায়ণগঞ্জের শ্রুতি নামের এক সাংস্কৃতিক সংগঠন, ১৪১১ বাংলায় বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক তাকে সম্মাননা প্রদান করে। হরিপদ কাপালী বারসিক আয়োজিত ‘জাতীয় বীজ সম্মেলন ১৪১১’ উদ্বোধন করেন। 

হরিধান গাছের উচ্চতা আড়াই থেকে তিন হাত বা আরও বেশি। ধানের রঙ সাদা (পাকা ধানের রঙ সোনালি), চালের রঙ সাদা ফকফকা। প্রতি বিঘায় ফলন ১৮ থেকে ১৯ মণ। একটা সময় পর্যন্ত বোরো মৌসুম পুরোটাই দখল করে ছিল ব্রিধান-১১। কিন্তু এটি বদলে সব জমি হয়ে ওঠে হরিধানের। বোরো ও আমন উভয় মৌসুমে এই ধান চাষ করে নানা নিরীক্ষা করেছেন নানা অঞ্চলের কৃষক। তবে ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান হরিধানকে কোনোভাবেই একটি স্বতন্ত্র উদ্ভাবিত জাত হিসেবে মেনে নিতে পারল না। প্রতিষ্ঠানটি প্রমাণ করতে চাইল হরিধানকে পাওয়া গেছে ব্রিধান ১১-এর ধানজমিন থেকে। কিন্তু হরিপদের বিজ্ঞান গবেষণা গুরুত্বহীন হয়েই রইল। এখন বোঝা দরকার কেন হরিধান ব্রিধান-১১ থেকে আলাদা এবং কেন কৃষকসমাজে এই জাত অল্পদিনেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। যেকোনো জমিনেই এই ধান চাষ করা যায়। ডেঙ্গা ও ডুব/ডুপ এ রকম সব জমিতেই চাষ করা যাচ্ছে। সবচেয়ে ভালো হয় কুর/কুড় জমিনে। কুর মানে হলো এমন জমি, যেখানে বর্ষাতে পানি আসে। গড়পড়তা ধান ও খড়ের ফলন ভালো। দেশীয় পদ্ধতিতে চাষ করা যায়, চাষে সময় ও কষ্ট কম লাগে। রোগবালাই নেই। চাষের খরচ অনেক কম। ভাত সুস্বাদু। বিলের জমিনে সব ধান তলিয়ে গেলেও এই ধান টিকে থাকতে পারে। 

রাষ্ট্র হরিপদ কাপালীকে স্বীকৃতি দেয়নি, তাই বলে জাত ও বীজের বিশুদ্ধতা রক্ষা করবে না? হরিধানের নিরাপত্তা দেবে না? একতরফাভাবে আজ ‘হরিধান’ নামে দেশের যেকোনো জায়গায় ধানবীজ বিক্রি হয়। কিন্তু ‘হরিধান’ নামে বিক্রি হওয়া সব বীজ ও জাত হরিপদ কাপালী উদ্ভাবিত ‘হরিধান’ নয়। হরিধান বীজের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণে কোনো নজরদারি নেই। খারাপ বীজ ও ভিন্ন জাতকে ‘হরিধান’ হিসেবে বিক্রি করার ভেতর দিয়ে অন্য ক্ষতির পাশাপাশি উদ্ভাবক হরিপদ কাপালীরও যে সুনাম ক্ষুণ্ন হয় তা কি রাষ্ট্র বিবেচনা করবে না? 

বিরল কৃষিজ্ঞানের অধিকারী হরিপদ কাপালী ৬ জুলাই ২০১৭ ভোরে তার নিজ বাড়ি আসাননগরে মহাপ্রয়াণের পথে যাত্র করেছেন। মৃত্যুকালে স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি হরিধানের মতো এক আশাজাগানিয়া ধানজাত রেখে গেছেন তিনি। পারিবারিক নাম হরিপদ বিশ্বাস হলেও গণমাধ্যম তাকে পরিচিত করায় ‘হরিপদ কাপালী’ হিসেবে। হরিধান উদ্ভাবনের দীর্ঘ ১৮ বছর পাড়ি দিলেও রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক মনস্তত্ত্ব বদলায়নি। একজন কৃষককে ‘উদ্ভাবক’ ও বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতিদানে আমাদের কী কী বদলাতে হবে? কেন আমরা সেসব বদলাচ্ছি না? 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা