× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নজরুলের উত্তরাধিকার ও বাংলাদেশের কবিতা

রফিকউল্লাহ খান

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:৫৩ পিএম

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৫০ পিএম

নজরুলের উত্তরাধিকার ও বাংলাদেশের কবিতা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নজরুলের কবিতা ও গান ছিল বাঙালির অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। ঔপনিবেশিকতা, শ্রেণিশোষণ, জাতিশোষণ ও সামন্তশোষণের বিরুদ্ধে নজরুলের শিল্পিত উচ্চারণ অন্তঃসলিলা প্রবাহের মতো এ সময়ের সক্রিয় কবিমনকে আন্দোলিত করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও সামান্য ব্যতিক্রম বাদে মানুষের সর্বৈব মুক্তির প্রত্যাশা অধরাই থেকে গেছে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সেনাশাসন, ধর্মীয় কুসংস্কার ও মৌলবাদের অব্যাহত শক্তিবৃদ্ধি, গণতন্ত্র ও মানবমুক্তির সাধনা বাংলাদেশের সমাজমানসকে বিচিত্রভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

যে সামাজিক-রাজনৈতিক উপযোগিতাবোধের সঙ্গে নান্দনিক উপযোগিতাবোধের সমন্বয় নজরুলের কবিতার মৌলিক প্রান্ত, বাংলাদেশের সমাজমানস ও শিল্পীচৈতন্যে গোড়া থেকেই তার প্রভাব সুস্পষ্ট। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা কবিতার স্বভাবধর্ম, নজরুলের যুগান্তকারী আত্মপ্রকাশ, তিরিশের দশকের নজরুল-বিকেন্দ্রিক কাব্যধারার উদ্ভব, বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগ্রামের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কথা প্রাসঙ্গিকভাবেই এসে পড়ে। আমরা জানি, উত্তুঙ্গ দ্রোহ ও আশাবাদ, দেশপ্রেম, সকল প্রকার শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা, গণমানুষের মুক্তিকামনা প্রভৃতি নজরুল-কাব্যের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য। নজরুল-সূচিত এই কাব্যবস্তু তিরিশের নেতিবাদী কবিদের কাছেও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে চল্লিশের দশকে, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে জাতীয় মুক্তির প্রয়োজনে। দীর্ঘকালের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ   ও নিপীড়ন, কলোনিগর্ভে বিকৃতভাবে বিকাশমান সমাজজীবনে শ্রেণিশোষণের বিচিত্র হিংস্ররূপ বাংলাদেশের সমাজমানসকে বিক্ষুব্ধ করে রেখেছিল। যে কারণে কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের নৈরাশ্য, অবক্ষয়চেতনা ও যন্ত্রণাবোধ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের কবিদের কাছে পরম বলে গৃহীত হয়নি। বরং নবোদ্ভূত মুসলিম মধ্যবিত্তের আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও প্রসার, বিচিত্র শোষণ ও কুসংস্কারের অচলায়তনবন্দি সমাজের সর্বৈব মুক্তি-আকাঙ্ক্ষাই প্রবল হয়ে উঠেছিল এ ভূখণ্ডের কবিমানসে। চল্লিশের দশকে যে বেগবান কাব্যধারা বাংলা সাহিত্যে নতুন জীবনাভিজ্ঞতার সঞ্চার করে, তা বাঙালিজীবনে সমাজ ও সমষ্টির মুক্তি-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই নবধারার কবিতার স্রষ্টা মূলত নবচেতনায় জাগ্রত মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত কবিরা। বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যবাদী কাব্যচর্চার সমান্তরালে চল্লিশের নবোদ্ভূত কবিবৃন্দ আধুনিক জীবনচেতনার মর্মমূলস্পর্শী কাব্যধারার জন্ম দিলেন- যা বাংলা কবিতার সমাজবাদী ধারার সঙ্গে সংলগ্ন। তিরিশের পাশ্চাত্যপন্থার সঙ্গে চল্লিশের দশকের প্রগতিবাদী নবধারার অঙ্গীকার এসব কবির মধ্যে একটা সমন্বয়ী বিষয় ও আঙ্গিকচেতনার জন্ম দেয়। এসব কবির সমাজভাবনা, মানবমুখিতা এবং পুরাণ ও ঐতিহ্যচেতনায় নজরুলের উত্তরাধিকার সুস্পষ্ট। এই নতুন কাব্যধারার নির্মাতাদের মধ্যে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, গোলাম কুদ্দুস, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, সানাউল হক, সিকান্‌দার আবু জাফর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবিরোধী সাহিত্য আন্দোলন, উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মন্বন্তর, মহামারি প্রভৃতির প্রতিক্রিয়ায় এ সকল কবি রক্তাক্ত ও উজ্জীবিত হয়েছেন। এঁদের অধিকাংশই তিরিশের কবিদের রূপান্তরিত কাব্যবস্তুর সাহচর্য ছাড়াও সমকালীন তারুণ্যদীপ্ত সুকান্ত ভট্টাচার্য, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, নবেন্দু রায় প্রমুখের প্রগতিবাদী চেতনার সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। কবিতার প্রচলিত ধারার ললিত ঐতিহ্য প্রথম ভেঙেছিলেন নজরুল ইসলাম জীবনচেতনায় ও শব্দব্যবহারে; সুকান্ত ভট্টাচার্য তাকেই সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করলেন। সুকান্তের জনপ্রিয়তার উৎস রাজনীতিকে শিল্পের উপাদানে পরিণত করা- যার সূত্রপাত নজরুলের কবিতায়।

