জামাল আহমেদ
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৩ ২২:৫২ পিএম
আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৪০ পিএম
শাহাবুদ্দিন আহমেদ ভাই এখন দেশের পথিকৃৎ, অনন্য শিল্পী। দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও পরিব্যাপ্ত তাঁর চিত্রকলা। প্যারিসপ্রবাসী হলেও তাঁর শিল্পধারা গভীরভাবে প্রোথিত এ দেশের মাটিতে। কেন তিনি অনন্য হয়ে উঠেছেন? তিনি অনন্য তাঁর চিত্ররেখায় দুর্দমনীয় শক্তি ও অপ্রতিরোধ্য গতিময়তার কারণে। আর এই অভিব্যক্তি তিনি আত্মস্থ করেছেন একদিকে শিল্পের প্রতি গভীর প্যাসনের কারণে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অর্জিত ইস্পাতদৃঢ়তা, অপ্রতিহত গতিময়তা ও একাগ্রতার কারণে।
ছেলেবেলা থেকেই আমি শিল্পী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের ভক্ত। আমার শিল্পীজীবনের অনেকটা জুড়েই তিনি সরব তুমুলভাবে। তিনি যখন ক্লাস টেনে পড়তেন আমি তখন গভ. ল্যাবরেটরি স্কুলে ক্লাস ফাইভে। তিনি অবশ্য ল্যাবরেটরিতে পড়তেন না, পড়তেন ফরিদউদ্দিন হাইস্কুলে। ছোটবেলায় একসঙ্গে ছবি আঁকায় আমাদের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠেছিল। সে সময়ে চারুকলার ভেতরে একটা আর্ট স্কুল ছিল, জয়নুল আর্ট স্কুল। ওখানে আমি নিয়মিত আর্ট শিখতাম আরও অনেক বালকের সঙ্গে। ওখানে একদিন দেখি যে, শাহাবুদ্দিন ভাই ছবি আঁকছেন। তিনি তখনও এসএসসি পরীক্ষা দেননি, দেবেন। তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার জানাশোনা। তিনি কলাবাগানে থাকতেন, আমি এলিফ্যান্ট রোডে। কলাবাগান থেকে চারুকলায় যাওয়ার পথে তিনি নিয়ে যেতেন আমাকে। কলাবাগান তো তখন কাছেই বলা যায়। বাঁকাপথে হাঁটা দিলে দুই-তিন মিনিটের পথ। এখন তো আর সে অবস্থা নেই।
সেই শাহাবুদ্দিন আহমেদ ভাই এখন দেশের পথিকৃৎ, অনন্য শিল্পী। দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও পরিব্যাপ্ত তাঁর চিত্রকলা। প্যারিসপ্রবাসী হলেও তাঁর শিল্পধারা গভীরভাবে প্রোথিত এ দেশের মাটিতে। কেন তিনি অনন্য হয়ে উঠেছেন? তিনি অনন্য তাঁর চিত্ররেখায় দুর্দমনীয় শক্তি ও অপ্রতিরোধ্য গতিময়তার কারণে। আর এই অভিব্যক্তি তিনি আত্মস্থ করেছেন একদিকে শিল্পের প্রতি গভীর প্যাসনের কারণে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অর্জিত ইস্পাতদৃঢ়তা, অপ্রতিহত গতিময়তা ও একাগ্রতার কারণে। শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের জন্ম ঢাকাতেই। যদিও পৈতৃক নিবাস নরসিংদীর রায়পুরার সেই আগলী গ্রামে। বিমূর্ত শিল্প নয়, বরং স্বকীয় এক শিল্পশৈলীর প্রকাশ ঘটেছে তাঁর শিল্পসমূহে। অপার বিস্ময় নিয়ে দেখি, পরবর্তী প্রজন্মের তো বটেই, নিজের প্রজন্মের শিল্পীদের কাজ আর চিন্তাধারাকেও প্রভাবিত করেছেন তিনি। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ অনন্য মাত্রা পেয়েছে তাঁর চিত্রকলায়। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি নিবিড় মগ্নতায় পৌঁছে দিয়ে সংযুক্ত করেছেন বিশ্ব শিল্পকলার ইতিহাসে। বৃহৎ বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের সন্ধান তিনি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর মধ্যে; তাই বঙ্গবন্ধু যেমন তাঁর সকল প্রেরণার উৎস, তেমনি তাঁর শিল্পকর্মেরও অন্যতম উপজীব্য। ক্রূর ঘাতকের নির্মম আঘাতে শহীদ, সিঁড়িতে পড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর যে শিল্পকর্ম তিনি সৃজন করেছেন, তা আমাদের রাঙিয়ে তোলে শালপ্রাংশু এক মানবের বিশালতা, উদারতা ও সরলতার রঙে; একই সঙ্গে করে বেদনাবিধুর, গভীর এক ক্রন্দনের ঢেউ বয়ে যায় আমাদের হৃদয়ে। শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের ছবির মধ্য দিয়ে কেবল এক শিল্পীর নয়, পুরো বাঙালি জাতিরই হৃদয়-মনন উঠে এসেছে।
১৯৭৪ সালের দিকে শাহাবুদ্দিন ভাই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত মানুষদের অর্থ সাহায্যের জন্য ঢাকায় চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে চিত্রপ্রদর্শনী করলেন। কারণ তিনি কেবল শিল্পের প্রতিই দায়বদ্ধ নন, মানুষের প্রতিও দায়বদ্ধ। পরে ওই একই বছর ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি প্যারিসে চলে যান। আমাদের দেখা-সাক্ষাৎও একদম কমে যায়। আমি খানিকটা একাও হয়ে গেলাম। কারণ বলা যায়, আমি তাঁর একটা ন্যাওটা ছিলাম। তাঁর সঙ্গে চারুকলায় যেতাম, তাঁর মতো করে আঁকার চেষ্টা করতাম। তাঁর কতটুকু মনে আছে জানি না, তবে এসব কিন্তু আমার জীবনের উজ্জ্বল স্মৃতি। আমার এখনও মনে আছে, শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের বাসায় যেতাম, উনি আমাকে নিজের আঁকা ছবি দেখাতেন। তাদের বাসা থেকে ফিরতে ফিরতে ছবি আঁকার উৎসাহ জাগত। শাহাবুদ্দিন ভাই বিদেশ থেকে তেমন আসতেন না। আবার বিদেশ থেকে কখনও এলেও তেমন দেখাও হতো না। আমি মিস করতাম। ছেলেবেলা থেকেই তাকে ঘিরে আমার মধ্যে এক ধরনের জেলাসি ছিল; জেলাসি- তবে পজিটিভ জেলাসি আরকি। ওই যে তাঁর মতো আঁকব, তাঁর মতো অনেক নাম করব, ভাবনাটা তখন এমন ছিল আরকি। তাকে গুরু মানতাম। ভার্সিটিতে এসেও শাহাবুদ্দিন ভাইকে ফলো করতাম খুব। তখনও আবেদিন স্যার আমাদের মধ্যে আছেন। স্যারের মতোও ছবি আঁকার চেষ্টা করতাম তখন। অনেক ছবি এঁকেছি ওই সময়। এভাবে আমার নিজের শিল্পচর্চার সঙ্গেও আবেদিন স্যার আর শাহাবুদ্দিন ভাই নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। আমি তাঁর কাজ থেকে প্রভাবিত। ব্যাপারটাকে এভাবে বলা যায়, শাহাবুদ্দিন ভাই ঘোড়া আঁকেন, সুনীলও আঁকেন। তাঁরটা আবার সুন্দর ঘোড়া। আর শাহাবুদ্দিন ভাই বা আমি যেটা আঁকি সেটা হলো শক্তি-পাওয়ার। ঘোড়া দৌড়াচ্ছে কিংবা একটা মোশন আছে। এ রকম করতে চাই। বিষয়টা ঠিক এমন।
এখনও শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের আঁকা ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। অনেকে বলেন, তাঁর কাজে রিপিটেশন বেশি। আমি অবশ্য তেমনটা বলব না। মানুষ তো রিপিটেশনের কাজগুলোও চায়। তা ছাড়া তাঁর সিরিয়াস কাজও তো দেখছি আমরা। অনেক অনেক সিরিয়াস কাজ আছে তাঁর। গড়পড়তা একটা কথা বলে দিলেই তো আর সেটাকে মূল্যায়ন বলা যায় না। আগে তো তাঁর সব কাজ দেখতে হবে, কাজের ধারাবাহিকতাটাকে বুঝতে হবে, বুঝতে হবে কোনখানে তিনি নতুন কোন দিকে, অন্য কোন দিকে মোড় নিয়েছেন। তা হলেই না একটা মূল্যায়নের জায়গা-জমিন দেখা দেবে। একটা কাজ দিয়ে তো শিল্পকর্মের সার্বিক বিচার করা যায় না।
শিল্পী শাহাবুদ্দিনের কাছে এ দেশ নানাভাবে ঋণী, শিল্পীরাও ঋণী। আমিও নানাভাবে ঋণী। আমি যখন জাপানে গেলাম তখন শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা ও জাপানি শিক্ষার সঙ্গে নিজের স্টাইল মিলিয়ে একটা নতুন টেকনিক পেয়ে গেলাম। যেমন যারা বেশি জলরঙ করেন, তারা বেশ পাতলা রঙের বা বেশি ওয়াশ দিয়ে কাজ করেন। কিন্তু তেলরঙে তো ওয়াশ দিয়ে কাজ করা মুশকিল। এত তারপিন আর লিনসিড অয়েল পাওয়া মুশকিল। এমন সময় ১৯৮৫ সালে প্রথম দেখলাম অ্যাক্রেলিক কালার। দেখলাম এতে তো শুধু পানি হলেই হয়। আমি প্রথম বাংলাদেশে এই কালার নিয়ে আসি। এখন তো সবাই-ই অ্যাক্রেলিক ব্যবহার করেন, তখন বাংলাদেশে এটা কেউ চিনতেন না। আবিষ্কার হয়েছে ১৯৪৩ সালে, ঘরের কালার হিসেবে। ১৯৫৫ সালে কিছু আর্টিস্ট এটা নিয়ে শুরু করলেন ছবি আঁকা। তারপর আস্তে আস্তে বিভিন্ন দেশের আর্টিস্টরাও ব্যবহার করতে লাগলেন। সবাই তো এটিকে পেইন্টিংয়ের মতো করে ব্যবহার করেন। যেভাবে অয়েল কালার করেন, রঙ লাগিয়ে লাগিয়ে পেস্ট করেন, সেভাবে অ্যাক্রেলিককেও ব্যবহার করেন। আমি এটা ওয়াটার কালারের মতো করে করলাম। ওয়াটার কালার যেভাবে করে, সেভাবে ওয়াশ দিয়ে অ্যাক্রেলিক দিয়ে করলাম। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, ওয়াটার কালার দিয়ে করেছি। এখানেও কিন্তু শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের অবদান রয়েছে।
চারু ও কারুকলায় অবদানের জন্য শাহাবুদ্দিন আহমেদ নানা পুরস্কার পেয়েছেন; কিন্তু তাঁর চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, এখনও তিনি শিল্পে নিবেদিত, তাঁর শিল্প এদেশের মাটি-মানুষের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত। বাংলাদেশের শিল্পকলার সঙ্গে তাঁর এ যোগ কখনও ছিন্ন হবে না, তিনি আর এদেশের শিল্পকলা সংযুক্ত অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে।