আসিফ ইকবাল
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৩ ২১:৪৬ পিএম
আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৩৬ পিএম
ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। আমাদের প্রিয় জেমস ভাই। বাংলা রক গানের অবিসংবাদিত বীরপুরুষ। স্বাতন্ত্র্য যাঁর সহজাত। সংগীতপ্রেমী বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে যিনি সবচেয়ে অভিজাত রকস্টার হিসেবে বিবেচিত। আমার কাছে তিনি গানের একজন কালপুরুষ। যাঁর গান সময়কে জয় করে কালের পাতায় রয়ে যাবে অনন্তকাল।
ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। আমাদের প্রিয় জেমস ভাই। বাংলা রক গানের অবিসংবাদিত বীরপুরুষ। স্বাতন্ত্র্য যার সহজাত। সংগীতপ্রেমী বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে যিনি সবচেয়ে অভিজাত রকস্টার হিসেবে বিবেচিত। আমার কাছে তিনি গানের একজন কালপুরুষ। যার গান সময়কে জয় করে কালের পাতায় রয়ে যাবে অনন্তকাল।
জেমস ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় চট্টগ্রামে। তখন জেমস ভাই ফিলিংস ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট। ফিলিংস ব্যান্ডের তখনকার ব্যান্ডলিডার সৈয়দ মনসুর ভাই। তিনি কি-বোর্ড বাজান, গান সুর করেন। মোহাম্মদ আলী ভাই ছিলেন বেস গিটারিস্ট। ড্রামস বাজাতেন গুলু। আর ভোকালে ছিলেন হাসরাত ভাই। মনসুর ভাই বন্ধন শিল্পীগোষ্ঠীর গান লেখানোর জন্য আমাকে বেছে নিলে আমি প্রায়শই মনসুর ভাইয়ের বাসায় ফিলিংসের প্র্যাকটিস প্যাডে যেতাম। সেখানেই খুবই স্বল্পভাষী জেমস ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। সে পরিচয়ে জেনেছিলাম জেমস ভাই আমাদের চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক স্যারের ছেলে। স্যার আমাদের সরাসরি শিক্ষক না হলেও আমার বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা, ক্রিকেট আর রেড ক্রিসেন্ট কার্যক্রমের জন্য আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি প্র্যাকটিস প্যাডে জেমস ভাইয়ের ফ্রি হ্যান্ড বাজানো শুনেই অবাক হয়ে যেতাম। মনসুর ভাই সব সময় বলতেন, এ ছেলে বহুদূর যাবে। আমরাও জানতাম জেমস ভাই একজন অ্যাক্সেপশনাল ট্যালেন্ট। তার বাজানোর হাত ছিল যেমন মিষ্টি, তেমন এক্সপ্রেসিভ।
আমরা প্রায় একই সময় ১৯৮৭ সালের দিকে ঢাকায় চলে আসি। আমি আইবিএতে এমবিএ পড়ার জন্য চলে আসি, আর জেমস ভাই ফিলিংস ব্যান্ডের দায়িত্ব তুলে নেন নিজ হাতে, বন্ধু এহসান এলাহী ফান্টির সঙ্গে। তখন ফিলিংস ব্যান্ডের একটা অ্যালবাম প্রকাশ পায়Ñ যার দুটো গান আমাকে আন্দোলিত করে ভীষণভাবে। গান দুটো হলোÑ স্টেশন রোডের জীবনধারা, আর দুঃখ কেন করো। ব্যান্ড মিউজিকে তখন পিংক ফ্লয়েড, ডায়ার স্ট্রেইটসের জোয়ার। মেলোডির সঙ্গে পাওয়ার যোগ করা এ সময়ে বাচ্চু ভাই, জেমস ভাই আর হাসানÑ এ তিনজন তিন ডাইমেনশন নিয়ে আসছেন তাদের গানে। আমি নকিব ভাই আর বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার কিছু কিছু চেষ্টা করছি তখন।
এ সময়টায় বাংলাদেশে একটা অডিও কোম্পানি সিনেমার বাইরের সলো এবং ব্যান্ডশিল্পীদের দারুণ উৎসাহের জায়গায় পরিণত হয়। সারগাম নামের এ কোম্পানিটা ছিল পুরোনো ঢাকার ব্যবসায়ী সেন্টু ভাইয়ের। তিনি ক্যাসেটের ব্যবসা করতেন, বসতেন সম্ভবত স্টেডিয়াম মার্কেট এবং পাটুয়াটুলিতে। তার ছোট ভাই বাদল ভাই দেখতেন অ্যালবাম প্রোডাকশন সাইডটা। সারগামের একটা রেকর্ডিং স্টুডিও ছিল, বিজয়নগর মোড়ে। সেখানে রেকর্ডিস্ট ছিলেন পান্না ভাই আর দুলাল ভাই। বাদল ভাই কখন কেন যে ব্যবসা ছেড়ে প্রবাসী হলেন, সে কথা আমার জানা নেই। পান্না ভাই আর গানে থাকলেন না। দুলাল ভাই কোথায়?Ñ আমার জানা নেই। সারগামও ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে বহুদিন।
সারগামে গেলেই সব নামিদামি এবং সম্ভাবনাময় শিল্পীদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। সোলস, রেনেসাঁ, এলআরবি, ফিলিংস, ফিডব্যাক, মাইলস, কুমার বিশ্বজিত, তপন চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, নিলয়দা, বেবি নাজনিন, সামিনা চৌধুরী, সাবা তানি, মাকসুদ জামিল মিন্টু ভাই, লাকি আখান্দ ভাই, মানাম ভাই, ইমন, শেখ ইশতিয়াক সবাইকেই পাওয়া যেত সেখানে। একদিকে একটা টিম রেকর্ডিং করলে, অন্য টিম পরের শিফটের জন্য তৈরি হচ্ছে। গান নিয়ে আড্ডার এক দারুণ জায়গা আর পরিবেশ ছিল এই সারগাম। এখানেই নতুন গান শোনা হতো, এখানেই গান-বাজনা সংক্রান্ত একজনের প্রয়োজন অন্যজন মেটাত। সে সময় প্রতিযোগিতা ছিল ঠিকই, সহযোগিতা ছিল তারচে বহুগুণ বেশি। নিয়মিত যাওয়া-আসার কারণে এমনই এক সময় বাদল ভাই, ফান্টি আর জেমস ভাইয়ের সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারই সূত্র ধরে বাদল ভাই আর জেমস ভাই তার প্রথম সলো অ্যালবামের গান লেখার জন্য আমাকে বলেন। তখন পর্যন্ত বিভিন্ন অ্যালবামে আমি একটা-দুটো করে গান করছি, একটা সলো অ্যালবামের পুরো কাজ রীতিমতো স্বপ্নের মতো। আমি জানি না, জেমস ভাই কেন আমাকে বেছে নিয়েছিলেন। সে প্রশ্ন তাকে বহুবার করলেও তিনি সুকৌশলে তার সহজাত খেয়ালিপনায় উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেছেন।
আমার বাঁকবদলের সেই একক অ্যালবামটি ছিল অনন্যা। আমার একমাত্র কাজ জেমস ভাইয়ের সঙ্গে। এ কাজে আমি সম্পৃক্ত হবÑ এ উত্তেজনায় আমি অনেক রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। নিজের সর্বোচ্চ উজাড় করে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে আমি যখন তৈরি, তখন ঠিক হলো আমরা নিয়মিত বসব জেমস ভাইয়ের ইস্কাটনের বাসায়। জেমস ভাইয়ের বাবা, প্রফেসর মোজাম্মেল স্যার তখন ঢাকায় বদলি হয়ে সম্ভবত ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান। সে সরকারি বাসার সামনের রুমটাই ছিল জেমস ভাইয়ের। সেখানেই প্রতিদিন আইবিএ ক্লাস শেষে আমি আসতাম গান নিয়ে বসতে। ফান্টিও থাকত। আহা কি একটা সময় ছিল তখন!
আমাদের প্রথম কাজ রিকশাওয়ালা। এরশাদবিরোধী আন্দোলন, হরতাল তখন রাজনীতির তুমুল ভাষা। তার প্রভাব কীভাবে নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদের কষ্টের কারণ হচ্ছে তাই নিয়ে এ গান। গানগুলো নানাভাবে হতো। বিষয় ঠিক করে আমি লিখতাম, জেমস ভাই সুর করতেন। সুরের প্রয়োজনে কোথাও কথায় পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তা আমি সঙ্গে সঙ্গে করতাম। বিষয়-বৈচিত্র্য আনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা জেমস ভাই আমাকে দিয়েছিলেন। আবার বাদল ভাইয়ের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আমাদের কিছু ইংরেজি গানের বাংলা ভার্সন করতে হয়। এর কারণ ছিল আশিকউজ্জামান টুলু ভাইয়ের কপিয়ার ১ ও ২ তখন তুমুল হিট। ইংরেজি গানের বাংলা ভার্সন করার সময়ও জেমস ভাই আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন বিষয় নির্বাচন আর নিজের এক্সপ্রেসনে লিখতে। ফলে কোনো গানই লেখায় হুবহু অনুকরণ হয়নি, বরং বিষয়-বৈচিত্র্যে, শব্দচয়ন এবং লেখার ঢঙে পেয়েছে ভিন্নতা। অনন্যা, ওই দূর পাহাড়ে, রংবাজ, তুমি জান এমনই গান। রিকশাওয়ালা, ফেরারি অনন্ত, রাতের ট্রেন, পলাতক চাঁদ অথবা টেলিফোন ছিল কথায় সুরে আমাদেরই গান। এর মধ্যে কিছু গান জেমস ভাই আগে এক লাইন এক লাইন করে সুর করেছেন আমি কথা বসিয়েছি, আর কিছু গান কথার ওপরেই সুর হয়েছে।
জেমস ভাইয়ের আম্মা, আমাদের খালাম্মা ছিলেন একজন স্নেহময়ী মা। খুবই আদর করতেন জেমস ভাইকে। সে সুবাদে আমাদেরও চা-নাশতা, দুপুরের খাওয়া, আদর আপ্যায়ন কোনো কিছুরই কমতি ছিল না জেমস ভাইয়ের বাসায়।
অনন্যার পর জেমস আর পিছু ফিরে তাকাননি, শুধু সামনেই এগিয়ে গিয়েছেন। ‘পালাবে কোথায়?’ (১৯৯৫), ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’ (১৯৯৭), ‘ঠিক আছে বন্ধু’ (১৯৯৯)-এর মতো হিট অ্যালবাম দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে জেমস ভাই তার সলো ক্যারিয়ারও এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
তিনি বলিউডের চারটি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকও করে আমাদের গর্বিত করেছেন। গ্যাংস্টার (২০০৬), ওহ লামহে (২০০৬), লাইফ ইন এ... মেট্রো (২০০৭), ওয়ার্নিং (২০১৩)-এ গানগুলো আমাদেরও গর্বিত করেছে।
বাংলাদেশে হার্ড রকসংগীত বিকাশ ও জনপ্রিয় করার জন্য তার অবদান চিরভাস্মর হয়ে থাকবে। তার ব্যান্ড ফিলিংসকে বাংলাদেশের সাইকেডেলিক রক-এর প্রবর্তক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অসংখ্য শ্রোতা-ভক্তের কাছে জেমস একজন নগর বাউল, গুরু।
আজ এত বছর পার হলো, কেন জানি চেষ্টা করেও আর জেমস ভাইয়ের সঙ্গে কাজ হয়ে ওঠেনি। কেন হয়ে ওঠেনি, সেটা জেমস ভাই-ই ভালো বলতে পারবেন।