১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের ফলে বাংলাভাষী ভূখণ্ড দুই স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ড ‘পাকিস্তান’ নামক এক সামন্ততান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক আদর্শনির্ভর রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ অঞ্চলে মানবমুক্তি ও স্বাধিকার প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। জাতিশোষণ, শ্রেণিশোষণ, সামন্তশোষণ, সেনাতন্ত্র বাংলাদেশের সমাজমানসকে পুনরায় নিক্ষেপ করে অতীত গর্ভে। আত্মপরিচয়ের সংকট, জাতিসত্তা সন্ধানের সংকট বাংলাদেশের কবিমনকে নতুন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সঙ্গত কারণেই এই নতুন রাষ্ট্রের কবিতায় নিভৃতচারিতা ও ব্যক্তির আত্মকুণ্ডলায়নের পরিবর্তে দ্রোহ, প্রতিবাদ এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। ১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলনের শিল্পিত ফসল হিসেবে এ ভূখণ্ডের কবিতা নজরুলের কাব্য-ঐতিহ্যকেই যেন নবতাৎপর্যে গ্রহণ করেছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত সহযোগে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ফররুখ আহমদের ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৫) এবং আহসান হাবীবের ‘রাত্রিশেষ’ (১৯৪৭) কাব্যগ্রন্থের বিষয়চেতনা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমকালীন সমাজবাস্তবতালগ্ন। এ দুটি গ্রন্থই বিভাগ-পূর্বকালে রচিত। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের রক্তিম পরীক্ষাই মূলত বাংলাদেশের কবিতাকে অধিক মাত্রায় সমাজ ও রাজনীতিমনস্ক করে তোলে- প্রতিবাদী করে তোলে শোষণ-বঞ্চনা ও সর্বপ্রকার নিপীড়নের বিরুদ্ধে। এভাবেই নজরুলের অন্তঃশীলা প্রভাব বাংলাদেশের কবিতার নবপ্রকরণের মধ্যেও স্থান করে নেয়। যেমন-

১. বন্দরে নিঃশেষ রাত, এখন সকাল

ক্লান্তমুখে সকালের সূর্যের মহিমা

তখন হৃদয়ে ডাক বসন্তের-

স্তব্ধবাক পাখিরা মুখর।

(আহসান হাবীব : ছায়াহরিণ, ১৯৬২)

২. এবার তোমার সকল শৌর্য প্রকাশ করো সিপাহসালার।

মনের মাটিতে বাজাও দামামা কাড়া নাকাড়া;

(ফররুখ আহমদ : সিরাজুম মুনীরা)

৩. আমাদের চোখে চোখে লেলিহান অগ্নি 

সকল বিরোধ বিধ্বংসী

এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল

কোনদিন আমরা যে ভাঙবোই

মুক্ত প্রাণের সাড়া জানবোই

আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে

নতুন সূর্যশিখা জ্বলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।

(সিকান্‌দার আবু জাফর : কবিতা ১৩৭২)

৪. আমার সংগ্রাম রোজ

গুটিসুটি আমারই ক্লীবত্বের সাথে,

আমার সংগ্রাম রোজ ক্ষুধা আলোড়নে

চেতনার ডানা ঝাড়ে আমার হৃদয়ে।

(সানাউল হক : নদী ও মানুষের কবিতা)

৫. আমার ভরসা বাঁধা শোণিত সবল এ দু’হাতে 

সহস্র দোসর সঙ্গে পাতালের নিরন্ধ্র নিবিড়ে

দৃষ্টি আর ঝড়ে তাই নির্ভয়ে দিলাম মাথা পেতে

অক্ষয় এ মৃত্যুস্বাদ হারাবো কি স্তিমিত বাঁচাতে।

(আবুল হোসেন : বিরস সংলাপ)

উল্লিখিত উদ্ধৃতিসমূহে যে চেতনার বিন্যাস লক্ষ করি, তা মূলত অন্তরিত দ্রোহেরই রূপান্তরিত শব্দরূপ। ব্যক্তির বেঁচে-থাকা যে সমষ্টি-অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত, বাংলাদেশের কবিরা গোড়া থেকেই সে সত্য অনুধাবনে সমর্থ হয়েছিলেন। এর প্রেরণামূল নিহিত নজরুলের উত্তরাধিকারচেতনায়।

ভাষা আন্দোলন ও তার পরবর্তী সময়প্রবাহে বাংলাদেশের কবিতা যে চরিত্রধর্ম অর্জন করে, তা দ্রোহ, প্রতিবাদ এবং সংগ্রামী জীবনচেতনায় উজ্জীবিত। এই নতুন চেতনা উৎসারণের কার্যকারণ নিঃসন্দেহে সমকালীন সময় ও সমাজের গভীরে প্রোথিত। তবুও ভাষা আন্দোলন-পরবর্তীকালের কবিরা যে নতুন কাব্যবস্তু উদ্ভাবনে মনোযোগী হলেন, তা নজরুলের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্রোহমূলক কবিতার সমধর্মী। আবদুল গণি হাজারী, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ কবি মুখ্যত সময় ও সমাজের গভীর থেকেই কাব্যোপকরণ আহরণ করলেন। যেমন-

১. আমার ক্ষুধায় হোক তোমাদের আচমন

হে গোপন শর্তে শৃঙ্খলিত মানুষেরা!

তোমাদের গায়ে বিপ্লবী নামাবলী

পাচার পলিস্ট্রিনের সুতোয় চৈতন্য ত্রিশঙ্কু।

চিহ্নিত করবে সরল জনকের অস্থির দ্বিতীয় মৃত্যু

তোমাদের একদা আকাঙ্ক্ষিত হাত যখন

জল্লাদের দস্তানে আবৃত 

ফাঁসিঘরের এন্ট্রিরুমে রাত্রিশেষের স্তব্ধতা

সভ্যতার উপকণ্ঠে

পৌরাণিক শৃগালের দ্বৈতকণ্ঠ

মানুষের প্রখর ঘোষণা করে

কারফিউ সাইরেনের মত।

(আবদুল গণি হাজারী : ‘ক্রুশ থেকে’ (১৯৬৯), জাগ্রত প্রদীপে)

২. এখানে আমরা ফ্যারাউনের আয়ুর শেষ কটি বছরের ঔদ্ধত্যের মুখোমুখি,

এখানে আমরা পৃথিবীর শেষ দ্বৈরথে দাঁড়িয়ে

দেশ আমার স্তব্ধ অথবা কলকণ্ঠ এই দ্বন্দ্বের সীমান্তে এসে

মায়ের স্নেহের পক্ষ থেকে কোটি কণ্ঠ চৌচির করে দিয়েছি

এবার আমরা তোমার। 

(হাসান হাফিজুর রহমান : ‘অমর একুশে’, বিমুখ প্রান্তর)

৩. শান্তি শিবিরে লৌহ সেনানী আমরা 

শ্বেত-কপোতের পাখার ছায়ার দুর্জয় ব্যূহ রচেছি

সৌরবলয়ে সূর্যের মতো প্রহরা

লৌহ সেনানী আমরা। 

গ্রাম-নগরে ও পথে-প্রান্তরে দিই ডাক

স্বদেশ আমার হুঁশিয়ার

রণদৈত্যের অক্ষৌহিণী তোলে হাঁক

পৃথিবীর আমার হুঁশিয়ার।

(আলাউদ্দিন আল আজাদ : ‘শান্তিগাথা’, মানচিত্র)

কেবল চেতনার ঐক্যে নয়, শব্দ ব্যবহার ও বাকভঙ্গিতেও নজরুলের অন্তঃশীলা উত্তরাধিকার উদ্ধৃতিসমূহে সুস্পষ্ট।

রোমান্টিক প্রেমাকাঙ্ক্ষা, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, ব্যক্তির আত্মকুণ্ডলায়ন উনিশ শতক থেকেই বাংলা কবিতার প্রধান প্রবাহ। এর সঙ্গে শূন্য অস্তিত্বের অনুভবে ব্যক্তির আত্মখনন ও আত্মহনন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কবিতায় নতুন মাত্রা সংযোজন করে। বাংলা কবিতায় প্লাটোনিক প্রেমারতি রবীন্দ্রনাথের হাতে সম্পূর্ণতা লাভ করে। নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা, সমাজ ও রাজনীতিসচেতন কবিমন প্রেমাকাঙ্ক্ষা ও তার রূপায়ণে প্রচলিত কাব্যধারা অতিক্রম করতে চেয়েছিল। তাঁর প্রেম রোমান্টিক কবিতার অধরা অনন্তপ্রিয়া বা eternal she-কে বস্তুজগতের সীমায় নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের কবিদের প্রেমানুভূতির মৌল স্বভাবে রোমান্টিকতার উক্ত বৈশিষ্ট্যই যেন বিচিত্ররূপে অভিব্যক্ত হয়েছে। পঞ্চাশের দশকের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান নাগরিক মধ্যবিত্তের স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ ও অন্তর্যন্ত্রণাকে কবিতার মৌল উপাদানে পরিণত করেছিলেন। কিন্তু সময়স্বভাবের তাড়নায় তাঁর কবিতায়ও উঠে এসেছে সঙ্ঘ জীবনাবেগের কথা, সামাজিক পরিস্থিতির অস্থিরতায় নিজ প্রেমলোকের বিপর্যয়ের আশঙ্কার কথা-

আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো 

মিলি রাতের গভীর যামে,

তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা 

পড়ছে বোমা ভিয়েতনামে। 

( প্রেমের কবিতা, নিরালোকে দিব্যরথ)

পুরাণের চরিত্রমন্থনের মধ্য দিয়ে তিনি অরক্ষিত স্বদেশের স্বরূপ উন্মোচন করেন কবিতায় :

তুমি নেই তাই বর্বরের দল করেছে দখল বাসগৃহ আমাদের। 

( টেলিমেকাস, ওই)

এসব অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান থেকেই কবি খুঁজে পান জীবনের নতুন তাৎপর্য-

জীবন মানেই 

তালে তালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিছিলে চলা, নিশান ওড়ানো অন্যায়ের প্রতিবাদে শূন্যে মুঠি তোলা। 

( ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, নিজ বাসভূমে)

আল মাহমুদ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আজীজুল হক প্রমুখের কবিতায়ও প্রেম ও সংগ্রামের দ্বৈরথ সুস্পষ্ট। যেমন-

১. তাড়িত দুঃখের মত চতুর্দিকে স্মৃতির মিছিল

রক্তাক্ত বন্দুকের মুখ উত্তেজিত হাতের টঙ্কারে

তীরের ফলার মত

নিক্ষিপ্ত ভাষায় চিৎকার

বাঙলা, বাঙলাÑ

(আল মাহমুদ, ‘নিদ্রিতা মায়ের নাম’, কালের কলস)

২. ক্লান্তির রাত্রিকে ঢাকো এ সূর্যের

প্রমত্ত আস্বাদে। সমুদ্রের

বিশাল গহবরে আনো 

প্রজ্ঞার তরঙ্গ অবিশ্রাম 

কৃষ্ণচূড়া মেঘে হোক মুখরিত

এক ঝাঁক নাম। 

( মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ‘কৃষ্ণচূড়ার মেঘ’, শঙ্কিত আলোক)

৩. এখন কেবল

শব থেকে শবের সিঁড়িতে একটি আকাঙ্ক্ষা হেঁটে যায়

জীবনের নামে, এখন সে জীবনের নাম 

স্বপ্ন আর রক্ত আর ঘাম। 

(আজীজুল হক, ‘যন্ত্রণা’, ঝিনুক মুহূর্তে সূর্যকে)

ষাটের দশকে আবির্ভূত কবিদের কবিতার জন্মমুহূর্তটিই ছিল বিচিত্র অসঙ্গতিতে পূর্ণ। সামরিক শাসনের হিংস্র থাবা সমাজমানসের অন্তর্গত শক্তিকেও যেন নিঃশেষ করে ফেলেছিল। তাঁদের অভিজ্ঞার সামনে উন্মোচিত ছিল ‘বন্দী মুহূর্ত, অলংঘ দেয়াল, অবরুদ্ধ সমাজচেতনা ও জটিলতম সমাজগঠন।’ সময়ের নির্মম সত্যকে ধারণ করার পরিবর্তে এ সময়ের কবিবৃন্দ জীবন থেকে পলায়নের শিল্পিত ব্যাকরণ সন্ধানে মনোযোগী হলেন। কিন্তু সমাজসত্তার অস্থিরতা ও রক্তপাত কবির স্বার্থপর ব্যক্তিবিশ্বকেও আলোড়িত করে তোলে। নির্মলেন্দু গ‍ুণের কবিতায় এই রক্তিম জীবনজিজ্ঞাসারই প্রতিফলন লক্ষ করি :

আগুন লেগেছে রক্তমাটির গ্লোবে

যুবক গ্রীষ্মের ফাল্গুন পলাতক

পলিমাখা চাঁদ মিছিলে চন্দ্রহার

উদ্ধত পথে উন্নত হাত ডাকে

সূর্য ভেঙেছে অশ্লীল কারাগার

প্রতীক সূর্যে ব্যাকুল অগ্নি জ্বলে

সাম্যবাদের গর্বিত কোলাহলে

আগুন লেগেছে রক্ত মাটির গ্লোবে।

(উন্নত হাত, প্রেমাংশুর রক্ত চাই)

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নজরুলের কবিতা ও গান ছিল বাঙালির অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। ঔপনিবেশিকতা, শ্রেণিশোষণ, জাতিশোষণ ও সামন্তশোষণের বিরুদ্ধে নজরুলের শিল্পিত উচ্চারণ অন্তঃশীলা প্রবাহের মতো এ সময়ের সক্রিয় কবিমনকে আন্দোলিত করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও সামান্য ব্যতিক্রম বাদে মানুষের সর্বৈব মুক্তির প্রত্যাশা অধরাই থেকে গেছে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সেনাশাসন, ধর্মীয় কুসংস্কার ও মৌলবাদের অব্যাহত শক্তিবৃদ্ধি, গণতন্ত্র ও মানবমুক্তির সাধনা বাংলাদেশের সমাজমানসকে বিচিত্রভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সুতরাং সময় ও সমাজস্বভাবের সূত্র ধরেই বাঙালি কবিকে সঙ্ঘজীবনা-

বেগের কাছে, ব্যক্তির অহংবোধের কাছে, সুষম সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের কাছে বারবার প্রত্যাবর্তন করতে হয়। এ কারণেই বাংলাদেশের সমাজমানস ও কবিচৈতন্যে নজরুলের স্বপ্ন ও কল্পলোক অবিচ্ছিন্ন সত্তার মতো প্রবাহিত ও জাগ্রত হতে থাকে।

নজরুলের দৃষ্টিতে কবিতা মানব-ঐক্য ও গণজাগরণের শিল্পমাধ্যম। সমাজের গুণগত পরিবর্তন ছিল তাঁর পরম আরাধ্য। এদেশের জনগোষ্ঠীকে অস্তিত্বের প্রশ্নে, স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। ফলে সমাজের সর্বাপেক্ষা সংবেদনশীল অংশ কবিরা গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবমুক্তির লক্ষ্যে সামূহিক জীবনচেতনাকেই কবিতার অন্যতম উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা যে ব্যক্তির বিকাশের প্রধান শর্ত, বাংলাদেশের যন্ত্রণাদগ্ধ ও সংগ্রামী চেতনাদীপ্ত কবিমানসে তা সুস্পষ্ট।

একটা অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও সর্বমানবের বাসোপযোগী রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের কবিরা গণমুখী জীবনচেতনাকেই প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সংস্কৃতির বিশ্বায়নের এই কালে পাশ্চাত্যের ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মভুক চেতনার অঙ্গীকার করেছেন অনেক কবি। কিন্তু যেখানে মানব-অস্তিত্ব প্রতিনিয়ত বিপন্ন, যে রাষ্ট্র বারবার স্বৈরতান্ত্রিক স্বভাবের দিকে বাঁক নেয়, সেখানে নজরুলের দ্রোহ, অহংবোধ ও গণমুখী জীবনচেতনার অঙ্গীকার ভিন্ন গত্যন্তর থাকে না।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা