× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গবেষণায় অনন্য সেঁজুতি

আহমাদ শামীম

প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩ ০০:৩৮ এএম

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:২৯ পিএম

গবেষণায় অনন্য সেঁজুতি

বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট বিশ্বের ১০ বিজ্ঞানীর নাম প্রকাশ করেছে, সেখানে আছে সেঁজুতি সাহার নাম। তাকে নিয়ে ল্যানসেটের লেখাতেই উঠে এসেছে কথাগুলো। সেখানে বলা হয়েছে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য গবেষণা নিয়ে সমতার পক্ষে এক জোরদার কণ্ঠস্বর সেঁজুতি।

বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীর পথচলায় থাকে হাজারো বাধা। এই বাধা উতরে অনেকে এগিয়ে যান; প্রতিভা, নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের ওপর ভর করে হয়ে ওঠেন অনন্য উদাহরণ। পাশাপাশি যদি পরিবারের সহায়তা থাকে, তবে তা হয় সোনায় সোহাগা। যেমনটা ঘটেছে বাংলাদেশি অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহার ক্ষেত্রে।

অতিসম্প্রতি বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট বিশ্বের ১০ বিজ্ঞানীর নাম প্রকাশ করেছে, সেখানে আছে সেঁজুতি সাহার নাম। তাকে নিয়ে ল্যানসেটের লেখাতেই উঠে এসেছে কথাগুলো। সেখানে বলা হয়েছেÑ ‘বৈশ্বিক স্বাস্থ্য গবেষণা নিয়ে সমতার পক্ষে এক জোরদার কণ্ঠস্বর সেঁজুতি। সে এবং সিএইচআরএফে তার দল মিলে জীবাণুর জিন নকশা উন্মোচন কিংবা ভাইরাসের গবেষণায় রত থাকেন। বাংলাদেশের শিশুদের আক্রান্ত করে এমন কিছু রোগ, যেমন ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া নিয়ে তাদের গবেষণা অব্যাহত আছে।’

বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিংও করেন সেঁজুতি সাহার দল। অবাক করার মতো তথ্য হলো, সেঁজুতি সাহা একজন ক্যানসার সারভাইভার। থাইরয়েড ক্যানসার থেকে বেঁচে ফিরে তিনি কাজ করছেন সাধারণের জীবন বাঁচানোর জন্য। 

গবেষক বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় নিজের প্রতিভা আর পরিশ্রমের কল্যাণে সেঁজুতি সাহা বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের তালিকায় নিজের নাম তুলতে সক্ষম হয়েছেন। যার মাধ্যমে উজ্জ্বল করেছেন বাংলাদেশের নামও। একই সঙ্গে তিনি হয়ে উঠেছেন হাজারো নারীর অনুপ্রেরণা। সেঁজুতি সাহার বাবা বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ অণুজীববিজ্ঞানী ড. সমীর সাহা। তার মা গণস্বাস্থ্যের গবেষক ড. সেতারুন্নাহার। গুণী বাবা-মায়ের সন্তানও বড় হয়েছেন তাদেরই পথ ধরে ।

অণুজীববিজ্ঞানে আগ্রহের সূচনা বাবা-মায়ের কারণেই। শৈশব থেকেই বাবা-মায়ের ল্যাবে সময় কাটাতেন সেঁজুতি। বাবা সমীর সাহা মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক। বৈজ্ঞানিক বক্তৃতার অনুশীলনের জন্য কিংবা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের নানা চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতেন রাতের খাবারের টেবিলে। ল্যাবে কাটানো সময় এবং বাবার কথাগুলো সেঁজুতিকে যে অণুজীববিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে তা বলাই বাহুল্য। বাবার কাছ থেকে সেঁজুতি শিখেছেন কীভাবে জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা মানুষের স্বার্থেই আবার কাজে লাগানো যায়। আর মা শেখাতেন নিজের জ্ঞানকে কীভাবে ন্যায়ের পথে ব্যবহার করতে হয়। স্কুলে থাকাকালীন বাবা-মায়ের সহযোগিতা নিয়ে বিজ্ঞানমেলায় রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার প্রজেক্ট বানিয়ে জিতে নিয়েছিলেন প্রথম পুরস্কার। বিজ্ঞানের সঙ্গে সেঁজুতির পথচলা শৈশব থেকেই। 

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণায় আমাদের অর্জন কম নয়; কিন্তু লিঙ্গসমতার দিক থেকে চিন্তা করলে এ বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাঙালি নারী জাগরণের পুরোধা বলা হয় যাকে, সেই বেগম রোকেয়ার ‘অর্ধাঙ্গী’ শিরোনামের রচনায় নারীদের শিক্ষা বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন- ‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন।’ বর্তমানে আমাদের বিজ্ঞান ও গবেষণার জগতে নারীর পদচারণা অতটা সীমিত না হলেও তা উল্লেখ করবার মতো কোনো সংখ্যাও নয়। তবুও এদের মধ্যে অনেকে নিজেকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়; যেমনটা করেছেন সেঁজুতি সাহা। বাবা-মা তার অনুপ্রেরণা হলেও তারাই কিন্তু সেঁজুতিকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন বিজ্ঞানের পথে পথ চলতে। বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিক ও অনগ্রসরমাণ একটি দেশে বিজ্ঞানচর্চায় যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন দুজনে, তারা চাননি তাদের মেয়েও এমন সমস্যায় পড়ুক। তারা চেয়েছিলেন সেঁজুতি অর্থনীতি নিয়ে পড়বে। কিন্তু নিজের জেদেই সেঁজুতি বিজ্ঞান নিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত সফলও হয়েছেন। এ লেভেলের পর সেঁজুতির চাওয়া ছিল বাইরে যাবেন উচ্চশিক্ষার জন্য। বাবা-মা প্রথমে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত মেনে নেন। কিন্তু আত্মীয়স্বজনের চাপে সেটাও ভেস্তে যেতে বসে। কানাডার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে সাড়া পান প্রতিটি থেকেই। শেষ পর্যন্ত টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রি বিষয় নেন। পরের বছর একটি মলিকিউলার জেনেটিকস রিসার্চ ল্যাবে খণ্ডকালীন কাজে যোগ দেন। ২০০৯ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়েই মলিকিউলার জেনেটিকসে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হন সেঁজুতি। তার পিএইচডি গবষণার বিষয় ছিল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স।

২০১৬ সালে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুহার কমাতে গবেষণার জন্য দেশে ফিরে বাবার প্রতিষ্ঠিত চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে (সিএইচআরএফ) যোগ দেন। এখানে এসে তিনি জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে কাজ শুরু করে দেন। ২০১৮ সালে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা ফাউন্ডেশন সেঁজুতির জন্য জিনোম সিকোয়েন্স মেশিন পাঠায়। কাজে আসে গতি, গঠন করেন গবেষণা দল। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উন্নয়নশীল দেশের গবেষক প্রতিনিধি হিসেবে বিল গেটসের সঙ্গে জাতিসংঘের অধিবেশনে বক্তব্য রাখার সুযোগ মেলে। 

সেঁজুতি সাহার অন্যতম প্রধান সাফল্য কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার। ২০২০ সালের মার্চ মাসে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তখন থেকেই সেঁজুতি ও তার গবেষক দল কোভিড ১৯-এর জিনোম সিকোয়েন্সের কাজ শুরু করেন। তখন ব্যক্তিগত কাজে ইংল্যান্ডে যান সেঁজুতি। কিন্তু সেখানে গিয়ে আর দেশে ফিরতে পারেননি। লকডাউনের কারণে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় দেশটিতে। কিন্তু শৈশবে যে জেদ নিয়ে বিজ্ঞানের পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন, সেই জেদের বশবর্তী হয়ে লন্ডনে বসে সেখান থেকেই গবেষক দলকে দিয়ে যেতে থাকেন নানা নির্দেশনা। এভাবে একই বছরের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সেঁজুতি সাহা ও তার আট সদস্যের গবেষক দল বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স বা জিনের নকশা উন্মোচন করেন। তাদের এই আবিষ্কার বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। এমন চিন্তা থেকে গবেষণার ফলাফল উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। যাতে যে কেউ চাইলেই এখান থেকে তথ্য নিয়ে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে কাজ করতে পারেন।

সেঁজুতির গবেষণার মূল বিষয়বস্তু বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোয় নবজাতক এবং শিশুদের মৃত্যুকে প্রভাবিত করে এমন রহস্যঘেরা অসুস্থতা নির্ণয়ের সহজ উপায় খুঁজে বের করা। সেঁজুতি তার কাজে সফল হলে বাঁচবে বিশ্বের লাখো শিশুর জীবন। 

এ ছাড়াও সেঁজুতির বাবা অণুজীববিজ্ঞানী ড. সমীর সাহা প্রতিষ্ঠিত চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ) শিশুরোগ বিষয়ক যে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করছে। তাদের এই কাজ নতুন ভ্যাকসিন তৈরিতেও ব্যবহার হচ্ছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা