নাজমুল আবেদিন ফাহিম
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩ ০০:০০ এএম
আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:২৭ পিএম
আমি মনে করি, মিরাজ চাপের মধ্যে ভালো খেলে। ধারণা করি, ভবিষ্যতে টেস্ট ও ওয়ানডেতে সে ৬ নম্বর পজিশনে ব্যাটিং করবে। মিরাজকে দেখতে শক্তিশালী মনে না হলেও সে বড় শট খেলতে পারে। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংয়েও নতুনত্ব এসেছে তার।
২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকে ৫ উইকেট নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু তার; তখন বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। অভিষেক সিরিজে দুটি টেস্ট ম্যাচ খেলে ছেলেটা। সেই সিরিজে মোট ১৯টি উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়। তার আশ্চর্যজনক পারফরম্যান্স বাংলাদেশকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে প্রথম জয় এনে দিতে সাহায্য করে। অসাধারণ বোলিং পারফরম্যান্সের জন্য ম্যান অব দ্য সিরিজ নির্বাচিত হয় সে। এতক্ষণে হয়তো অনেকে বুঝতে পেরেছেন কার কথা বলছি। সে বাংলাদেশ ক্রিকেটে অপার সম্ভাবনাময় একজন মেহেদী হাসান মিরাজ।
২০১৪ ও ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করা ক্রিকেটার মেহেদী হাসান মিরাজ। ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বেই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। চার বছর পরই যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। যুব দলের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে জাতীয় দলের দরজা সহজেই খুলে যায়।
২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করা মিরাজ কি পেরেছে প্রত্যাশা মেটাতে? ২০২২ সালের আগে হয়তো এ প্রশ্ন নিয়ে বলা যেত অনেক কথা। কিন্তু ২০২২-এর মিরাজকে নিয়ে শঙ্কা তো নেই বরং সে নিজেকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়।
মিরাজকে নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটভক্তদের প্রত্যাশা থাকে প্রতি ম্যাচেই। কারণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্যারিয়ার শুরুর আগে যারা ভীষণ সম্ভাবনা নিয়ে জাতীয় দলে এসেছে, তাদের মধ্যে মিরাজ অন্যতম। এখন বলাই যায়, সেই আস্থার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছে মিরাজ।
খুলনার কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমির কোচ মো. আল মাহমুদের হাত ধরেই মিরাজের আজকের এই উত্থান। সেই একাডেমিতে একবার বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৪ বাছাইয়ের জন্য গিয়েছিল বিসিবি। তাদের নজরে এসে জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৪ দলে সুযোগ পায় মিরাজ। এরপর মিরাজকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এভাবে অনূর্ধ্ব-১৫, ১৬, ১৭ থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যন্ত সব দলেই অপরিহার্য হয়ে ওঠে মিরাজ। আর ক্রিকেটে তার বাকিটা সময় সে তো এক ইতিহাস।
ব্যক্তিগতভাবে তাকে দেখছি যখন থেকে সে বয়সভিত্তিক খেলা শুরু করল। তখন আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার ছিলাম। সেই সূত্রে মিরাজকে কাছ থেকে দেখা।
বয়সভিত্তিক দলে খেলার সময় ছিল অলরাউন্ডার। কিন্তু জাতীয় দলে এসে তাকে পুরোদস্তুর বোলার হিসেবে খেলানো হয়। কিছু ট্যাকটিকাল কারণে এখন তার ব্যাটিং পজিশন ৬ নম্বরে। আমি মিরাজকে যতটুকু দেখেছি, সে একজন ভালো ব্যাটসম্যানের সব গুণই তার মধ্যে আছে। অনেক সময় দেখেছি বিপদের সময় অনূর্ধ্ব ১৯ দলে ৬ নম্বরে খেলতে নেমে দলকে উদ্ধার করতে। ব্যাট হাতে দিনের পর দিন বিপদ থেকে দলকে বাঁচানোর সেই অভিজ্ঞতা তখনই মিরাজের মধ্যে তৈরি হয়েছে। জাতীয় দলে তার মূল কাজটি যেহেতু বোলিং হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে, ফলে ব্যাটিংয়ে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে তার।
বিগত কিছুদিন থেকে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। সে কিন্তু ব্যাটিংয়েও বেশ ভালো অবদান রাখছে। এর আগেও হয়তো রাখত তবে সেটার মধ্যে ছিল ধারাবাহিকতার অভাব। তখন দেখতাম সে হঠাৎ একটা বড় ইনিংস খেলছে। তবে অনেক দায়িত্ব নিয়ে যে খেলছে তা কিন্তু নয়। তবে বর্তমানে মিরাজ দায়িত্ব নিয়েই বড় ইনিংস খেলছে, ধারাবাহিকতাও বজায় রাখছে। এখন তার মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে ব্যাটিংটা সে করতে পারে।
মিরাজ টেস্ট এবং ওয়ানডেতে নিয়মিত পারফরম্যান্স করলেও টি-টোয়েন্টিতে ধারাবাহিক নয়। ২০১৮ সালের শেষ দিকে টি-টোয়েন্টি দল থেকে তাকে বাদ পড়তে হয়। তবে ওয়ানডে এবং টেস্ট থেকে তাকে কখনও বাদ পড়তে হয়নি। কেননা এ দুটো ফরম্যাটে সে সবচেয়ে ধারাবাহিক। বিপিএলে ভালো পারফরম্যান্সের সুবাদে ২০২২ সালে সে আবারও টি-টোয়েন্টি দলে ফিরে আসে। আর ফিরে এসেই ভালো পারফরম্যান্স করেছে। এমন ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে প্রতিটি ফরম্যাটেই সে নিয়মিত মুখ হয়ে উঠবে আশা করি।
২০২২ সাল মিরাজের জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট। কেননা এ বছর আমরা মিরাজকে নতুনভাবে চিনেছি। সে নিজেকে একজন পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং সব বিভাগেই মিরাজ যেন একটা কমপ্লিট প্যাকেজ।
সর্বশেষ ভারত সিরিজে মিরাজ ছিল অতুলনীয়। প্রথম ওয়ানডেতে ৮ নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে নেমে তার একক প্রচেষ্টায় প্রায় হারতে বসা ম্যাচ ছিনিয়ে এনেছে ভারতের কাছ থেকে। একটা সময় ছিল যখন পজিশন নিয়ে অনেক ঝামেলা হতো তার। কিন্তু সেই মিরাজ দেখিয়েছে পজিশন এখন তার কাছে কোনো ব্যাপারই না। আর দ্বিতীয় ওয়ানডেতে তো মিরাজ সেঞ্চুরিই করে বসে।
২০২২ সালের ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের পুরস্কারও সে শেষে পেয়েছে। সদ্য শেষ হওয়া বছরটিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি উইকেট পাওয়া খেলোয়াড় মিরাজ। রানও করেছে বেশ কয়েকটি ম্যাচে। ব্যাটিং ও বোলিং মিলিয়ে মিরাজ এখন দলেও অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার।
আমি মনে করি, মিরাজ চাপের মধ্যে ভালো খেলে। ধারণা করি, ভবিষ্যতে টেস্ট ও ওয়ানডেতে সে ৬ নম্বর পজিশনে ব্যাটিং করবে। মিরাজকে দেখতে শক্তিশালী মনে না হলেও সে বড় শট খেলতে পারে। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংয়েও নতুনত্ব এসেছে তার। আমাদের দেশের অনেক খেলোয়াড়ের নিজের সামর্থ্যের ওপর ধারণা নেই। সেখানে মিরাজ নিজেকে নতুন করে চিনছে ও তার সক্ষমতার প্রমাণ রাখছে।
খেলাধুলায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো, খেলোয়াড়কে বুঝতে হবে সে কত বড় মাপের পারফরমার। নিজের সম্পর্কে না জানলে তার পক্ষে বড় পারফরম্যান্স করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তার স্বপ্ন-লক্ষ্য তখন ছোট হয়। যে মুহূর্তে নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে বুঝতে পারবে, তখনই সে লক্ষ্য স্থির করতে পারে। আমার মনে হয়, মিরাজের মধ্যে ক্রমাগত সেই পরিবর্তন হচ্ছে; যা তাকে আরও বেশি পরিশীলিত ও পরিপক্ব করছে দিন দিন।
একটা বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে, বয়সভিত্তিক দলের অধিনায়ক ছিল বলে যে তাকে বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক হতে হবে তা কিন্তু নয়। এ ধরনের অধিনায়ক যখন একটা দলের মধ্যে থাকে তখন দল তার দ্বারা উপকৃত হয়।
ভবিষ্যতের যোগ্য অধিনায়ক তথা ভালো মানের একজন খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে সে গড়ে তুলছে। তার নানান গুণের বিচারে তাকে আগামীর জন্য একজন যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তার আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য বোর্ড তাকে নানা ধরনের কাজে সম্পৃক্ত করতে পারে। নেতা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাকে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্ত করতে পারে। ক্রিকেট দলের মানবিক কাজগুলোয় সে অংশগ্রহণ করতে পারে; যা তাকে একজন যোগ্য নেতা হিসেবে তৈরি হতে সহায়তা করবে।
বর্তমানে মিরাজ যেভাবে পারফর্ম করছে, এটা তাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে সে নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করতে পারবে। এমনকি বাংলাদেশের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকেও একটা সময় ছাড়িয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ মিরাজ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি বলেও মনে করা হয়। তার জেগে ওঠা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিরাজের ব্যাট ও বল যদি হাসে তবেই হাসবে বাংলাদেশ। আমরা আশা রাখতেই পারি আরও পরিণত ও একজন নেতা হিসেবে মিরাজকে দেখার।