× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আমাদের আবেদিন স্যার

রফিকুন নবী

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:৩১ পিএম

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৪৭ পিএম

আমাদের আবেদিন স্যার

শিল্পকলাকে বুঝতে পারে এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিন্তা ছিল সুদূরপ্রসারী। সবাইকে ছবি আঁকতে হবে, গান গাইতে হবে- এমনটা তিনি ভাবেননি। শিল্পকলাকে ভালোবাসবে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। আর সেজন্য প্রয়োজন শিল্পকলা শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আমাদের শ্রেষ্ঠতম শিল্পীদের একজন। বাংলাদেশের শিল্পকলার বর্তমান অবস্থা এবং শিল্পকলাকেন্দ্রিক যে আন্দোলন- এর সমস্ত কিছুর উদ্যোক্তা তিনি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে আমাদের এই অঞ্চল শিল্পকলার চর্চার ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে ছিল। কিন্তু সেই সময়ে শিল্পীরা ছিলেন। তারা শিক্ষা-দীক্ষার জন্য, প্রতিষ্ঠার জন্য, কিছু অর্জনের জন্য কলকাতায় যেতেন। কারণ, তখন শিক্ষা, শিল্পকলা, সংগীত- এক কথায় সবকিছুর কেন্দ্র ছিল কলকাতা।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনিও কলকাতায় গিয়ে লেখাপড়া করলেন। ছাত্র হিসেবেও অনেক মেধাবী ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় বেশ সুনামের অধিকারী হন। তিনি এমনই অভূতপূর্ব মেধাবী শিল্পী ছিলেন যে, তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন সময়ে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন কলকাতা আর্ট কলেজে।

ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর একটা প্রচণ্ড দুরবস্থা দেখা দেয়। কে কোথায় থাকবে, ভারতে থাকা কি ঠিক হবে নাকি চলে আসবে এখানে- এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশ কঠিন ছিল। বিশেষ করে আমাদের শিল্পীদের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তহীনতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। কারণ ওইখানে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন অনেকেই। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে তখনই বেশ বিখ্যাত। সেই অবস্থান ছেড়ে এদেশে আসা অনেকটা নির্জন দ্বীপে চলে যাওয়ার মতোই ছিল। এসবের হাতছানির পরও তিনি ফিরে এলেন নিজ দেশে। দেশে এসেই এখানকার শিল্পকলার ভবিষ্যৎ কী হবে, শিল্পকলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে কী করতে হবে- এসব নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন। বিভিন্ন শিল্পীকে একত্রিত করে এখানে যা নেই সেটা তথা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন।

শিল্পকলাকে বুঝতে পারে এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিন্তা ছিল সুদূরপ্রসারী। সবাইকে ছবি আঁকতে হবে, গান গাইতে হবে- এমনটা তিনি ভাবেননি। শিল্পকলাকে ভালোবাসবে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। আর সেজন্য প্রয়োজন শিল্পকলা শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা আসবে, শিক্ষকরা তাদের ছবি আঁকা ও শিল্পের গুণগত দিকগুলো শেখাবে- এমনটাই তিনি ভেবেছিলেন। যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে শিল্পকলার অনুরাগী তৈরি হবে। যারা ছবি আঁকবে, ছবি ভালোবাসবে।

এমন একটি প্রজন্ম তৈরিতে প্রথম পদক্ষেপ ছিল আর্ট কলেজ স্থাপন। ১৯৪৮ থেকে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই সময়টা ছিল পাকিস্তানি আমল। তখন পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তান সবদিক থেকে উন্নত। পশ্চিম পাকিস্তানের ধ্রুপদি সংগীত অনেক উচ্চমার্গের। সেখানে ব্রিটিশ আমল থেকে আর্ট কলেজ রয়েছে। লাহোরের সেই আর্ট কলেজকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলের শিল্পীরা প্রাধান্য বিস্তার করে আসছিলেন সব সময়। কিন্তু আমাদের এখানে কিছুই ছিল না। আমাদের দেশের শিল্পীমনাদের সবার পক্ষে লাহোরের আর্ট কলেজে গিয়ে শিক্ষালাভের উপায়ও নেই। ফলে এখানে একটা আর্ট কলেজের প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজনটাই উপলব্ধি করলেন জয়নুল আবেদিন। তাঁর গড়া এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েই আমরা শিল্পী হলাম।

ইতোমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। রাজনৈতিক আন্দোলন আর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ গঠন করি। স্বাধীন দেশের পাশাপাশি এই সময়কালে শিল্পকলা তথা চারুকলার প্রতিটি বিভাগে আমরা একটা চমৎকার পর্যায়ে পৌঁছেছি। আমাদের শিল্পকলার খ্যাতি আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত বিরাজ করছে। এসব কিছুর পেছনে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনই মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন। এই মানুষটি যদি কলকাতা থেকে নিজভূমে না আসতেন কিংবা আর্ট কলেজ গড়ে তুলতে উদ্যমী না হতেন, তবে চিত্রকলার মানুষ আমরা যারা শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলি, ছবি আঁকি- তাদের পক্ষে এই অবস্থানে আসা, এসব নিয়ে কথা বলা কখনোই সম্ভব হতো না। কারণ আর্ট কলেজে যারা পড়তে আসত তাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের পক্ষে কলকাতা, লাহোর বা বিলেতে গিয়ে পড়া সম্ভব ছিল না। এসব কথা যখন ভাবি, তখন মনে হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কতই না বিশাল একজন ব্যক্তিত্ব; যিনি আমাদের চিত্রকলার ভিত্তি স্থাপন করে দিয়েছিলেন। 

বাংলাদেশের শিল্পকলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াটাই যে তাঁর বড় কাজ তা কিন্তু নয়। আমাদের শিল্পকলার প্রায় সব অঙ্গনের মানদণ্ড তৈরিতেও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সাধারণভাবে দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা দিয়ে তাঁকে মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু শিল্পকলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলে এক কথায় স্বীকার করেন, জয়নুল আবেদিন কত বড় মাপের একজন শিল্পী। তিনি দেশভাগের পূর্বে সর্বভারতীয় শ্রেষ্ঠ শিল্পীর পুরস্কার লাভ করেছিলেন। অনেকে মনে করেন- প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করতে গিয়ে বা সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে অধিক সময় ব্যয় করার কারণে শিল্পাচার্যের শিল্পচর্চা ব্যাহত হয়েছে। সেটা হয়েছিল হয়তো। কিন্তু পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে যেসব চিত্রমালা তিনি এঁকেছেন, সেগুলো সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ।

আগেই বলেছি, দেশভাগের পূর্বে বাংলাদেশে শিল্পকলার অবস্থা উল্লেখ করার মতো কোনো পর্যায়ে ছিল না। কিন্তু কলকাতা থেকে আমাদের শিল্পীরা বাংলাদেশে যখন এলেন, তারা আবিষ্কার করলেন সাংস্কৃতিক দিক থেকে আমাদের লোকজ শিল্পের বেশ আকর্ষণীয় একটা অবস্থান রয়েছে। আবেদিন স্যার এসে লোকজ শিল্পের যে ব্যাপ্তি দেখলেন, যেমন- পটচিত্র, টেপাপুতুল, নকশিকাঁথা, মাটির সরা, শাড়ি-গামছার নকশা ইত্যাদি। এ সবকিছুর মধ্যেই দারুণ এক শৈল্পিক রূপ আবিষ্কার করলেন তিনি। আমাদের লোকজ শিল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কাউকে অনুসরণ না করেই আবেদিন স্যার নিজের একটা ধরন তৈরি করলেন। বলা চলে, সে সময় প্রায় সব শিল্পীই এসব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। নিজেদের শিক্ষা, আধুনিকতার বোধ ও লোকজ অনুষঙ্গের মিশেলে সবাই সবার নিজস্ব ধরন তৈরি করে নিয়েছিলেন। 

লোকজ শিল্পের উন্মেষ ঘটে এক ধরনের ইনোসেন্স বা সরলতা থেকে। গ্রামের সাধারণ মানুষ, যারা এই কাজগুলো করতেন তারা পিকাসো, মাতিস, নন্দলাল কিংবা যামিনী রায়দের খোঁজ জানতেন না। তারা নিজস্ব দৃষ্টি দিয়ে, নিজেদের জগতের মধ্যে থেকে ভালো লাগা, ভালোবাসা থেকে গড়তেন এসব শিল্প। আবেদিন স্যার ও তাঁর সমসাময়িক শিল্পীরা বাংলার এই সহজ শিল্পবোধই কাজে লাগিয়েছেন তাঁদের চিত্রমালায়। পঞ্চাশের দশকে আঁকা শিল্পাচার্যের ছবিগুলোর মধ্যেও সেই সহজিয়া ভাব প্রকটভাবে লক্ষ করা যায়। 

এ ছাড়াও মানবিক দিক নিয়ে কাজ করার একটা প্রকাণ্ড ঝোঁক ছিল জয়নুল আবেদিনের। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দ্বারা তিনি তাড়িত হতেন, মর্মাহত হতেন। এসব তিনি তাঁর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতেন। যেমনটা আমরা দেখতে পাই তাঁর দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার মধ্যে। দুঃখ-কষ্টকে তিনি একটা বক্তব্যের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করতেন তাঁর ছবির মাধ্যমে। দুর্ভিক্ষ সিরিজের ছবিগুলোর দ্বারা তিনি সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন- আসলেই এখানে কী ঘটছে। 

সার্বিকভাবে, আবেদিন স্যারের চিত্রকলার মধ্যে আমরা এক ধরনের রিয়েলিটির দেখা পাই। যে রিয়েলিটি মানুষের বোধগম্য হয়। তিনি রেনেসাঁ, পোস্ট-রেনেসাঁ বা রোমান্টিক পিরিয়ডে ইউরোপে যে রিয়েলিটির কাজ হয়েছিল, সেগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন না। একদম নিজস্ব একটা ধরন তিনি তৈরি করেছিলেন। যার মধ্যে আধুনিকতা আছে যেমন, তেমনি আছে তাঁর শিক্ষা ও বাস্তবতার বোধও। অনেক চিত্রসমালোচক আবেদিন স্যারের চিত্রমালাকে নানা টার্মে ফেলতে চেয়েছেন, তাদের ভাবনাকে নেওয়া যেতে পারে হয়তো। কিন্তু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তাঁর মতো করেই এঁকেছেন। তিনি নির্দিষ্ট কারও দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, সেটা বলা যাবে না।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে আমরা আবেদিন স্যার বলেই ডাকতাম। প্রথমে শিক্ষক হিসেবে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলো, পরবর্তীতে আমি যখন শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি আর্ট কলেজে তখন সেই নৈকট্য আরও বেড়ে যায়। চিত্রকলায় আমার কিংবা আমাদের যত অর্জন সেটা আবেদিন স্যারের কারণেই। শিল্পী হয়ে উঠতে হলে যে শিক্ষা, ঘটনা ও অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, আমার ক্ষেত্রে তার সবই সম্ভব হয়েছে স্যারের সান্নিধ্যের কারণে। আমাদের ছাত্রাবস্থায় দেশে যত রাজনৈতিক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, সেসব বিষয়ে কী করা উচিত কী করা উচিত না, এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন। সবাই জানত, চারুকলা বা আর্ট কলেজ থেকে যা কিছু হচ্ছে এসবের পেছনে আবেদিন স্যারের প্রচ্ছন্ন একটা প্রভাব আছে।

আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছি, সেটাও স্যারের কারণেই। তিনি যদি জোর না করতেন তাহলে হয়তো শিক্ষকতা পেশায় আমার আসা হতো না কখনও। আর্ট কলেজে যখন যাই, সিঁড়িটা দিয়ে যখন উঠি- তখন আবেদিন স্যারের কথাই মনে হয় সব সময়।

সবশেষে বলব, আমাদের সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরা কেউ যদি তিল পরিমাণ আলোকিত হয়ে থাকে, তবে তার পেছনের ব্যক্তিটি হলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা