× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ও ভোক্তার জ্বালানি অধিকার

এম শামসুল আলম

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৩ ০৭:১১ এএম

অলঙ্করন : প্রবা

অলঙ্করন : প্রবা

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) গণশুনানিতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে-বিপক্ষে বিচার-বিশ্লেষণ হলো। আদেশ হবে। তখনই সংস্থাটিকে পাশ কাটিয়ে সরকার তথা বিদ্যুৎ বিভাগ সাধারণ ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়াল ৫ শতাংশ। গত নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বিদ্যুতের মূল্য বাড়ায় বিইআরসি। হঠাৎ এমনকি জরুরি পরিস্থিতি দেখা দিল, যে জন্য বিধিগত প্রক্রিয়ার পথে না হেঁটে প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ায় সরকারকে বিদ্যুতের মূল্য বাড়াতে হলো? বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিতর্কের মধ্যেই গ্যাসে রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি বিস্ময়কর। দফায় দফায় মূল্য বাড়িয়ে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা আড়াল করা হচ্ছে। গ্যাসের মূল্য গত জুনে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। আর এবার বাড়ল ৮২ শতাংশ। শুধু মূল্যই বাড়ে, কিন্তু বাড়তি টাকা কোথায় যায়? জ্বালানি নিরাপত্তা কতটা বিপন্ন এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। এই মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া বিতর্কিত। মূল্য বাড়ানোর ক্ষমতা নিজের হাতে নিলেও আইনি প্রক্রিয়া পরিহার করে সরকার কোনোভাবেই মূল্য বাড়াতে পারে না। অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় ও মুনাফা কমিয়ে ভর্তুকি কমানো এখন সময়ের দাবি, কোনোভাবেই মূল্যবৃদ্ধি নয়।

বিদ্যুৎ চাহিদার সঙ্গে নয়, জ্বালানি সরবরাহ সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি না করা হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ টেকসই হবে না। এ বিষয়টি আমরা প্রায় দুই দশক ধরে বলছি। সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পরিকল্পনায় যে চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়, তা প্রকৃত চাহিদার তুলনায় অধিক ও সামঞ্জস্যহীন এবং চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করে। এই অসামঞ্জস্য বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি পরিকল্পনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যখন চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম ছিল, তখন তড়িঘড়ি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো হয়। উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি জ্বালানি মিশ্রণে তরল জ্বালানি ও এলএনজির পরিমাণ ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিতে ঘাটতি বাড়ে এবং তা সমন্বয়ে ভর্তুকি ও মূল্য উভয়ই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। যদি পরিকল্পনা গণবান্ধব হতো, তা হলে সব পর্যায়ে ব্যয় সাশ্রয় করে ঘাটতি সমন্বয় করা হতো এবং বিদ্যুৎ ঘাটতিও পর্যায়ক্রমে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সমন্বয় হতো।

বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানি বাজারে পরিণত করার লক্ষ্যে বিদেশি ঋণদানকারী সংস্থাসমূহের পরামর্শে ১৯৯০ সাল থেকে যেসব সংস্কার চলছে, সেসবের অন্যতম : (১) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে বাণিজ্যিক খাতে পরিণত করা, (২) এ খাতকে ব্যক্তি খাতে রূপান্তরিত করা এবং (৩) মূল্যবৃদ্ধি দ্বারা আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যের সমতা রক্ষা এবং ভর্তুকি প্রত্যাহার করা। সরকার বলছে, 'সংস্কারে সরকার সফল হয়েছে'। ব্যক্তি খাতে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ধারাবাহিকতায় ব্যয়বহুল রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেনা বন্ধ হয়নি ভোক্তাদের দাবি সত্ত্বেও। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্ন অয়েলের ৯০ শতাংশ বিপিসির পরিবর্তে ব্যক্তি খাতে আমদানি হয়। তাতে উৎপাদন ব্যয় কম-বেশি ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলের অর্থ পিডিবির মালিকানায় ভোলায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করা হলে সংকট ও ভর্তুকি উভয়ই কমানো যেত। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ গ্যাসের মজুদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছাতক (পূর্ব) গ্যাসক্ষেত্রকে উৎপাদনে আনা হলে গ্যাস সংকট হ্রাস পেত এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় সাশ্রয় হওয়ায় ভর্তুকি কমে যেত। পিক পিরিয়ডে সহনীয় লোডশেডিংসহ পিকিং বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা হলে উৎপাদন ব্যয় কম হতো এবং ভর্তুকি ও মূল্যবৃদ্ধি হতো না। বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানির দেশে পরিণত করা এত দ্রুত সম্ভব হতো না। অন্যদিকে বিদেশি ব্যক্তি খাত বিনিয়োগে উৎপাদিত গ্যাস ও কয়লা তাদেরই মালিকানায় রপ্তানির চেষ্টা চলে। গণবিরোধিতার মুখে সে চেষ্টা সফল হয়নি। রপ্তানির সুযোগ না থাকায় গ্যাস ও কয়লা উত্তোলনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হয়নি। সরকার নিজস্ব বিনিয়োগে তা উত্তোলনের জন্য কোনো নীতি বা পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। সরকার তেল, গ্যাস, কয়লা ও বিদ্যুৎ আমদানি বৃদ্ধিতে আগ্রহী হয়। জ্বালানি সরবরাহ সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তরল জ্বালানি ব্যবহার বাড়ায়। ফলে বিদ্যুতে ভর্তুকি ও মূল্যবৃদ্ধি হয়। এখন আইএমএফের চাপে ভর্তুকি কমাতে মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। যদিও বলা হচ্ছে, জ্বালানি আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি সমন্বয়ের জন্য মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু ভোক্তাপক্ষের দাবি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে

অন্যায় ও অযৌক্তিক তথা লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা ন্যায্য ও যৌক্তিক করা হলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি সমন্বয় হতো, মূল্য ও ভর্তুকি কোনোটাই বৃদ্ধির দরকার হতো না। সরকার সেদিকে যায়নি। বরং বিইআরসিকে বাদ দিয়ে নিজেই মূল্য নির্ধারণ করার দ্বারা অন্যায়, অযৌক্তিক ব্যয় ও মুনাফা বৃদ্ধি সুরক্ষা দিচ্ছে। আমরা প্রথম থেকেই যেমনটা বলছি- দুর্নীতি, মুনাফাকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা, অদক্ষতা, সমন্বয়হীনতা এবং সেই সঙ্গে ভোক্তাবান্ধবের পরিবর্তে অসাধু ব্যবসাবান্ধব পরিকল্পনা থাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বেড়েই চলেছে। এ বিষয়টি যদি প্রথম থেকেই গুরুত্ব দেওয়া হতো, তা হলে অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীনভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হতো না। অনিঃশেষযোগ্য বিদ্যুৎ বাজার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ মোটেও বিবেচনায় আসেনি। অভিযোগ রয়েছে, ১৮ টাকা মূল্যহারে কয়লার বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়, অথচ কম-বেশি ১০ টাকা মূল্যহারে অনিঃশেষযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রগতি নেই। বিইআরসি আইন ২০০৩ সংশোধনীতে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে সরকার সংস্থাটিকে পাশ কাটিয়ে অব্যাহত আর্থিক ঘাটতি দ্রুত সমন্বয়ের জন্য ভোক্তাপর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি শুরু করা হয়েছে। আমাদের আপত্তি এখানেই।

আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, সরকার পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয়ের পরিকল্পনা করুক। সরকারের পক্ষ থেকে ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ের কথা বলা হচ্ছে। অথচ আমরা চাই সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় সাশ্রয় করুক। উৎপাদন, সঞ্চালন এবং বিতরণে যে ব্যয়বৃদ্ধি দেখানো হয় তা নিয়ন্ত্রণ করে ঘাটতি সমন্বয় করুক। মূল্যবৃদ্ধি কিংবা ভর্তুকি বৃদ্ধির মাধ্যমে ঘাটতি সমন্বয়ের কথা আমরা বলিনি। গণশুনানিতে আমরা বলেছি, যদি বলা হয় সরকার ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়াবে না, ব্যয় সাশ্রয় করে ঘাটতি সমন্বয় করতে হবে, তা হলে লাইসেন্সীরা ঘাটতি সমন্বয়ে মূল্যবৃদ্ধির পরিবর্তে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যয় সাশ্রয় করে ঘাটতি সমন্বয়ের প্রস্তাব আনবে। সরকার সংস্কারে সফল হতে চায় বলেই মূল্যবৃদ্ধি চায়। তাই তারা মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব এনেছে। আমরা গণশুনানিতে এ কথাও বলেছি, 'মূল্য কমানোর প্রস্তাব আনতে বলুন। কাগজে-কলমে হিসাব করে দেখাব, কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব।' ব্যয় সাশ্রয়ের জায়গাগুলো আমরা বারংবার চিহ্নিত করে দেখানোর পরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

আমরা এমন এক সংকটময় মুহূর্তে আছি যখন সরকার ভর্তুকি দিতে অপারগ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'আগে আমাদের ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও এখন আর দিতে পারছি না।' এদিকে ভোক্তারাও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপে পিষ্ট। এমন সময়ে ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য দফায় দফায় চক্রাকারে বৃদ্ধি এক আতঙ্কজনক ঘটনা। এই মুহূর্তে সরবরাহ ব্যয় সাশ্রয় না করে বরং ভর্তুকি সমন্বয়ের নামে অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে ভোক্তারা চরম নিপীড়নের শিকার। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর পক্ষে বলা হয়, লোডশেডিংমুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যয় বাড়াই পাইকারি পর্যায়ে ঘাটতি বেড়েছে। লোডশেডিংমুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ অনিশ্চিত, যেহেতু চাহিদামতে জ্বালানি সরবরাহ অনিশ্চিত। ফলে ভোক্তার জ্বালানি অধিকার বিপন্ন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাজারে সরকারও ব্যবসায়ী কিংবা উদ্যোক্তা। এখানে সরকারেরও বিনিয়োগ রয়েছে। মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির। কিন্তু এই ক্ষমতা সরকার নিয়ে নেওয়ায় বিইআরসি এখন অকার্যকর এবং সরকারই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সরকার যেহেতু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসায়ী, সেহেতু এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরকার হতে না পারলেও তাই হলো। আইনের দর্শনের তা পরিপন্থি এবং সাংঘর্ষিক।জ্বালানি সরবরাহ এবং ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করবে বিইআরসি। এটি একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই সংস্থা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চলামান সংস্কারের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যবসায়ী হয়েও সরকার সরবরাহ ব্যয় অন্যায় ও অযৌক্তিক বৃদ্ধি দ্বারা ঘাটতি সৃষ্টি এবং সে ঘাটতি সমন্বয়ে মূল্যবৃদ্ধি করে ঋণদানকারী সংস্থার চাহিদামতে দেশকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানি বাজারে পরিণত করার জন্যই বিইআরসির ক্ষমতা নিজে নিয়ে নিয়েছে। এমনটি কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমন অবস্থায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ন্যায্য ও যৌক্তিকতা প্রত্যাশা যেন দুরাশা।

লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ

 

 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা