অলঙ্করন : প্রবা
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হোক, এটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা। অথচ স্বাধীনতার ৫১ বছরেও পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। উদ্যোগটি আজকের না হলেও অদৃশ্য ও অজানা কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা চলেছে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির। ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’র মতো নেতিবাচক শব্দে মুক্তিযুদ্ধ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করার চেষ্টাও হয়েছে। তাদের এই নিগ্রহের শুরু ১৯৭৫ সালে ঘাতকের হাতে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এরপর দীর্ঘদিন বীর মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত থেকেছেন। বঞ্চিত হয়েছেন প্রাপ্য সম্মান থেকে। তাদেরই চোখের সামনে শহীদের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা গাড়িতে উড়িয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। এতে মুক্তিযোদ্ধারা অসম্মানিত হয়েছেন। পরিচয় দিতেও কুণ্ঠিত হয়েছেন। লজ্জা ও ঘৃণায় অনেকে সযত্নে এড়িয়ে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়। আজ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান ফিরিয়ে দিতে পেরেছে। সমাজে ও রাষ্ট্রে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও মর্যাদা বেড়েছে। বর্তমান সরকার তাদের ভাতা বাড়িয়েছে। তার পরও কি তারা প্রকৃতার্থেই তাদের হৃত সম্মান ফিরে পেয়েছেন?
আজও তো জাতির
এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নানাভাবে আমরা বুঝে অথবা না বুঝেই অসম্মানিত করছি। তাদের যথার্থ
মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। আজও
তালিকার নামে বারে বারে মুক্তিযুদ্ধ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানিত করছি, বিব্রত
করছি। স্বাধীন দেশে তারা অস্ত্র জমা দিয়েছেন কার কাছে? উত্তর, প্রশাসনযন্ত্রের দায়িত্বে
থাকা কর্মকর্তাদের কাছে। যাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যুক্ত ছিলেন পাকিস্তানি
প্রশাসনের সঙ্গে। স্বাধীনতার পর তারাই হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ সরকারের অংশীজন। মুক্তিযুদ্ধের
মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব
পড়ে তাদের কাঁধেই। এই যে প্রাথমিক ত্রুটি, তা কি আমরা আজও কাটিয়ে উঠতে পেরেছি? শুরু
থেকেই আমাদের অভাব ছিল মুক্তিযুদ্ধবান্ধব প্রশাসনের। সেই অভাব থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের
পক্ষে পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয় না। বরং মুক্তিযোদ্ধারা যেন বারবার সমালোচিত হন, তাদের যেন
বিতর্কিত করা যায় সেদিকেই দৃষ্টি লক্ষ্য করা গেছে। সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই,
ভুলে গেলে চলবে না, গত ৫১ বছরে আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য পাল্টেছে। আমাদের
ভেতরে ব্যক্তিগত লোভ-লালসা বেড়েছে। বেড়েছে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব। ফলে ব্যক্তির
চরিত্রেও পরিবর্তন এসেছে। আর এর ফলেই ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’র মতো শব্দ এসেছে।
এ রকম নেতিবাচক
দৃষ্টিভঙ্গির শব্দকে পাশ কাটাতেই মুক্তিযুদ্ধে কতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছিলেন,
তার সঠিক তালিকা থাকা প্রয়োজন। এ দাবি অস্বীকারের সুযোগ নেই। তবে স্বাধীনতার এত বছর
পরে এসে সেই তালিকা প্রণয়ন যে জটিল বা অসম্ভব তা-ও বলার সুযোগ নেই। কারণ তালিকা প্রণয়নের
সদিচ্ছা থাকলে, অসম্ভব নয়। বর্তমান সরকার ২০১৩ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ
তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। আজ যখন এ লেখা লিখছি, তখন খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী
২০২৩। মাঝে পেরিয়ে গেছে ১০টি বছর। কিন্তু তালিকা হয়নি, সম্পূর্ণ তালিকা তো দূরেরই।
কবে হবে, তা-ও অনিশ্চিত।
কিন্তু কাজটি
কি সত্যিই জটিল? যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার জন্য ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাদের
তালিকা আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা আছে সেনানিবাসেও। যারা ভাতা পেয়েছেন, পাচ্ছেন তারাও
তালিকার বাইরের নন। তাহলে পূর্ণাঙ্গ তালিকার জন্য এত কাঠখড় পোড়ানো কেন? নাকি যাদের
ওপর এ তালিকা প্রণয়নের দায়িত্ব, তাদেরই কেউ চান না পূর্ণাঙ্গ তালিকা হোক? নাকি তাদেরই
কেউ নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছেন মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের? মুক্তিযুদ্ধের
এত বছর পরে এসেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শব্দ দ্বয়ের উত্থাপন
প্রকারান্তরে সেদিকেই ইঙ্গিত করে।
খুব বেশি পথ হাঁটার
প্রয়োজন নেই, দৃষ্টি একটু প্রসারিত করেলেই জানা যায় কে মুক্তিযোদ্ধা, কে রাজাকার। এখনও
গ্রামের মানুষ জানেন, খোঁজখবর নিলে গ্রামের মানুষ পইপই করে বলে দিতে পারেন কে সত্যিকারের
মুক্তিযোদ্ধা আর কে নন। একজন তরুণ যিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন, পড়ালেখা বা চাকরিসূত্রে
তিনি গ্রামের বাইরে থাকলেও এলাকার মানুষ ঠিকই তাকে জানেন। কোন গ্রামে কোন বাবা-মা মুক্তিযুদ্ধের
সময় তার যুদ্ধে যাওয়া সন্তানের জন্য গোপনে চোখের জল ফেলেছেন, সন্তানের মঙ্গল কামনায়
অস্থির সময় পার করেছেন তা তো গ্রামের মানুষের, প্রতিবেশীর নজর এড়ায়নি। গ্রামজুড়েই
তো আলোচনা হয়েছে—কে গেছেন মুক্তিযুদ্ধে, কে হয়েছেন
রাজাকার। অর্থাৎ গ্রামগুলোয় খোঁজ নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ও নিরপেক্ষ তালিকা করা
সম্ভব। সেদিকে না হেঁটে এখনও আমরা যেন চাইছি মুক্তিযোদ্ধারা সমালোচিত হোক। তারা বিতর্কিত
হোক। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের অহংকার।
আমাদের গর্ব, অহংকার খর্ব হতে দেওয়ার সুযোগ নেই। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতাতেই আজকের বাংলাদেশ। তাদের আত্মত্যাগ ছাড়া আমরা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতাম না। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মানে কোথাও অসম্মানের সামান্য ছায়া পড়ুক, অশ্রদ্ধার শব্দ উচ্চারিত হোক তা বেদনার। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী গত বছরের ২৬ মার্চের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের কথা বলেছিলেন। তা হয়নি। এ ব্যর্থতা সামনে রেখেই বলতে চাই, আর সময় ক্ষেপণের সুযোগ নেই। সময়ের কঠোর-কঠিন নিয়মে আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বড় অংশকেই হারিয়েছি। যারা বেঁচে আছেন, তারাও বয়সের ভারে জর্জরিত, অনেকের স্মৃতিও ক্ষীণ। এ তো সময়েরই কঠিন সত্য। সেই সত্য মনে রেখেই হচ্ছে-হবের জটাজালে বৃত্তাবদ্ধ না থেকে মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন জরুরি। এজন্য প্রয়োজন শুধু আন্তরিক সদিচ্ছা, একই সঙ্গে কর্মদক্ষতাও।