× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

এক বহুমাত্রিক, বহুবর্ণিল মানুষ

আহমাদ মোস্তফা কামাল

প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৩ ২২:০১ পিএম

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৩৮ পিএম

এক বহুমাত্রিক, বহুবর্ণিল মানুষ

১৯৭৮ সালে যখন এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়, তখন আমার ধারণা, তিনি নিজেও ভাবেননি এটি এমন বিরাট এবং প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে। হয়ে উঠেছে সম্ভবত এই কারণে যে, যে-ধরনের কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এগিয়ে চলেছে, সে-ধরনের কাজ আর কোনো প্রতিষ্ঠান কখনও করেনি। এমনকি এ রকম কাজ যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করা যায়, সে-কথাও কেউ ভাবেননি।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু-তিনবার কথা হয় আমার। অধিকাংশই কাজের কথা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অনেক অসমাপ্ত কাজ নিয়ে আলাপ। আশি-পেরোনো বয়সে একজন মানুষ কীভাবে সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ভাবতে পারেন কিংবা নিজেকে সারাক্ষণই কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পারেন, বুঝতে পারি না। তাঁর অভিধানে অবসর এবং আলস্য শব্দ দুটোর অস্তিত্বই নেই বোধহয়। এবং এই বিরামহীন কাজের প্রায় পুরোটা জুড়ে আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। সম্ভবত সে জন্যই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রায় সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছে। এক জনকে মনে পড়লে অন্য জনকেও মনে পড়ে যায়। অথচ ১৯৭৮ সালে যখন এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়, তখন আমার ধারণা, তিনি নিজেও ভাবেননি এটি এমন বিরাট এবং প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে। হয়ে উঠেছে সম্ভবত এই কারণে যে, যে-ধরনের কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এগিয়ে চলেছে, সে-ধরনের কাজ আর কোনো প্রতিষ্ঠান কখনও করেনি। এমনকি এ রকম কাজ যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করা যায়, সে-কথাও কেউ ভাবেননি। 

একজন মানুষ সারা জীবন ধরে একটা বইবিমুখ জাতিকে বই পড়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে গেলেন। কেবল বলেই থামলেন না, তারা যেন বই পড়তে পারে সেজন্য নানা ধরনের কর্মসূচি প্রণয়ন করলেন। যেহেতু এ-ধরনের কাজ তাঁর আগে-পরে আর কেউ করেননি, তাই তাঁকে যেতে হলো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য একরকম, কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য আরেক রকম, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আবার ভিন্নরকম কর্মসূচি। এত কাজ করতে গেলে কিছু ভুলত্রুটি হয়ই, কিন্তু সবগুলো কাজই যে ইউনিক, সেটি অস্বীকার করা যায় না। এ-প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। একটা সময় ছিল যখন পাঠ্যবইয়ের বাইরে যেকোনো বইকে বলা হতো ‘আউট বই’ এবং এ-ধরনের বই পড়াকে অভিভাবকরা প্রায় অপরাধ বলে গণ্য করতেন। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। অভিভাবকরা আর সেই বইগুলোকে অপাঠ্য বলে মনে করেন না, অনেক অভিভাবকই চান তাদের সন্তানরা বই পড়ুক। শুধু তাই নয়, বাচ্চারা বই পড়লে অভিভাবকরা আনন্দিত হন। ভাবেন যে, যাক, আমার বাচ্চাটা ঠিক পথেই আছে। দৃষ্টিভঙ্গির এই যে আমূল পরিবর্তন, আমি মনে করি, এতে সায়ীদ স্যারের অবিরাম চেষ্টার দারুণ প্রভাব আছে।

২. এই যে দেখুন, আমি নিজেও সায়ীদ স্যারের কথা বলতে গিয়ে কেবল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আর বই পড়া এবং পড়ানো নিয়েই বলতে শুরু করেছি। হ্যাঁ, ওগুলো নিয়েও বলতে হবে, নইলে তো বলাটাই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে, কিন্তু তাঁকে নিয়ে আসলে আরও অনেক কথাই বলার আছে। তাঁর কর্মমুখর জীবনের শুরু বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিয়ে নয়, যৌবনের প্রারম্ভে তিনি নিজেকে যুক্ত করে নিয়েছিলেন সাহিত্যের সঙ্গে। সেটি গত শতকের ষাট দশকের শুরুর দিকের কথা। না, কেবল সাহিত্যচর্চার সঙ্গে নয়, সাহিত্য-আন্দোলন এবং সাহিত্য-সংগঠনের সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত করে নিয়েছিলেন তিনি। নিজে তো লিখতেনই, লেখাতেন অন্যদের দিয়েও। সাহিত্যের প্রশ্নে তাঁর নিজস্ব একটা মানদণ্ড ছিল, সেই মানের নিচে তিনি নিজে তো নামতে চাইতেনই না, তাঁর সহযাত্রীরা কেউ নামুক তাও চাইতেন না। কিন্তু মানদণ্ড অক্ষুণ্ন রেখে নিজেদের কথা বলার জন্য অন্য কারও ওপর তো ভরসা করা চলে না, দরকার হয় নিজস্ব মুখপাত্র। আর সেই তাগিদ থেকেই জন্ম ‘কণ্ঠস্বর’-এর। কণ্ঠস্বর কেবল একটি পত্রিকাই নয়, একটি আন্দোলনও। সাহিত্য থেকে পুরোনো ধ্যান-ধারণা-সংস্কার-মূল্যবোধ ঝেঁটিয়ে বিদায় করে আধুনিক এবং নতুন ধরনের সাহিত্য উপহার দিতে চেয়েছিলেন তিনি এবং তাঁর কণ্ঠস্বর। সে জন্যই কণ্ঠস্বর-এ সবার লেখা ছাপা হতো না, হতো নির্বাচিত তরুণ লেখকদের লেখা। আমরা দেখেছি, সেই নির্বাচিতরাই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন। 

কণ্ঠস্বর-এর মাধ্যমেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সংগঠক সত্তার আবির্ভাব ঘটে। একটি পত্রিকা করা তো সহজ ব্যাপার নয়। কেবল মনের মতো লেখা জোগাড় করা বা সেগুলোর যথাযথ সম্পাদনাই নয়, পত্রিকা প্রকাশের জন্য টাকাও তো লাগে। তিনি এমন কিছু ধনাঢ্য মানুষও ছিলেন না যে, নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে নিয়মিত একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে পারবেন। সে-সময় দেশে বিজ্ঞাপনের বাজারও অত রমরমা ছিল না; আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে বিজ্ঞাপন ব্যাপারটাই দুর্লভ ছিল। তা ছাড়া কণ্ঠস্বর-এর চরিত্রের সঙ্গে বিজ্ঞাপন ব্যাপারটা ঠিক যায়ও না। আবার পত্রিকা কেবল ছাপিয়ে বসে থাকলেই হয় না, পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার দায়ও থাকে। এসব কাজ একজন সৃজনশীল লেখকের চরিত্রের সঙ্গে মানানসই নয়। তবু তিনি সবকিছুকেই সম্ভবপর করে তুলেছিলেন তাঁর ওই সংগঠক সত্তার কারণে। সেই সাহিত্য-উন্মাদনার রূপরসগন্ধময় অসামান্য বর্ণনা পাওয়া যাবে তাঁর স্মৃতিগদ্য ‘ভালোবাসার সাম্পান’-এ। পড়ে দেখতে পারেন, প্রিয় পাঠক। আপনার দারুণ এক পাঠ-অভিজ্ঞতা হবে। 

অন্যদিকে তাঁর ভেতরে এক শিক্ষক সত্তা কার্যকরভাবে ক্রিয়াশীল ছিল, যদিও তার প্রকাশ ঘটে আরও পরে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছিলেন, কলেজ-শিক্ষক হিসেবে। তাঁর ভাষায়, ‘একদিন, তরুণ বয়সে, স্বপ্নতাড়িতের মতন এসে যোগ দিয়েছিলাম শিক্ষকতায়। প্রতিটা শিরা-ধমনিকে সেদিন যা কামড়ে ধরেছিল তা এক উদ্ধাররহিত স্বপ্ন-সমৃদ্ধ মানুষ গড়ে তোলায় অংশ নেবার স্বপ্ন- সেইসব মানুষ যারা একদিন জাতির জীবনে পালাবদল ঘটাবে।’ আর এই স্বপ্নকে তিনি সম্ভবত নিজের অজান্তেই বহন করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর শিক্ষক পিতার কাছ থেকে। তিরিশ বছরের শিক্ষক-জীবনের সেইসব ‘গল্প’ তিনি বলেছেন তাঁর ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’ বইতে, দারুণ এক প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে। কিন্তু নিষ্ফলা কেন? তাঁর মতো স্বনামধন্য কীর্তিমান শিক্ষক তো সচরাচর দেখা যায় না, তবু নিষ্ফলা? হ্যাঁ, কারণ শিক্ষকতাকে তিনি কেবল একটি পেশা হিসেবে নেননি, তাঁর ছিল সমৃদ্ধ-সম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলবার সংকল্প। কিন্তু তিরিশ বছর ধরে তিনি কেবল দেখেছেন ক্ষয় এবং অবক্ষয়, দেখেছেন পতন এবং অধঃপতন- জাতীয় জীবনে তো বটেই, শিক্ষাঙ্গনের ভেতরে আরও বেশি। দেখেছেন অস্ত্র, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, পরীক্ষায় নকলের উৎসব, কোন্দল, সংঘর্ষ, এমনকি খুনোখুনিও। আসলে শিক্ষাঙ্গন এবং সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তো একে অপরের পরিপূরক, এক জায়গায় অধঃপতন দেখা দিলে অন্য জায়গায়ও তার প্রতিফলন ঘটে। অথচ এসব দেখেশুনেও কিছুই করার ছিল না তাঁর। গ্লানিতে, আত্মপীড়নে জর্জরিত হয়ে অবশেষে চাকরির সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই ছেড়ে এসেছিলেন তিনি তাঁর প্রিয় শিক্ষাঙ্গন। 

অবশ্য ছেড়ে আসার আরও একটি কারণ ছিল। তিনি লিখেছেন, ‘একটা সময় এসেছিল যখন চারপাশের পরিবেশ এতটাই বৈরী হয়ে উঠেছিল যে হতাশার সঙ্গে মনে হয়েছিল এই শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর শিক্ষক হিসেবে সত্যি সত্যি আমার দেবার কিছু নেই। এই ব্যাপারটাই আমার হৃদয় ভেঙে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল এর চেয়ে অন্যভাবে সময় দেয়া, অন্য পথে কিছু করা- দেশের ভেতর উচ্চায়ত মানুষ গড়ে তোলার ব্যাপারটাকে অন্যভাবে সহায়তা করা বরং ভালো। হৃদয়ের ভেতর ভেঙে গিয়ে মনে হয়েছিল : যাদের মানুষ হিসেবে বড় করে গড়ে তুলব বলে একদিন সব ছেড়ে শিক্ষকতার জগতে এসে দাঁড়িয়েছিলাম তারা নিজেরাই তো আজ এর বিরুদ্ধে। সারা দেশ এর বিরুদ্ধে। কেউ তো আজ আর সত্যিকার মানুষ হতে চাচ্ছে না। বড় স্বপ্ন, বড় মূল্যবোধসম্পন্ন হৃদয়বান আর সমৃদ্ধ মানুষ! সবাই তো বৈষয়িক ভবিষ্যৎ আর চাকরিবাকরির হীন কুঠুরিতে নিজেকে সীমিত করে ফেলতে চাইছে। আমি, আমার মতো গুটিকয় মানুষ তো এ-সমাজে আজ নিঃসঙ্গ, অবাঞ্ছিত, বিরক্তিকর। একা একা আমি এই বৈরী জগতের বিরুদ্ধে কী করতে পারব? কতটুকু পারব? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরেই যখন আজ পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত, তখন শিক্ষার পুনরুজ্জীবনের কথা যদি ভাবতেই হয় তবে এর বাইরে গিয়েই তা ভাবতে হবে, এখানে থেকে নয়।’

আর, ‘দেশের ভেতর উচ্চায়ত মানুষ গড়ে তোলার’ জন্য ‘অন্যভাবে সময় দেয়া, অন্য পথে কিছু করা’র জন্যই তিনি নিজেকে পুরোপুরিভাবে নিয়োগ করলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিবিধ কর্মকাণ্ডে। শিক্ষকতা ছেড়ে আসার বছর-পনেরো আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, কার্যক্রমও শুরু হয়ে গিয়েছিল, তবে তাঁকে সার্বক্ষণিকভাবে পেয়ে এর গতি বেড়ে গেল বহুগুণে। একবার তিনি বলেছিলেন, কেন্দ্রের কর্মসূচিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, এর প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর জন্য তিনি এদেশের প্রতিটি জেলা এবং উপজেলায় গিয়েছেন, অধিকাংশ স্কুল এবং কলেজে গিয়েছেন, কথা বলেছেন, শিক্ষার্থীদের বই পড়ার মতো একটি ‘অলাভজনক’ বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহ দিয়েছেন। যেন এক নিয়তি-তাড়িত, আবেগ-তাড়িত, স্বপ্ন-তাড়িত বাতিওয়ালা, ঘরে ঘরে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছুটে চলেছেন বিরামহীন। আমরা তো জানিই, জগতের সকল মহৎ কর্মই গভীর কোনো বেদনাবোধ থেকে উৎসারিত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক হিসেবে তাঁর যে দুঃখবোধ, গ্লানিবোধ আর গভীর বেদনা; সেটিই তাঁকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই বিপুল কর্মকাণ্ডে নিজেকে সার্বক্ষণিকভাবে সম্পৃক্ত করতে বাধ্য করেছে।

৩. তা, কী করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র? আপনারা অনেকেই যেহেতু জানেন, তাই বিস্তারিত বলব না, আসুন একনজরে একটু দেখে নেওয়া যাক। কেন্দ্রের প্রধান কর্মসূচিগুলো হলো : দেশ-ভিত্তিক উৎকর্ষ (বইপড়া ও সাংস্কৃতিক) কার্যক্রম, দেশ-ভিত্তিক ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কার্যক্রম, পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি, পিটিআই শিক্ষকের জন্য বইপড়া কার্যক্রম, দেশ-ভিত্তিক পাঠচক্র কার্যক্রম, আলোর ইশকুল, চলচ্চিত্র প্রদর্শন, শ্রবণ-দর্শন কার্যক্রম, প্রকাশনা কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বাংলাভাষার চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহ ও প্রকাশনা কার্যক্রম ইত্যাদি। এবার কতগুলো সংখ্যা বলি। প্রথম কর্মসূচিটির বিস্তার দেশের সব জেলার ১৪ হাজারটি স্কুল-কলেজ। প্রতিবছর কয়েক লাখ ছাত্র-ছাত্রী এই কর্মসূচির আওতায় বই পড়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। আরেকটি কর্মসূচি হলো ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। বইকে পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই কর্মসূচির আওতায় আছে বই-ভরতি ৭৬টি বড় গাড়ি (বাস), যেখানে বইয়ের সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক আর তিন লক্ষাধিক পাঠক সেখান থেকে বই বাসায়/বাড়িতে নিয়ে যান পড়ার জন্য। বড় শহরে তো বটেই, তিনশটি উপজেলায়ও এই কার্যক্রম বিস্তৃত, প্রায় তিন হাজার স্পটে লাইব্রেরিগুলো গিয়ে দাঁড়ায়। ধোঁয়া, ধুলা, নোংরা-আবর্জনা আর যানজটে নাকাল নগরবাসীর সামনে দিয়ে বই-ভরতি একটি গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে, এ যে কী নান্দনিক দৃশ্য তা বলে বোঝানো যাবে না। শুধু ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিও নয়, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিটিও দারুণ সমৃদ্ধ। প্রায় চার লাখ বই আছে এই লাইব্রেরিতে। পাঠকরা সেখানে বসে বই পড়তেও পারেন, আবার বাসায়ও নিয়ে যেতে পারেন। ঢাকায় (এমনকি পুরো দেশেই) আর কোনো লাইব্রেরিই বোধহয় বই নিয়ে বাসায় যাওয়ার অনুমোদন দেয় না। প্রকাশনায়ও পিছিয়ে নেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। মানসম্পন্ন, সুসম্পাদিত পাঁচ শতাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে সেখান থেকে, যার অধিকাংশই চিরায়ত ধারার বই। আবার ‘বাংলাভাষার চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহ ও প্রকাশনা কার্যক্রম’-এর আওতায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে প্রায় তিনশ খণ্ডের বিশাল এক সংগ্রহ, যেখানে ধরা থাকবে বাঙালির বিবিধ চিন্তার সংগ্রহ ও সারৎসার। 

লেখাটি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিয়ে নয়, বিস্তারিত বর্ণনা তাই দিলাম না। কিন্তু এই সামান্য বর্ণনা থেকে কি বোঝা যাচ্ছে না যে, বই নিয়ে এ রকম বিপুল কর্মযজ্ঞের দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ এদেশে নেই? কেবল এদেশের কথাই বা বলি কেন, কোন দেশই বা এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কথা ভেবেছে? তাও কাজটি চলছে এমন এক জাতির মধ্যে যার সাধারণ পরিচিতি ‘পাঠবিমুখ জাতি’ হিসেবে! কীভাবে সম্ভব হলো এই অসম্ভব কাজটি করা? বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকার বদলে কিংবা স্বভাবজাত বাঁকা হাসি হেসে এড়িয়ে যাওয়ার বদলে কীভাবে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ যুক্ত হলো এই কার্যক্রমে? সে কি কেবল ‘নতুন কিছুর’ প্রতি স্বাভাবিক কৌতূহলের জন্য? বাঙালির স্বভাবজাত হুজুগে স্বভাবের কারণে? কৌতূহল বা হুজুগ তো আর ৪৫ বছর ধরে টিকে থাকে না, তাহলে কারণটি কী? প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা যাক এভাবে : একটি সমাজে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয় এবং সেটি বেঁচে থাকে তখনই যখন ওই সমাজে ওই সময়ে ওই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তা থাকে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠানের যে প্রয়োজন ছিল এদেশে- সে-কথা এখন অনস্বীকার্য; এর বিপুল কার্যক্রমের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা দেখেই সেটি বোঝা যাচ্ছে। এবং সেটি আমরা বুঝতে পারছি প্রতিষ্ঠানটি জন্ম নিয়ে এতদিন পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে বেঁচে আছে বলেই, কিন্তু জন্মের আগেই কীভাবে বুঝে নেওয়া যায় যে, এ রকম একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আছে এই সমাজে, এই সময়ে? না, সবাই সেটি বোঝেন না, কেউ কেউ বোঝেন। কেউ কেউ থাকেন এমন যিনি জাতির নাড়ির স্পন্দন বোঝেন, বোঝেন হৃদয়স্পন্দনও। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তেমনই একজন মানুষ। বুঝেছিলেন বলেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন এ-জাতির তরুণ প্রজন্মটিকে, তাদের ভেতরে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন পাঠ-তৃষ্ণা, এবং তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বইকে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাদের হাতের নাগালে। তরুণদের বেছে নেওয়ার পেছনে যে কারণটি ছিল, সেটি বলা হয়েছে এভাবে : ‘অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আত্মদানের ভেতর দিয়ে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। এখন চলছে তার নির্মাণের পর্ব। এই নির্মাণকে সত্যিকারভাবে অর্থময় করার জন্যে আজ এদেশে চাই অনেক সম্পন্ন মানুষ- সেইসব মানুষ যারা উচ্চ-মূল্যবোধসম্পন্ন, আলোকিত, উদার, শক্তিমান ও কার্যকর। যারা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে শক্তিমান নেতৃত্ব দিয়ে এই জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। তাদের আজ পেতে হবে বিপুল সংখ্যায়- সারা দেশে, সবখানে। কেবল এককে দশকে নয়, সহস্রে লক্ষে। আর কেবল সংখ্যায় পেলেই চলবে না, তাদের পেতে হবে একত্রিত ও সমবেতভাবে। তাদের গ্রথিত করতে হবে শক্তিশালী সংঘবদ্ধতায়, উত্থান ঘটাতে হবে জাতীয় শক্তি হিসেবে। সারা দেশের সবখানে এইসব আলোকিত মানুষ গড়ে তোলার পরিবেশ সৃষ্টি করা, জাতীয় শক্তি হিসেবে তাদের সংঘবদ্ধ করা এবং এর পাশাপাশি জাতীয় চিত্তের সামগ্রিক আলোকায়ন ঘটানো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য।’ 

৪. এত বিপুল পরিশ্রম আর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁর লেখক-জীবন হয়তো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে কলম একেবারে থেমে থাকেনি। প্রকাশিত হয়েছে তিরিশেরও অধিক বই। লিখেছেন প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, স্মৃতিগদ্য, ভ্রমণগদ্য, জার্নাল ইত্যাদি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তাঁর প্রথম মৌলিক বই প্রকাশিত হয় সম্ভবত ১৯৯৩ সালে (অবশ্য তাঁর সম্পাদনায় ‘সাম্প্রতিক ধারার গল্প’ এবং ‘সাম্প্রতিক ধারার প্রবন্ধ’ বেরিয়েছিল সেই ষাটের দশকেই)। মানে লেখালেখি শুরু করার প্রায় তিন যুগ পর! না, আলস্য নয়, কাজের ব্যাপারে তিনি কখনোই অলস নন, তবে সাংগঠনিক কাজের চাপ তো ছিলই, তার চেয়ে বেশি দায়ী তাঁর খুঁতখুঁতে স্বভাব। লেখার ব্যাপারে যেমন, তেমনি সম্পাদনার ব্যাপারেও তিনি দারুণ খুঁতখুঁতে। লেখার আগে তিনি প্রতিটি শব্দের ওজন মেপে দেখেন বোধহয়, তাঁর লেখা পড়তে গেলে সে রকমই মনে হয়। আবার নিজের লেখার নিজেই সম্পাদক তিনি, এবং সেখানে তিনি অতিশয় নির্মম। নিজের কোনো অসতর্কতা বা সামান্য ভুলকেও তিনি ক্ষমা করেন না। সে জন্যই বই প্রকাশের এত ধীরগতি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কতগুলো বইয়ের কথা বলা যাক। প্রবন্ধ-বিদায় অবন্তী, সংগঠন ও বাঙালি, গণতন্ত্র ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, উত্তর প্রজন্ম, বন্ধ দরজায় ধাক্কা, দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, নিউইয়র্কের আড্ডায়; স্মৃতিগদ্য- নিষ্ফলা মাঠের কৃষক, ভালোবাসার সাম্পান, বহে জলবতী ধারা, আমার উপস্থাপক জীবন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি; গল্প- রোদনরূপসী, খরযৌবনের বন্দী; কবিতা- মৃত্যুময় চিরহরিৎ; ভ্রমণগদ্য- ওড়াউড়ির দিন, জার্নাল- বিস্রস্ত জার্নাল প্রভৃতি। তাঁর গদ্য স্বাদু, প্রাঞ্জল এবং প্রসাদগুণসম্পন্ন। প্রিয় পাঠক, আমার কথায় বিশ্বাস করার দরকার নেই, যেকোনো একটি বই পড়ে দেখুন, নিজেই প্রমাণ পাবেন। 

তিনি বিপুল পরিমাণ কাজ করেন, লেখেনও অনেক, অজস্র অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন এবং প্রচুর কথা বলেন। সব সময়ই তাঁর চারপাশে মানুষের ভিড় দেখা যায়। সৃজনশীল মানুষরা নিঃসঙ্গতাকে ভালোবাসেন, নির্জনতা পছন্দ করেন, মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি যেন এর বিপরীতে অবস্থান করেন। কেন এত মানুষের ভিড় তাঁর চারপাশে? তিনি লিখেছেন, ‘ছেলেবেলা থেকেই একটা ব্যাপারে আমি খুব অসহায়। নিঃসঙ্গতা জিনিসটা আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। একা হলেই আমি কবরের শীতল অনুভূতিতে রুগ্‌ণ হয়ে উঠি। এইজন্য মানুষের মুখ না-দেখলে আমি বাঁচি না। প্রতিমুহূর্তে আমি আমার চারপাশে মানুষের প্রাণবন্ত ও আনন্দময় মুখ দেখতে চাই- সে মানুষ সুখী, দুঃখী, উৎফুল্ল, বীভৎস, ভয়ংকর বা আবিল যা-ই হোক না কেন। তাদের সুখ, দুঃখ, রূঢ়তা, মহত্ত্ব, আনন্দ-বেদনার সঙ্গী হয়ে আমি বাঁচতে চাই। এজন্য সারা জীবন আমি আমার চারপাশে কেবলই মানুষ খুঁজে বেড়িয়েছি। মানুষ সজীব, মুখর কলকণ্ঠ। বন্ধুবান্ধবের আসর, সভা-সমিতি, শিক্ষকতা, টেলিভিশনের পর্দা, এমনকি লেখাÑ সবখানে ঐ মানুষকে স্পর্শ করার দিকে এগিয়ে গেছি। এইজন্য কথা- প্রাণবন্ত আনন্দময় কথা এত বেশি করে দরকার হয়েছে আমার সারা জীবন। দরকার হয়েছে ঐ মানুষদের প্রমোদপূর্ণভাবে আমার চারপাশে জড়ো করে রাখার দরকারে। নিজের আনন্দমুখরভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে।’ এবং ‘চারপাশের জড়ো হওয়া মানুষদের কথার আনন্দে প্রাণবন্ত আর মুখর করে রাখাকে আমি আজীবন আমার ধর্মীয় দায়িত্ব বলে মনে করে এসেছি, জগতের প্রতি আমার কর্তব্য বলে ভেবেছি। এর মধ্যে জীবনের ও বেঁচে থাকার অর্থময়তা খুঁজতে চেয়েছি।’ 

লেখার মতোই তাঁর বক্তৃতাও অত্যন্ত সরস এবং শ্রুতিমধুর। গল্প বলার এক সহজাত ক্ষমতা আছে তাঁর। তাঁর বক্তৃতার ভেতরে গল্প থাকবেই আর গল্পের ছলেই তিনি বলে দেবেন গূঢ় কথাটি, পৌঁছে দেবেন সেই বার্তাটি শ্রোতার হৃদয়ে, যা তিনি পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। ওই একই কথা যদি তিনি প্রবন্ধের ঢঙে বলতেন, গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে, তাহলেও বলা হতো ঠিকই, শ্রোতার কানেও পৌঁছাত, কিন্তু হৃদয়ে প্রবেশ করত কি না তার নিশ্চয়তা নেই। 

ব্যক্তিজীবনে তিনি উদার, সহিষ্ণু, প্রাণবন্ত, আন্তরিক। তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে বিভিন্ন সময় কঠিন তর্ক হয়েছে আমার। তাঁর সঙ্গে আমি কোনো বিষয়ে কেন একমত পোষণ করি না, কোন কাজগুলোর কী ধরনের সীমাবদ্ধতা আমার চোখে পড়েছে তা স্পষ্ট ভাষায় বলেছি। তিনি মন দিয়ে সেই কঠোর সমালোচনাগুলো শুনেছেন, সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছেন। এদেশে বড় মানুষদের সঙ্গে তো কথাই বলা 

যায় না, সমালোচনা তাঁরা নিতেই পারেন না, কিন্তু তাঁর সঙ্গে অবলীলায় দ্বিমত পোষণ করা যায়, তর্ক করা যায়, ভুলত্রুটি-সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলা যায়, তাতে তাঁর দরজা কখনোই বন্ধ হয় না। পরমুহূর্তেই তিনি মেতে ওঠেন তুমুল আড্ডায়। প্রার্থনা করি তাঁর এই কর্মচঞ্চল, আড্ডামুখর, প্রাণবন্ত, আনন্দময় জীবন দীর্ঘায়িত হোক।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা