× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সিনেমার পালে হাওয়া দেওয়া কারিগর

লিমন আহমেদ

প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩ ০১:৩৯ এএম

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৩৪ পিএম

সিনেমার পালে হাওয়া দেওয়া কারিগর

বাস্তব জীবনকে উপজীব্য করে উপভোগ্য, বার্তাবহুল, শ্রুতিমধুর গান, নিটোল এক গল্প ও নির্মাণের মুন্সিয়ানায় নিখুঁত এক সিনেমা ‘হাওয়া’ বানিয়ে একটা মডেল তিনি সিনেমার মানুষদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। নতুন বছরে ইন্ডাস্ট্রি সচল রাখতে সবাই তাই আরেকটা ‘হাওয়া’র স্বপ্ন দেখছেন, ‘হাওয়া’য় উৎসাহিত হচ্ছেন। 

গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছের দিন এই বঙ্গ মুলুকে অনেক আগেই ফুরিয়েছে। হারিয়ে গেছে দর্শক ভরা সিনেমা হলেরও দিন। বিগত কয়েক বছর ধরে কোনোমতে সিনেমা মুক্তির সংখ্যায় হাফ সেঞ্চুরিটা হচ্ছে কোনোমতে। কিন্তু সাফল্যের হিসেবে বলার মতো সিনেমা খুঁজতে গেলে হতাশা ছাড়া আর কিছুই মিলছে না। প্রায় প্রতি বছরই দু-একটি সিনেমা খানিক ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছে, আলোচিত হয়েছে; ইন্ডাস্ট্রির সুনামটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছে বলা যায়। তবে মোটা দাগে ব্যবসায়িকভাবে সফল সিনেমার সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ করে ২০২০ সালে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর সিনেমার অবস্থা একেবারেই নাজুক ছিল। যেমন কমেছে সিনেমার নির্মাণ তেমনি কমেছে দর্শক ও প্রেক্ষাগৃহে প্রত্যাশা। নানা সংকটে যখন অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জ সিনেমাপাড়ায় চোখ রাঙাচ্ছিল তখনই মেজবাউর রহমান সুমন যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হয়ে এলেন। তাকে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের বিখ্যাত সেই বাণী দিয়েও পরিচিত করানো যায়। এলেন, দেখলেন ও জয় করলেন। সুমন সিনেমা নির্মাণে এলেন, সিনেমা নির্মাণ করলেন এবং জয় করলেন দর্শক ও সিনেমাজগতের সবার হৃদয়।

ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমা ‘হাওয়া’র বন্দনা এখন সর্বত্র। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ‘হাওয়া’য় ভেসেছে বিদেশের দর্শকও। ইউরোপ-আমেরিকার থিয়েটারগুলোতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ হাউজফুল চলেছে এ সিনেমা। যা বাংলাদেশি সিনেমার জন্য বিশেষ প্রাপ্তির। অনেক বিদেশি ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে থিয়েটার কাঁপিয়েছে ‘হাওয়া’। অনেক বিদেশি দর্শক অর্থ না বুঝেই শরীর দুলিয়েছেন ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গান গাইতে গাইতে। দেশে বিদেশে নানা উৎসব, প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে সিনেমাটি। অনেকদিন পর কোনো প্রযোজক সিনেমায় লগ্নি করা টাকা ফেরত পেলেন। মোটা অঙ্কের মুনাফাও ঘরে তুললেন। সুমন তাই এ সময়ের সিনেমায় লক্ষ্মী এক কারিগরের নাম, সুমন তাই সফল এক স্বপ্নজয়ী নির্মাতার নাম। তাকে সময়ের নায়ক বলাই যায়। সিনেমার এই সময়টাকে তিনি একদমই নিজের করে নিতে পেরেছেন। স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে, মেজবাউর রহমান সুমন একটা পথ তৈরি করতে পেরেছেন যে পথে হাঁটলে সফল হওয়া যায়। বাস্তব জীবনকে উপজীব্য করে উপভোগ্য, বার্তাবহুল, শ্রুতিমধুর গান, নিটোল এক গল্প ও নির্মাণের মুন্সিয়ানায় নিখুঁত এক সিনেমা ‘হাওয়া’ বানিয়ে একটা মডেল তিনি সিনেমার মানুষদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। নতুন বছরে ইন্ডাস্ট্রি সচল রাখতে সবাই তাই আরেকটা ‘হাওয়া’র স্বপ্ন দেখছেন, ‘হাওয়া’য় উৎসাহিত হচ্ছেন। 

বর্ণাঢ্য সংগ্রামী অতীত ছাড়া সাধারণত সাফল্যের গল্পে নায়ক হতে পারেন না কেউ। পৃথিবীতে যারা নিজেদের বিকশিত করতে পেরেছেন, যারা নিজের নামকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন দেশ-জাতির কাছে প্রায় সবারই সংগ্রামী অতীত বড় সমৃদ্ধ। সেখানে আনন্দ-উদযাপনের পরিমাণ কম। দিনের পর দিন স্বপ্ন জিইয়ে রাখার ধৈর্য, নানা ঘাত-প্রতিঘাত সেই অতীতের পরতে পরতে মিশে থাকে। সময়ের নায়ক হিসেবে মেজবাউর রহমান সুমনকে দেখতে গেলেও চোখ রাখতে হবে তেমনই একটি বর্ণিল অতীতে। সুমনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। মেধাবী ছাত্র। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। মূলত শিক্ষাকালীন পরিবেশই আজকের সুমনের গড়ে ওঠা। গানপ্রিয় সুমন সংগীতের সঙ্গে জড়িয়েছেন বহু আগে থেকে। যেখানেই গানের আড্ডা সুমন ছুটেছেন। গান শুনতে শুনতে গান বেঁধেছেন আপন মনে। গান তিনি লিখেছেন, সুর করেছেন, গেয়েছেন। গানের দলও করেছেন। ‘মেঘদল’নামে একটি ব্যান্ডের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন। টুকটাক অভিনয়ও করেছেন। 

একটা সময় লিখতে শুরু করেন। নাটক ও বিজ্ঞাপনের চিত্রনাট্য লেখায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মেজবাউর রহমান সুমনের নাম। নিজে নির্মাণে আসেন। বহু হিট-সুপারহিট বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছেন তিনি। অনন্ত জলিলের মুখে জনপ্রিয় সংলাপ ‘অসম্ভবকে সম্ভব করাই অনন্ত জলিলের কাজ’- এটি ছিল সুমনেরই নির্মিত বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে হাত পাকিয়ে আসেন টিভি নাটক নির্মাণে। ২০০৫ সালে নাটক নির্মাণ করেন সুমন। প্রথম নাটক ‘আমি অরুপার কাছে যাচ্ছি’। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা বেকার শফির জীবনে প্রেমিকা অরুপার কাছে শান্তি খুঁজে পায়। দুজনেই ঠিক করে বিয়ে করবেন, সেই উদ্দ্যশ্যেই শফি বেরোলেন, কিন্তু ঘটনা পরিক্রমায় আর যাওয়া হয় না, ওইদিকে অরুপা অপেক্ষা করছে। এই নিয়ে নাটক ‘আমি অরুপার কাছে যাচ্ছি’। অভিনয় করেছিলেন শোয়েব ও কুসুম শিকদার। নাটকটি সে সময় বেশ আলোচনায় আসে। দুই বাংলার নন্দিত অভিনেত্রী জয়া আহসানের ক্যারিয়ারে মেজবাউর রহমান সুমন নামটি বেশ উল্লেখযোগ্য। নাট্যাঙ্গনে জয়া আহসানের আলোচিত কাজ ‘তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে’। আঙুরলতা নামে এক পতিতার গল্প উঠে এসেছিল এই টেলিফিল্মে। বিমল করের উপন্যাস অনুপ্রেরণায় তিনি এটি নির্মাণ করেছিলেন, প্রচারের পর থেকেই নাটকটি প্রশংসায় ভাসতে থাকে। জয়ার সহশিল্পী হিসেবে প্রথমবারের মতো অভিনয় করেন নির্মাতা অনিমেষ আইচ। এ ছাড়া সুমন উপহার দিয়েছেন ‘কফি হাউজ’, ‘ধুলোমেঘের জোৎস্না ভ্রমণ’, ‘ফেরার কোনো পথ নেই, থাকে না কোনো কালে’, ‘নুসরাত, সঙ্গে একটি গল্প’, ‘তারপর পারুলের দিন’, ‘দখিনের জানালা খোলা, আলো আসে আলো যায়’, ‘শহরতলীর আলো’ নামের দর্শকপ্রিয় সব নাটক-টেলিছবি। সুমন নাটক নির্মাণ করতে গিয়ে নিজস্বতার ছাপ রাখতে পেরেছেন। তার নাটকের নামগুলো শুনেই দর্শক সেগুলো দেখার আগ্রহ পেতেন। 

তুমুল জনপ্রিয়তা ও চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সুমন নাটক নির্মাণ বন্ধ করে দেন ২০১০ সালের দিকে। এই নাটক বানানোর ব্যাপারটাও ছিল চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশল আয়ত্ত করার একটা উপায়। ‘হাওয়া’ সিনেমা মুক্তির পর গণমাধ্যমের এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ সময় ধরে যেন সিনেমারই প্রস্তুতি নিলেন। মেধার সঙ্গে ধৈর্য ধরে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি, সততা, পরিচালক হিসেবে সৃষ্টিশীল এবং কারিগরি দক্ষতা ও পরিশ্রমের যোগ্য সমন্বয় হলে সাফল্য যে আসে তারই প্রমাণ সুমন রেখেছেন ‘হাওয়া’দিয়ে। তাই চঞ্চল চৌধুরী, শরিফুল রাজ, নাজিফা তুষি, নাসিরউদ্দিন খানদের মতো তারকা থাকার পরও ‘হাওয়া’র সাফল্য নিয়ে আলোচনায় প্রশংসায় এগিয়ে থাকেন পরিচালক সুমন। ছবিটির জন্য ‘সাদা সাদা কালা কালা’ শিরোনামের গানটিকে বাছাই করে দূরদর্শিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। এই উপমহাদেশের সিনেমায় গান খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তা সেই সিনেমা যে ধারারই হোক, যে প্রথারই হোক। সুমনও তার সিনেমায় গান দেখিয়েছেন। দর্শক সেই গান পর্দায় দেখে বিনোদিত হয়েছেন। শ্রোতারা সেই গান শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। হাশিম মাহমুদের কথা ও সুরে সহজ ভাষার শ্রুতিমধুর গানটি রাতারাতি ছড়িয়ে যায় দেশের নানা প্রান্তে। বলা চলে, এই গানটি নিয়ে মাতামাতি ও প্রচারণার প্রাচুর্যই সিনেমাটিকে সাফল্যের পথ দেখিয়েছে। পাশাপাশি হাশিম মাহমুদের মতো প্রতিভাও চারুকলা ও টিএসসির বলয় ডিঙ্গিয়ে সারা দেশে প্রিয় হয়ে উঠেছেন এই সিনেমায় তার গানটি ব্যবহারের পর।

ব্যক্তিমানুষ মেজবাউর রহমান সুমনকে দেখেছি শান্ত ও ধীর। কথা বলেন নিচুস্বরে এবং পরিমিত। নিজস্ব বলয়ে তিনি আড্ডাবাজ বলেই শোনা যায়। তবে প্রকাশ্যে অন্তর্মুখী। প্রথমবার সিনেমা নির্মাণ করতে এসে গণমাধ্যম সামলেছেন দক্ষতায়। তার ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের নানারকম ক্ষোভ-আক্ষেপ থাকলেও সুমনকে নিয়ে কটু কথা বলতে শুনিনি কোথাও। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন।

গেল কয়েক বছরে দেখা গেছে হুট করে জ্বলে উঠে অনেক নির্মাতাই হারিয়ে গেছেন। একটা সিনেমা বানিয়ে আর ধারাবাহিক হতে পারেননি। সে জায়গায় সুমন ব্যতিক্রম হবেন আশা করা যাচ্ছে। কারণ এরই মধ্যে তিনি ‘রইদ’ নামে আরেকটি ছবি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দেশের গুণী অভিনেত্রী জয়া আহসান প্রযোজিত ছবিটি সুমন তৈরি করবেন সরকারি অনুদানে। ছবির পাত্র-পাত্রীর সন্ধান চলছে। টেকনিক্যাল প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই মাঠে নেমে পড়বেন। ‘হাওয়া’ দিয়ে স্থবির হওয়া ঢালিউডের জাহাজের পালে যে দোলা সুমন দিয়েছেন সেটা তিনি ‘রইদ’ এবং তারপর আরও সিনেমা দিয়ে অবিরাম রাখবেন এই প্রত্যাশা সবার। সিনেমা নির্মাণের পরিবেশ যতই প্রতিকূল হোক- হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়ে তিনি ঢালিউড ছেড়ে যাবেন না, এটাই আমাদের বিশ্বাস।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা