× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও সংগ্রাম

মোঃ আবদুল হামিদ

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:২৭ পিএম

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৫৪ পিএম

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও সংগ্রাম

জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে (১৯৪১ সালে) নিজের অশীতিতম জন্মবর্ষে ‘সভ্যতার সংকট’ শীর্ষক অভিভাষণ দিতে গিয়ে বাঙালির পথিকৃৎ প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুভব করেছিলেন, তাঁর জীবনের এবং পুরো দেশের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে, মানবসভ্যতার সুবিস্তৃত দিগন্তে গভীর আশঙ্কার কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে। কিন্তু হিংসা, দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসে উন্মত্ত সেই সময়েও তিনি নিবিড় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব।’

এ ঘটনার প্রায় ৩৪ বছর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিজের জীবন উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গভীর বিশ্বাসের পুনঃপ্রকাশ ঘটান মাত্র ৫৫ বছরের চির-আপসহীন, চিরমুক্তিকামী মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি বলতেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি, আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ এ ভালোবাসার ওপর তাঁর এত বেশি আস্থা ছিল যে, পঁচাত্তরের আগে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে বারবার সতর্ক করার পরও তিনি তাঁর মধ্যে এই চিন্তাকে স্থান পেতে দেননিএ দেশের কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে, সপরিবারে বিনাশ করার অপচেষ্টা চালাতে পারে। মানুষের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের এই অমিত শক্তি বঙ্গবন্ধু কোথায় পেয়েছিলেন? পেয়েছিলেন তাঁর সংগ্রাম করার সক্ষমতা থেকে, পেয়েছিলেন মানুষকে ভালোবাসার অপরিমেয় ক্ষমতা থেকে। এই সক্ষমতা ও ক্ষমতা তাঁকে অবশেষে বঙ্গবন্ধু করে তুলেছে। করে তুলেছে একটি জাতির পিতা।

তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন এ দেশের জনগণকে বিশ্বাস করার মহাযজ্ঞে অংশ নিয়ে, নিজেকে বিশ্বস্ত করে তোলার মহাসংগ্রামে যুক্ত হয়ে। এই মহাযজ্ঞ আর মহাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি নিকটবর্তী হয়েছেন বাঙালি জাতির, নিকটবর্তী হয়েছেন এ দেশের জনগণের। পূর্ণ আস্থা রেখেছেন তিনি জনগণের ওপর, তাই জনগণও ভালোবেসেছে তাঁকে। আস্থা রেখেছেন, ভালোবেসেছেন; কিন্তু জয়যাত্রার পথে হাঁটবার স্বার্থে আত্মসমালোচনা করতেও পিছপা হননি বঙ্গবন্ধু। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেই দেখি, বাঙালি জাতির মানসিকতা সম্পর্কে নিজের ধারণাকে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি, লিখেছেন, “...পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’।... এই জন্যেই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।... নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না, ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।” এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের স্থিরলক্ষ্যটি নির্ধারণ করতে বঙ্গবন্ধু দ্বিধা করেননি, দেরি করেননি। বাঙালি যাতে নিজেকে চিনতে ও বুঝতে পারে এবং মুক্তির সংগ্রামে সম্পৃক্ত হতে পারে, সেই দুঃসাধ্য ও কষ্টকর কাজে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বিশ্বে এমন রাজনৈতিক নেতা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব, যিনি তাঁর ৫৫ বছরের জীবনে ১৪ বছরই কাটিয়েছেন কারাগারে। জনগণের মুক্তিকেই জীবনের পাথেয় করেছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল হাসিমুখে বারবার কারাগারে যাওয়া; প্রতিবার কারাগারে যাওয়ার সময় শান্তভাবে সহধর্মিণীকে বলা, ‘রেণু, ব্যাগটা গুছিয়ে দেও; ক’দিন ঘুরে আসি।’

আমার এই জীবনের বড় সৌভাগ্য, আমারও সুযোগ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সেই চলার পথের সঙ্গী হওয়ার। ১৯৬৪ সালে, ছয় দফা আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে কিশোরগঞ্জে তাঁর সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি পরিচয় ঘটে আমার। সেই থেকে যে বন্ধন গড়ে উঠেছিল, দিনে দিনে তা আরও নিবিড় হয়েছে। তাঁর সঙ্গে চলতে চলতে আমিও উজ্জীবিত ও দীক্ষিত হয়েছি স্বাধীনতার মন্ত্রে, মুক্তির মন্ত্রে। ১৯২০ সালে জন্ম নেওয়ার পর ক্ষণজন্মা এই মানুষটি প্রত্যক্ষ করেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ভয়াবহতা, দেখেছেন ঔপনিবেশিকতার বন্ধন ছিন্ন করতে পৃথিবীর দেশে দেশে গড়ে ওঠা জাতীয় মুক্তির আন্দোলন, দেখেছেন দেশে দেশে মুক্তি ও গণতন্ত্রের আন্দোলনকে প্রতিহত করতে সামরিক শাসনের থাবা; নিজের ভূখণ্ডেও তাঁকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির জন্যে যেতে হয়েছে দেশভাগের মতো মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। এসব ঋদ্ধ করেছে তাঁকে, বনস্পতির মতো দীঘল আর দিগন্তমুখী করে তুলেছে তাঁকে, একই সঙ্গে তাঁর শেকড়কে এই মৃত্তিকায় প্রোথিত করেছে গভীরভাবে। এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর যে বন্ধন, তা কোনোদিনই ছিন্ন হওয়ার নয়।

পাকিস্তান নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা থাকলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি উপলব্ধি করেন, পাকিস্তান কোনো সমাধান নয়, পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীর মুক্তি, সাম্য ও স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন, তাঁর প্রত্যাশা ছিল, “...পাকিস্তান হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী বা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান নাগরিক অধিকার থাকবে। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান আন্দোলনের যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, এখন পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার ধুয়া তুলে রাজনীতিকে তারাই বিষাক্ত করে তুলেছে। মুসলিম লীগ নেতারাও কোনো রকম অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম না দিয়ে একসঙ্গে যে শ্লোগান নিয়ে ব্যস্ত রইল, তা হলো ‘ইসলামী’।” এভাবে তাঁর প্রত্যাশার মৃত্যু ঘটেছিল। দ্বিধাহীন চিত্তে তিনি ব্রত নিয়েছিলেন স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, পাকিস্তানের নাগপাশ ছিন্ন করে একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে দিয়েই কেবল বাঙালি জাতি হিসেবে বিকশিত হতে পারে, এ অঞ্চলে বসবাসরত অন্য সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটতে পারে। তিনি সেই পথেই হেঁটেছিলেন।

স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, মানুষের প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাস স্থাপন করে এবং অগণতান্ত্রিক শক্তির হাতে জীবনদানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তিনি আর শুধু বাংলাদেশের নন, সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের পথিকৃৎ। তিনি এখন আর শুধু বঙ্গবন্ধু নন। তিনি বিশ্ববন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। বিশ্বায়নের এই যুগে কি স্বদেশে, কি বিদেশে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা এখন আরও বেশি। এ কথা এ কারণেই বলছি যে, বিশ্বায়ন যেমন পৃথিবীটিকে একটি বিশ্বগ্রামে পরিণত করেছে, তেমনি তা অবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির তাগিদে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলোর ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠেছে। আবার পুরো বিশ্বই জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে নিমজ্জিত হয়েছে, মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের বিশ্বায়িত ধারা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উৎক্রমণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতা আরও উজ্জ্বল এ কারণে যে, তাঁর সারা জীবনের কর্মযজ্ঞে আমরা দেখতে পাই একদিকে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিরলস নিয়োজিত থাকার প্রয়াস, অন্যদিকে রাষ্ট্রকে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক উপায়ে সুসংহত করার উদ্যোগ ও চেষ্টা। দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়-গোষ্ঠীর ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক উদ্যোগ ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিকাশের ওপর তিনি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। ভারত বিভক্তির কালপর্বে এবং সাতচল্লিশ-উত্তর সময়ে এই জনপদে পাকিস্তান সরকারের ইন্ধনে সংঘটিত যেসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সহিংসতা তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেসব প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে রাষ্ট্র ও জনগণকে হতে হবে অসাম্প্রদায়িক, হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। এ কারণেও তিনি এই ঝঞ্ঝামুখর বিশ্বে আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।

সাতচল্লিশ-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকায় এলেন, তখন তিনি কেবল প্রতিষ্ঠিত ছাত্রনেতা নন, মুসলিম লীগ কার্যনির্বাহী সংসদেরও সদস্য। তারপর থেকে এই ভূখণ্ডের ও জনগণের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন, যে ত্যাগ স্বীকার করেন তার কোনো তুলনা হয় না। বাংলাদেশ নামের এই স্বাধীন রাষ্ট্রটির স্থপতি হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর টানা একুশ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে অস্বীকার করা হয়েছে। তাঁর এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। সরকারি ক্ষমতা ও প্রচারযন্ত্রের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। এসব অপপ্রচারে শামিল হয়েছে ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক বিভিন্ন অপশক্তিও। এ অবস্থায়, দেশের একটি বড় অংশের ইতিহাসজ্ঞানই এখন আর সঠিক পথে নেই। এমনকি বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের একাংশও যদি এসব অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কমবেশি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবদানের বিচ্ছুরণশক্তি এতই অপরিমেয় যে, তাঁকে কখনও ছাইচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই আবারও বিসুভিয়াসের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর শক্তি ও মহিমার আগ্নেয় স্রোত। এই ঝঞ্ঝামুখর পৃথিবীতে যিনি বা যারা এখন নেতৃত্ব দিতে চান, তা যে দেশ বা যে জাতিরই হোক না কেন, বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁকে আসতেই হবে; শিক্ষা নিতে হবে তাঁর সংগ্রামশীলতা থেকে, প্রজ্ঞা ও চেতনা থেকে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা