× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বেগম রোকেয়ার প্রাসঙ্গিকতা

ডা. ফাওজিয়া মোসলেম

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ ২২:১৫ পিএম

বেগম রোকেয়ার প্রাসঙ্গিকতা

যুগে যুগে কিছু মানুষ আসেন, তাঁদের দর্শন বহু যুগ ‍ধরে, বহু শতাব্দী ধরে সমাজে বিদ্যমান থাকে, সেটার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। সে রকম একজন মানুষ ছিলেন বেগম রোকেয়া। তিনি শুধু একজন নারীবাদী ছিলেন, সেটা বললে তাঁকে ছোট করা হবে। তিনি নারীবাদের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি শুধু নারীদের কথা বলেছেন তা কিন্তু নয়। মানবসমাজের উন্নয়নে যা যা করণীয়, সেসব কথাও তিনি বলে গেছেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেগম রোকেয়া আমাদের সামনে আলোর মশাল হাতে নিয়ে উপস্থিত হন। তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে আমরা তাঁকে নানাভাবে চিহ্নিত করতে পারি। তাঁর কাজগুলোকে আমরা যদিও সমাজ-সংস্কারমূলক কাজ হিসেবে দেখি, কিন্তু সেই সমাজ-সংস্কারটা শুধু সমাজ-সংস্কার ছিল না; সমাজের মধ্যে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার কথাই তিনি ভেবেছিলেন বলে এখনকার সময়ে সেটা অনুমিত হয়। তাঁর কাজগুলো হলো- প্রথমত সাহিত্য; দ্বিতীয়ত হচ্ছে, নারীশিক্ষা; তৃতীয়ত হচ্ছে, এই অবরোধ থেকে নারীকে মুক্ত করা। চতুর্থত, নারীকে একজন মানুষ হিসেবে তার স্বপ্নটা দেখানো এবং একজন মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক- এই স্বপ্নটা তার সামনে তুলে ধরা। পঞ্চমত, নারীকে মানুষ হিসেবে পরিবর্তিত অবস্থায় ধারণ করার জন্য সমাজকে তৈরি করা। এই পাঁচটা কাজ মূলত আমরা তাঁর জীবনভর করা কর্মের ভেতর দেখি। তাঁর প্রথম যে সাহিত্য ‘অবরোধবাসিনী’, সেই ‘অবরোধবাসিনী’তে তিনি দেখিয়েছেন যে সেই সময়ে নারী কী রকম একটা অবরোধের মধ্যে ছিল। পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই নারী অবরুদ্ধ ছিল। মূলত পারিবারিক অবস্থাই তিনি বেশি তুলে এনেছিলেন। আমরা তাঁর সময়কার সম্ভ্রান্ত পরিবারের দিকে তাকালেই দেখি, তাদের পরিবারের মেয়েরা এমন পর্যায়ের মধ্যে বসবাস করত। অনাত্মীয় মেয়ে বা মহিলা প্রতিবেশীর বাসায় যদি যেত, সাত বছর থেকে শুরু করে কোনো বয়সের মেয়েরাও তাদের সামনে যেতে পারত না। পুরোপুরি অবরোধের মধ্যে থাকতে হতো। আমরা জানি যে তাঁর সেই গল্প, স্টেশনে একদিন এক ভদ্রলোক আসছে, প্ল্যাটফর্মে দেখলেন একটা পুঁটলি। তিনি সেই পুঁটলির ওপর বসতেই পুঁটলিটা নড়েচড়ে উঠল। এ রকম একটা অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল নারীরা। সে রকম অবস্থা থেকে তিনি মেয়েদের মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন।

এই চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি বুঝেছেন যে শিক্ষা ছাড়া মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয় না। সে জন্য নিজেও অনেক কষ্ট করে শিক্ষার আলোকে গ্রহণ করেছেন এবং সেই আলোকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নারীমুক্তির আন্দোলনে তিনি শুধু লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। সমাজে কাজ করেছেন, তিনি তাঁর সময়ে নারী-পুরুষের মাঝে সমানভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষার কথা বলেছেন। সভ্যতার অগ্রসরে সমাজের যে সংকট, সে কথাও তিনি বলে গেছেন। সে সময়েই তো তিনি দেখেছেন কোনো নারী যখন মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, তখনই ধর্মের নামে তার ‍মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়। সেই একই ঘটনা কিন্তু এখনও ঘটছে। ধর্ম যে নারীকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, অবরুদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করে, এই বিষয়গুলো তিনি সেই সময়েই বলে গেছেন। তিনি এটাও বলেছেন যে ধর্মগ্রন্থগুলো কারা লিখেছেন, লিখেছেন পুরুষরা। কাজেই সেটা পুরুষের জন্য হয়েছে, পুরুষের পক্ষের হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনও সেটার মধ্যে আবদ্ধ হচ্ছি যেটা আমরা বলছি। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি, দুই দশক ধরে মানে সামগ্রিকভাবে গোটা মানবসভ্যতার ইতিহাসেই আমরা যেন পশ্চাৎপদতার দিকে চলে যাচ্ছি। যার জন্য ধর্মীয় উন্মাদনা শুধু বাংলাদেশেই না, পৃথিবীব্যাপীই ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে। সেই বহু আগেই যেসব শক্তি পরাভূত হয়েছিল, নাৎসিবাদ, মুসোলিনির সময়, সেটাই নতুন রূপে ফিরে আসছে। 

এখন আমরা দেখছি যে বাংলাদেশে নানা সময়ে নানাভাবে ধর্মের কল্যাণকর দিক বাদ দিয়ে ধর্মের অপব্যবহার করে নারীকে কীভাবে অবরুদ্ধ করা যায়, তাকে অধীনস্থ করা যায়, তার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালানো যায়, সেই জায়গায় পৌঁছেছি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকেও তাকালে দেখা যায় যে সেখানেও একইভাবে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে। এবং এসব সাম্প্রদায়িক এজেন্ডার ভেতর মহিলারাও পড়ে যাচ্ছে। আমরা কিছুদিন আগেই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয় মেয়েকে মুখ ঢাকার জন্য আন্দোলন করতে দেখলাম। যেখানে আমরা বলছি যে, ‘ছিঁড়ে ফেলো নারী মাথার ঘোমটা, খুলে ফেলো শৃঙ্খল’Ñ সেখানে মেয়েরা নিজেই মুখ ঢেকে অবরুদ্ধ হওয়ার আন্দোলন করছে। কারণটা হলো, ওইসব মেয়েও তো পুরুষতান্ত্রিকতার মাঝে বড় হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিকতার যে পশ্চাৎপদতা, সব মহিলা সেটার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে তা তো নয়। সেটাকেই ধারণ করছে তারা। এই মেয়েরা কিন্তু নারীদের উপস্থাপন করছে না, সমাজকে উপস্থাপন করছে এবং সে সমাজটা হচ্ছে পুরুষশাসিত সমাজ। এই যে আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিতে যে সংকটটা, সেই সংকট দূর করতে রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়কে বেগম রোকেয়ার দর্শন প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি যে সামাজিক আন্দোলনও সংকুচিত হয়ে আসছে, রাষ্ট্রেরও সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট, সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেই সমাজকে এগোনোর। বরং খুব দুঃখজনকভাবে আমরা সিডো বাস্তবায়নের যে আন্দোলন করছি, সিডোর যে দুটি ধারা আছে, গত বছরের রিপোর্টে সরকার বলেছে সমাজ এখন প্রস্তুত না। 

সমাজকে প্রস্তুত করার কাজটা করবে কে? কাজটা করতে হবে রাষ্ট্রকে। সে কাজটা করতে হবে নাগরিক আন্দোলনকে। নাগরিক আন্দোলনও করতে দেব না, সংকুচিত করে রাখব, রাষ্ট্রীয়ভাবেও উদ্যোগ নেব না, তা হলে তো এই পশ্চাৎপদতা থেকে সমাজ যেমন বের হচ্ছে না, মহিলারাও বের হবে না। এবং সেই কারণে আমরা যে বারবার বলছি মহিলারা এখন পোশাক-আশাকের দিক থেকে, চিন্তাধারার দিক থেকে, অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে, এতে আসলে মহিলারা পিছিয়ে গেছে, সেটা ঠিক না। মূলত এতে সমাজই পিছিয়ে যাচ্ছে। সেটার রিফ্লেকশন তখন মহিলাদের মধ্যে দেখি, দুটো পাশাপাশি আন্দোলন যখন আমি দেখি, যে সামাজিক আন্দোলন হচ্ছে নারীমুক্তির জন্য, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য; অন্যদিকে ওই সব মেয়ে এর বিরুদ্ধে নেমে পড়ছে। আমাদের আন্দোলন কিন্তু ওই মহিলাদের বিরুদ্ধে না, পুরুষদের বিরুদ্ধেও না, আমাদের আন্দোলন করতে হবে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। এই কথাটা কিন্তু একশ বছরেরও আগে বেগম রোকেয়া বলে গেছেন। এখানেই কিন্তু বেগম রোকেয়ার সমকালীনতা।

যুগে যুগে কিছু মানুষ আসেন, তাঁদের দর্শন বহু যুগ ‍ধরে, বহু শতাব্দী ধরে সমাজে বিদ্যমান থাকে, সেটার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। সে রকম একজন মানুষ ছিলেন বেগম রোকেয়া। তিনি শুধু একজন নারীবাদী ছিলেন, সেটা বললে তাঁকে ছোট করা হবে। তিনি নারীবাদের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি শুধু নারীদের কথা বলেছেন তা কিন্তু নয়। মানবসমাজের উন্নয়নে যা যা করণীয়, সেসব কথাও তিনি বলে গেছেন। সে সময়েই তিনি সৌরবিদ্যুতের কথা বলেছেন। আমরা যে জ্বালানি সংকটে পড়ছি, তার সমাধানের কথাও তিনি বলে গেছেন। এ জন্য তাঁর প্রত্যেকটা কাজকে আলাদা আলাদাভাবে গবেষণা করা দরকার। তাঁর সাহিত্যকর্ম, শিক্ষার আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলন, পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং এসব আন্দোলনে সমাজকে সম্পৃক্ত ‍করার পদ্ধতি, এর সবটাকে নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার এবং গবেষণা করা দরকার। এখানেই আমাদের সংকট রয়ে গেছে, বেগম রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণা ও কাজের অভাববোধ করছি। এ ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা সেন্টার ফর জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বেগম রোকেয়ার যে দর্শন, সেটার সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে পরিচিত করে তুলতে হবে। শিক্ষানীতিতে রোকেয়ার পূর্ণাঙ্গ পাঠ রাখাও অত্যন্ত জরুরি। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়, নারী-পুরুষ সমতায় শুধু বেগম রোকেয়ার কথা বললেই হবে না, তাঁর চিন্তা-ভাবনার লালন, ধারণ ও প্রসারে আমাদের কাজ করতে হবে। সবার মাঝে সেসব ছড়িয়ে দিতে তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে, তবেই বেগম রোকেয়ার সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা আরও গুরুত্ব পাবে। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা