ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:২৫ এএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:১০ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
মুক্তির মহানায়ক বাঙালি জাতিসত্তার মহান স্বরূপ উন্মোচক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে প্রদত্ত বর্ণনা থেকে জানা যায়, ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি করাচীতে পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের আলোচনায় পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ সদস্যসহ মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। সেদিন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদাসীন করার জন্য কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র দত্ত বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়Ñ এক কূট পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচণ্ড চক্রান্ত হচ্ছিল। এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ; বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হল। প্রকৃত অর্থে সে সময় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় ভূমিকার কারণেই মাতৃভাষা আন্দোলনের জন্য অবশ্যম্ভাবী প্রতিবাদী প্রাণস্পন্দন নতুন আবহে উজ্জ্বীবিত হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন এবং তার নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হয়। একই দিন রাষ্ট্রভাষার দাবিতে প্রথম হরতাল কর্মসূচিতে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে প্রতি বছর ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই আলোকে ১৯৪৯, ১৯৫০ ও ১৯৫১ সালে ক্রমান্বয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বারের মতো রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হয়।
আজ বাংলা ভাষা স্বাধীন বাংলাদেশের
একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা অর্জন করেছে। এর পিছনে
কত রক্ত এবং শহীদের আত্মত্যাগ তা বঙ্গবন্ধুর আবেগতাড়িত বর্ণনা থেকে বোঝা যায়। যেহেতু
একমাত্র বাঙালি জাতি মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় সমগ্র বিশ্বে প্রাণ বিসর্জনের দৃষ্টান্ত
স্থাপন করল, যার ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম
ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন মাতৃভূমি। এটিই স্বীকৃত হয়েছে বিশ্ব দরবারে।
এ জন্যই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে এতটাই
গুরুত্বপূর্ণ ও অবিস্মরণীয়।
দ্বিজাতিত্বত্তের ভিত্তিতে ভারত
ও পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর ভিত্তি স্থাপিত হলেও অর্থ-রাজনৈতিক নির্মম বৈষম্য সৃষ্টি
ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণতাদানে সুনিপুণ
নষ্ট পরিকল্পনায় তারা ধর্মকেই শোষণের ঢাল হিসেবে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু বাঙালি আদিকাল
থেকেই ঐতিহ্যিক চেতনায় ধর্মান্ধকে বর্জন ও ধার্মিকতাকে গ্রহণ করার মাধ্যমেই মানবিক-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষতার
শাশ্বত বৈশিষ্ট্যকে ধারণ-লালন করে জাতীয়তাবাদের অবিজ্ঞেয় আলোয় একাশ্রিত হয়। একুশের
চেতনায় পরিপূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক প্রতীতি প্রতিফলিত হয় ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’
মূলমন্ত্রে। সমাজ-সংস্কৃতির বিকাশ আবরণে ধর্ম আপেক্ষিক কোনো বস্তু হিসেবে নয়, সনাতনিক
নিয়ম বা স্বাভাবিক সহজ-সরল মানবিক বৃত্তিকে গঠন করার প্রক্রিয়ায় এর ভূমিকা সাবলীল অবারিত
ও চিরঞ্জীব। বিভিন্ন সূত্রমতে, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় দুইশত সত্তরটি শাখা-প্রশাখা ও
সম্প্রদায়ে বিভক্ত উনিশটি প্রধান ধর্মমত প্রচলিত আছে। এইচপি বেকারের মতে অসাম্প্রদায়িক
প্রত্যয়টি অপবিত্র, পাপী, ঈশ্বরহীন, বিধর্মী ইত্যাদির সমার্থক নয়। বরং স্ব স্ব ধর্মের
প্রতি নিজস্ব শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে অন্য ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি যুক্তি
ও প্রায়োগিক বিবেচনায় সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের বিনিময়ে ছন্দোবদ্ধ হয় মানবিক
নির্যাস।
বাংলার সামাজিক ইতিহাসের অপ্রতুলতা,
বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রবাহ ইত্যাদি বিরাজিত অসাম্প্রদায়িক সম্পর্কের স্বরূপ নির্ণয়ে অনেক
ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি এবং বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির
ঐতিহ্যের সার্থক রূপায়ণ করতে পেরেছে একুশের এই মহান ভাষা আন্দোলন। বস্তুতপক্ষে অজানাকে
জানার আগ্রহ, প্রোথিত অনুভূতি এবং অদম্য ইচ্ছার বস্তুনিষ্ঠ নিয়ামক হিসেবে আদর্শগত সমাজ-উদ্ভূত
উপাদান হচ্ছে শুভ-সত্য ও সুন্দরের পরিপূরক বিকিরণ। পবিত্র ধর্ম ইসলামকে ঘিরে ঘৃণ্য
অপসংস্কৃতি বা সন্ত্রাস-জঙ্গি-বর্বরতা-নৃশংসতা-হত্যা-প্রতিহিংসাপরায়ণতাকে উন্মাদিত
করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। ইসলাম ধর্মের নিগূঢ়তম পবিত্রতা-মানবিকতা-সর্বজনীনতা-নান্দনিকতা-সৃজনশীলতা-অগ্রসরমাণতা
এবং সর্বোপরি শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি অবিচল কল্যাণ প্রবৃত্তিকে বিনষ্ট-বিভ্রান্ত-কলুষিত
করার অব্যাহত অপচেষ্টা-অপকৌশল সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ইসলাম-কুরআন-সুন্নাহ্ পরিপন্থি।
প্রকৃত অর্থে ধর্ম মানবচেতনার সম্প্রসারিত
রূপ। তবে এটি সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার এবং রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ
পৃথক। ফলে রাষ্ট্র কাউকে বিশ্বাসের খাঁচায় বন্দি করতে পারে না বা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর
ধর্মবিশ্বাস রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবে যৌক্তিক না। মানবাধিকার ঘোষণার ১৮
অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে ‘প্রত্যেক মানবের তার স্বাধীন চিন্তা, বিবেক ও ধর্মবিশ্বাসের
অধিকার আছে। এই অধিকারের মধ্যে সংশ্লিষ্ট আছে ধর্ম ও বিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতা
এবং একক বা যৌথভাবে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে তার ধর্ম বা বিশ্বাসের শিক্ষা, প্রথা,
উপাসনা ও আচরণ জনসমক্ষে ব্যক্ত করার অধিকার। স্মরণ রাখতে হবে, অন্যতম সদস্য হিসেবে
বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদের ৫৫ ও ৫৬ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত মূলনীতি একক ও যৌথভাবে পালন করতে
অঙ্গীকারবদ্ধ।’
বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনের মতে- ‘সেকুলারবাদ থেকে জাতীয়তাবাদ। একটি ভৌগোলিক ভূখণ্ডের জনগণ স্বাধীনতা ও সমতার ভিত্তিতে আপন জনজীবন, রাজনীতিক, অর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সেখানে সবার সমান আধিকার থাকবে, কেউ বেশি কেউ কম অধিকারী হবে না ধর্ম, বর্ণ ও মতবাদের জন্য। এর চালিকা আত্মিক ভাবধারা হচ্ছে মানবতাবাদ। একটি বিশেষ ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী এই ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হলে তাকে বলা হয় জাতীয়তাবাদ। এই সার্বিক ভাবধারাকে কোন ধর্ম, বর্ণ বা বিশেষ মতবাদের দ্বারা বিভাজিত করলে যা দাঁড়ায় তা হলো সাম্প্রদায়িকতা অর্থাৎ বিকৃত জাতীয়তাবাদ। যে কোনো ধরনের পারস্পরিক নিন্দার্হ আচরণকে পরিহার করে অন্যের মঙ্গলে আত্মনিবেদনের মধ্যেই প্রকৃত অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার জয়গান।’ দুঃখজনক হলের সত্য যে, স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছরেও বাংলা ভাষাকে সঠিক মর্যাদায় পরিপূর্ণ সমাসীন করা যায়নি। মহামান্য আলাদত কর্তৃক বারংবার নির্দেশিত হলেও বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করার পর্যাপ্ত দৃষ্টান্তও রয়েছে। বাংলা ভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তকে ভুল বানান-শব্দ প্রকরণ-বিভ্রান্তিমূলক উপস্থাপনা এখনও ক্ষেত্রবিশেষে করুণ দৃশপট তৈরি করছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত-অমর একুশের শিক্ষা-ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাঙালির জীবনের সব ক্ষেত্রে পাথেয় হোকÑ আজকের দিনে এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি। বিনম্রচিত্তে বঙ্গবন্ধুÑ একুশের শহীদানÑ জাতীয় চার নেতাÑ বঙ্গমাতাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব শহীদ সদস্যÑ মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদদের স্মৃতির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং সর্বোচ্চ ত্যাগী ২ লাখ জননী-জায়া-কন্যার অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।