আবুল কাসেম ফজলুল হক
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:১৫ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
বাংলা ভাষা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে এবং টিকে আছে। এক সময়ে ধর্মীয় বিধান প্রচলিত ছিল যে, রামায়ণ, মহাভারত ও অষ্টাদশ পুরাণ যদি মানবভাষায় আলোচনা করে, তবে সে রৌরব নরকে যাবে। ‘মানবভাষা’ বলে বোঝানো হতো সংস্কৃত ভাষার বাইরের সব ভাষাকে। আর সংস্কৃত ভাষাকে বলা হতো ‘দেবভাষা’। সংস্কৃত ছিল ধর্মানুশীলনের ও রাজকার্য পরিচালনার ভাষা। তুর্কি, পাঠান, মুঘল শাসকদের কালে সংস্কৃতের জায়গায় ফারসিকে করা হয় রাজকার্য পরিচালনার ভাষা। সেকালে বাংলা ভাষার দেশে ধর্মচর্চার ও জ্ঞানচর্চার ভাষা ছিল আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত। চাকরি ও ব্যবসার প্রয়োজনে ধর্ম নির্বিশেষে লোকে তখন ফারসি ভাষা শিখত। সারা দেশে লোকজীবনে তখন বাংলা ভাষা চালু ছিল। বাংলা ভাষা তখন ধীরগতিতে হয়ে উঠেছে ও বিকশিত হয়েছে। পাঠান সুলতানদের আমলে বাংলা দিল্লির অধীন ছিল নাÑ দুইশ বছর বাংলা ছিল স্বাধীন। তখন বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য কোনো কোনো সুলতান নানাভাবে সহায়তা করেছেন।
তাঁদের মধ্যে
আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ছিলেন বাংলা ভাষার উন্নতিতে সবচেয়ে বেশি সহায়ক। সব সুলতানই তখন
হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। ওই সুলতানি আমলেই আত্মপ্রকাশ
ঘটেছিল শ্রী চৈতন্যের। তিনি সংস্কারের মধ্য দিয়ে যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেছিলেন তা
হিন্দুদের মুসলমান হয়ে যাওয়া থেকে বিরত করেছিল। তিনি বৈষ্ণবদের জন্য সাম্য প্রবর্তন
করেছিলেন, বেদ পাঠে বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন এবং জীবাত্মা-পরমাত্মার
মধ্যে প্রেমধর্মের কথা প্রচার করেছিলেন। বৈষ্ণব পদাবলি হয়ে উঠেছিল পরম সুন্দর-অতুলনীয়
আর চৈতন্য-জীবন নিয়ে লিখিত কাব্যগুলো হয়ে উঠেছিল সুগভীর ও বহুব্যাপ্ত, দর্শন-সমৃদ্ধ
তত্ত্বগ্রন্থ। এসব কিছুর ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষা তখন অনেক বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে।
তখন লোকসাহিত্য ছিল, আর ছিল দরকারি সাহিত্য। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য
ও রোমান্স কাব্য ছিল দরকারি সাহিত্য। সংস্কৃত, ফারসি ও আরবির প্রতিপত্তির মধ্যে প্রতিকূল
পরিবেশেও বাংলা ভাষা বিকাশশীল ছিল। বাঙালি বাংলা ভাষাতেই চিন্তা করেছে, উপলব্ধি করেছে,
অনুভব করেছে, ভাব বিনিময় করেছে, লোকসাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য ইত্যাদি সৃষ্টি
করেছে। বাংলা ভাষাই ছিল বাংলার জনগণের অস্তিত্বের ও জীবনযাপনের সবচেয়ে মূল অবলম্বন।
ব্রিটিশ শাসনকালে
পরাধীনতার মধ্যে ইংরেজি ভাষার দোর্দণ্ড প্রতাপের মধ্যে বাঙালি বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান
ও সাহিত্যের সব শাখায় সাধন করেছে অসাধারণ উন্নতি। সেই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানকালেও
ঢাকাকেন্দ্রিক জাতীয় সংস্কৃতিতে বাংলা ভাষার উন্নতি অব্যাহত থাকে। ঢাকা গড়ে ওঠে জাতীয়
সংস্কৃতির নতুন শক্তিশালী কেন্দ্ররূপে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির
স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা এবং মানববাদী জীবনানুভূতি ও চিন্তাচেতনা অবলম্বন
করে বিকশিত হয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য।
বিশ শতকের ষাটের,
সত্তরের ও আশির দশকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়, প্রশাসনিক কর্মধারা ও সাহিত্য অবলম্বন
করে ঘটে বাংলা ভাষায় বিপুল উন্নতি। ইংরেজি আরবি ও ফারসি ভাষা থেকে অনূদিত হয় বেশকিছু
কালজয়ী গ্রন্থ। বাংলা একাডেমি, বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন বিষয়ের রচনাবলিতে, সাহিত্যে ও সাময়িকপত্রে বিধৃত আছে বাঙালির
সৃষ্টিশক্তির পরিচয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন থেকে প্রচারিত বাংলায় লিখিত ও অনূদিত গ্রন্থাদিও
বাংলা ভাষার বিকাশে সহায়ক হয়েছে। ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনস ও জার্মান কালচারাল ইনস্টিটিউট
থেকে প্রচারিত বাংলায় লিখিত ও অনূদিত সমাজতন্ত্রবিরোধী পুস্তকাদিও বাংলা ভাষার উন্নতির
সহায়ক হয়েছে। বাংলাকে দেশের রাষ্ট্রভাষারূপে ক্রমাগত বিকশিত করা হলে বাঙালির জাতীয়
ও রাষ্ট্রীয় উন্নতির ধারা সুস্থ, স্বাভাবিক ও বর্ধিষ্ণু রূপ পেলে, রাষ্ট্রের জগৎ আকৃষ্ট
হতো বাংলা ভাষার প্রতি।
স্বাধীন রাষ্ট্র
হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থার সকল পর্যায়ে বাংলা
প্রচলনের জন্য দেখা দেয় বিরাট আশা ও উদ্দীপনা। বাংলা ভাষা নিয়ে জাতির জীবনে সঞ্চারিত
হয় নবচেতনা। ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষা থেকে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ জ্ঞানসম্পদ ও সাহিত্যসম্পদ
আহরণ করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল। অর্থনীতিবিদ ও নানা
ধারার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বাংলা ভাষা নিয়ে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। তবে সরাসরি বাংলা
প্রচলনের বিরোধিতা কেউ করেননি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বছর পাঁচেকের মধ্যে বিচার বিভাগ
ও ব্যাংকের কার্যক্রম ছাড়া সব সরকারি অফিসে বাংলা চালু হয়ে যায়। বছর বিশেকের মধ্যে
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা ও গবেষণার মাঝে বাংলা চালু হয়। বাংলা ভাষার মাধ্যমে
বিভিন্ন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের রীতি চালু হয়। ইংরেজ
শাসনামলের শুরু থেকে বাংলা ভাষার অগ্রগতি ও উন্নতি লক্ষ করলে মনে পরম আশা দেখা দেয়।
কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর থেকে এ দেশে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন
থেকেছেন, থাকছেন। এ সময়ে বাংলা ভাষার উন্নতিও আগের ধারা বিকাশমান থাকেনি। সরকারের ওপর
বাংলা একাডেমির ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী বইমেলার চাপ না থাকলে এতদিনে বাংলা রাষ্ট্রভাষা
হিসেবে টিকত কিনা এ প্রশ্ন সামনে আসে।
১৯৭২ সালের ১২
জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র
হিসেবে আজও যথেষ্ট পরিমাণে গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ পরনির্ভরতা শেষ পর্যন্ত পরাধীনতায় পর্যবসিত
হয়ে যেতে পারে। দক্ষিণ এশীয় বাস্তবতা ও বিশ্ব বাস্তবতা বিবেচনা করে বাংলাদেশের কর্মনীতি
নির্ধারণ করতে হবে। বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষারূপে রক্ষা করতে হবে এবং বিকাশমান
ও সমৃদ্ধিমান রাখতে হবে। এর জন্য যা কিছু দরকার হয় সবই করতে হবে।
যারা জন্মগতভাবে
বাংলাদেশের নাগরিক এবং পছন্দগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া
প্রভৃতি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছেনÑ তাদের বাংলাদেশপ্রীতি দ্বারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে
শক্তিমান ও সমৃদ্ধিমান হতে পারবে না। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে রক্ষা না করে যারা
বিশ্ব নাগরিক হতে চান, তাদের দ্বারাও বাংলাদেশ উন্নতিশীল হতে পারবে না। বাংলাদেশ একটা
স্থবিরতার মধ্যে পড়ে আছে। তাকে প্রগতিশীল হতে হবে। পৃথিবী থেকে রাষ্ট্র অচিরেই বিলুপ্ত
হয়ে যাবেÑ এমন ধারণা করা ঠিক নয়। জাতি, রাষ্ট্র, জাতীয় সংস্কৃতি বা জাতীয় সভ্যতা থাকবে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে সব দিক দিয়ে অস্তিত্বশীল ও সমৃদ্ধিমান রাখতে হবে,
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সমৃদ্ধিমান রাখতে হবে। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের,
বিশ্বব্যাংকের ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের মুখাপেক্ষী থেকেও বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ
উন্নতি করতে পারবে না। বাংলাদেশের আত্মশক্তির ওপর নির্ভর করে শক্তিমান ও সমৃদ্ধিমান
হতে হবে। আত্মশক্তির কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতি
দুর্গত। রাজনীতির সুস্থ, স্বাভাবিক ও উন্নতিশীল রূপ দিতে হবে। গতানুগতিক রাজনীতি দিয়ে
প্রকৃত উন্নতি সম্ভব হচ্ছে না। বলা হয়, অভাবে স্বভাব নষ্ট এবং চেষ্টা করা হতো স্বভাবকে
সুস্থ করে তোলার জন্য। এখন দেখা যাচ্ছে প্রাচুর্যেও স্বভাব নষ্ট হয়। প্রাচুর্য ও অভাব
দুটোই কমাতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি সুষ্ঠু ভাষানীতি দরকার। সরকার এটা করতে
না চাইলে দেশের চিন্তাশীল বিবেকবান লোকেরা তা করতে পারেন। এর বাস্তবায়নের কাজও তাঁরা
অনেকটা করতে পারেন।
পাকিস্তানকালে যে বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ছিল, ১৯৭২ সালে তা বিলুপ্ত করা ঠিক হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে আজকের বাস্তবতায় নতুন করে ওই রকম একটি সংস্থা গড়ে তোলা একান্ত দরকার। দেশের বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এটা ভেবে দেখতে পারেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এ ধারায় চিন্তা করে না। তাদের রাজনৈতিক চিন্তা এ ধারার পরিপন্থি। সংকট থেকে মুক্তির জন্য এ ধারার চিন্তা ও কাজ দরকার। রাজনীতির আমূল পুনর্গঠন ও নবায়ন দরকার। মহান নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চিন্তাচেতনাই বিকশিত হয়েছিল বৃহত্তর বাঙালি-জাতীয়তাবাদী চিন্তায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চিন্তায়, স্বাধীনতাযুদ্ধের চিন্তায় ও কার্যক্রমে। এই রকম সংগ্রামী ঐতিহ্যের অধিকারী জাতি আজ এত সংগ্রামবিমুখ কেন? আশা করি ঘুমন্ত জনগণ জাগবে এবং শুভকর পরিবর্তন সূচিত হবে।