× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

উন্নতির সিঁড়ি, অবনতির ছায়া

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:০০ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

সিঁড়ি উপরে উঠতেও লাগে, নিচে নামতেও লাগে। দেশে উন্নতি যে প্রচুর হচ্ছে কিংবা ইতোমধ্যে হয়েছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যেদিকেই তাকান উন্নতি দেখতে পাবেন। বিশেষ করে অবনতির দিকে চোখ রাখলে একেবারেই নিশ্চিত হওয়া যাবে, কেমন গগনস্পর্শ সব উন্নতি ঘটেছে এবং ঘটছে। আর অবনতিগুলো যে উন্নতির দর্শনগুলো থেকে খুব দূরে রয়েছে তা মোটেই নয়। তাদেরও একেবারে সংলগ্ন অবস্থাতেই পাওয়া যাবে, উন্নতির পায়ের কাছেই। তাদের নীচুতা দিয়েই উন্নতির উচ্চতা মাপা যেতে পারে, ইচ্ছে  করলেই হলো। এটা বিশ্বব্যাপীই ঘটছে। একের উন্নতি মানেই অন্য অনেকের অবনতি। যেমন ধরা যাক, স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা। চিকিৎসাশাস্ত্রের অত্যাশ্চর্য উন্নতিতে স্বাস্থ্যরক্ষা বড়ই সহজ হয়েছে; কিন্তু অপরদিকে আবার সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটছে।

স্বাধীনতা বাংলাদেশের মানুষকে কিছু সুযোগ অবশ্যই এনে দিয়েছে। যেমনÑ বিদেশ যাওয়া। আগে এমন সুযোগ ছিল না। বড়জোর করাচি-লাহোর-পিন্ডিতে যেত কেউ কেউ। এখন যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে, মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর-লন্ডন-আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়া কিংবা আরও নানান দেশে। হাজারে-হাজার মানুষ পৃথিবীর যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, যাচ্ছে ছুটে। কিন্তু  যেখানেই যাক, কেবল সে পাসপোর্ট সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে তা নয়, গৃহের স্বপ্ন এবং স্মৃতিকে নিয়ে যাচ্ছে সঙ্গে করে। ঘরবাড়ি থাকে সঙ্গেই; বহন করে চলে, শামুকের মতো পিঠে না হলেও ক্যাঙ্গারুর মতো বুকের ভেতর বটে। বিদেশের উপার্জন দিয়ে দেশে একটি ঘর তৈরি করব প্রথমে এই স্বপ্নটাই থাকে সামনে। করেও। বাড়ি না থাকার স্মৃতিটা একেবারে অনিবার্যভাবে তাড়া করে। স্মৃতিই স্বপ্নকে প্রবল করে। এ তো খুব সত্য কথা যে, গৃহহীনরাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় গৃহী। কেননা তারা ঘর খোঁজে এবং ঘর নেই যেহেতু, তাই দুয়ার দিয়ে শোয়। এখনও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের মিসকিন বলে, সর্বনিম্ন বেতন দেয়। কিন্তু আমরা পরে থাকি সেখানেই, পাসপোর্ট হয়তো ভুয়া কারও, কারও ভিসা হয়তো ঠিক নেই, ভয়ে ভয়ে থাকি কখন জানি তাড়িয়ে দেয়। তাড়িয়ে দিলেই সর্বনাশ। আমাদের ঘর নেই। আমরা ঘর করব কি দিয়ে?

এই আশঙ্কা থাকত না, যদি উন্নতির আশায় আশায় কিংবা আয়-রোজগারের জন্য বিদেশ গমনটা বৈধ পন্থায় হতো। অনেকেই গেছেন কিংবা যাচ্ছেন ভিন্ন পথে। যে পথটা খুব অমসৃণ। দালালচক্র, মানবপাচার চক্র, কর্মসন্ধানী ও উন্নতির আশায় ব্যাকুল এই মানুষগুলোকে ফাঁদে ফেলে সর্বস্বান্ত করে নিজেদের পকেট স্ফীত করছে। সংবাদমাধ্যমে এ রকম খবর প্রায় উঠে আসে। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয় না। যদি যথার্থই প্রতিকার হতো, তাহলে অসাধুচক্রের হাত গুটিয়ে যেত। এই অসাধুচক্রের কারণে একদিকে ভাগ্যান্বেষী মানুষ যেমন সর্বস্বান্ত হচ্ছে, সাগরে কিংবা মরুপথে প্রাণ হারাচ্ছেÑ অন্যদিকে আমাদের শ্রমবাজারে আঘাত লাগছে। এর ফলে বাজারও সংকুচিত হচ্ছে। প্রবাসী আয় যেখানে আমাদের অর্থনীতির অন্যতম জোগানদার, সেখানে দুশ্চিন্তার ছায়া ফেলছে। এই যে বিষয়টি সেটিও কিন্তু উন্নতির সিঁড়ির পাশে অবনতির ছায়া।

ছায়া আরও আছে। সমাজের নানা দিকে তাকালে এই ছায়া দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। বড় বড় উড়াল সেতু হচ্ছে, ওপর দিয়ে মেট্রোরেল চলাচল শুরু করেছে, নিচ দিয়ে মেট্রোরেল চলার আয়োজন চলছে এবং আরও কত কিছু। কিন্তু এর পাশাপাশি এও সত্য বৈষম্যের ছায়া বিস্তৃত হচ্ছে। বৈষম্য দেখা যাচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এবং আরও নানা ক্ষেত্রে। বৈষম্যের এই ছায়া বিস্তৃত হওয়ার পরও উন্নতির সিঁড়ি লম্বা হচ্ছেÑ যে সিঁড়িতে পা রেখে ব্যক্তি বা মহলবিশেষের চেহারায় জৌলুস আসছে। অর্থাৎ তারা সম্পদের পাহাড় গড়ছে।

সমাজের স্তরে স্তরে দেখা যাচ্ছেÑ দেয়াল দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। দেয়ালই যেন সত্য হয়ে আছে, তাকে ভাঙবার চেষ্টা নেই। বিচ্ছিন্নতা এসে গেছে সামাজিকতার পরিবর্তে। চতুর্দিকে কেবলই দেয়াল এবং দেয়াল আমাদের মাথার ভেতরেও ঢুকে বসে আছে। প্রাণ অন্তরীণ, মুক্তি অবরুদ্ধ। এত দেয়াল কেন? বলা যাবে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে। চীনের মানুষ একদা যে একটি মহাপ্রাচীর তৈরি করেছিল, তার কারণটা বুঝি। বিদেশি ‘বর্বরদের’ আক্রমণের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে চেয়েছে তারা। ভারত যে বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে, তার কারণ নাকি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে তাদের দেশকে রক্ষা করা। অথচ সংবাদমাধ্যমে কখনও কখনও দেখা যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের পাহারায় আমাদের জলভূমিতে ওপারের মানুষ দিব্যি মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, বাধা দিলে গুলি ছোড়া হচ্ছে। তা ছাড়াও যখন-তখন আমাদের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে প্রাণহানির খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরে এত যে দেয়াল তোলার উৎসব কিংবা ভাঙা-গড়ার খেলা, তাতে ঠিকাদারদের খুবই লাভ হয়। সেটা তো গেল, তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, দেয়ালের পেছনে আত্মরক্ষার তাগিদ যতটা না থাকেÑ তার চেয়ে বেশি থাকে আত্মপ্রচার, আত্মঅহমিকা ও অহংকারের প্রকাশ। ব্যক্তিগতভাব যেসব দেয়াল আমরা তুলছি, তা তো অসামাজিকতার ও বন্দিদশারও প্রতীক বটে। দেয়াল উঠছেই, উঠবেই। কেননা আমরা মুক্ত হইনি, এমনকি গণতান্ত্রিকও হইনি। গণতন্ত্র ও দেয়াল তোলার উৎসব একত্র করা যায় না। কেননা তারা পরস্পর বিরোধী।

শুধু যে দেয়াল তা তো নয়, মাথাভর্তি সিঁড়িও রয়েছে। সেই সিঁড়ি উন্নতির। এসব সিঁড়ির সব এক রকম নয়। যেমন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সিঁড়ি। সেটা দিয়ে শ্রমিকরা ওঠে, কিন্তু ইচ্ছেমতো নামতে পারেন না, দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়, পাছে সুঁই-সুতো চুরি করে কেউ পালিয়ে যায় এই ভাবনায়। ফলে আগুন লাগলে যেটা প্রায়ই ঘটে থাকে, শ্রমিকরা মারা পড়ে। এ রকম মর্মন্তুদ ঘটনা কম ঘটেনি। কিন্তু মালিকের কিছু হয় না। কেননা মালিক থাকে অন্যত্র, তার উন্নতির জন্যই শ্রমিকের এই প্রাণদান। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা প্রামাণ্য চিত্র বটে। এই শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে তৈরি সম্পদে বৈদিশিক মুদ্রা আয় হলেও শ্রমিকের ভাগ্য বদলে এই আয় কতটা কী ভূমিকা রাখে, তাও তো সচেতন মানুষ মাত্রই জানা। শনৈ শনৈ উন্নতির পাশে অবনতির এ-কি বিস্ময়কর ছায়া! নিয়ম এটাই যে, ক্ষমতাবান ও সুযোগপ্রাপ্তরাই উন্নতি করবে অন্যদের সর্বনাশ ঘটিয়ে। তাদের পিঠে চড়ে কিংবা তাদেরকে পায়ের নিচে ফেলে। এই যে সিঁড়ি ভাঙার কল্পনা ও চেষ্টা এটা আগে কখনই এমন প্রকট ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তো আমরা সবাই একই সমতলে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এক সঙ্গে লড়ব এবং থাকব বলে। ত্যাগে, রক্ত বিসর্জনে অর্জিত হলো স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীন দেশে জায়গা-জমি, সুযোগ-সুবিধা সবকিছু অল্প কিছু মানুষের মুঠিবদ্ধ হতে থাকল, তারাই লাফিয়ে লাফিয়ে উন্নতি করতে থাকল। এখনো আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখছি অনেককে দাবিয়ে গোটা কয়েকের ওপরে উঠে যাওয়ার চিত্র।

দেশের পরিস্থিতিই হোক না কেন, ক্ষমতা কিংবা বলবানরা যে যেভাবে পারেন, উন্নতি করছেন। অনেকের মস্তিষ্কই তো এখন মনে হয় দেয়াল ও সিঁড়ি দিয়ে ঠাসা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনায় সবকিছু এগিয়ে চলেছে, সুখের বিষয় বটে। কিন্তু পাশাপাশি দুঃখের কারণও আছে। আমরা বৈদ্যুতিক বাংলাদেশ পেলেই সন্তুষ্ট হতাম। কেননা যতই আমাদের মধ্যে ডিজিটাল যোগাযোগ বাড়ছে, ততই অনিবার্য হয়ে পড়ছে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা এবং এত উন্নতির পরও বিদ্যুতের অভাবে কখনও কখনও সুস্থ থাকাটাই দায় হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের দেয়াল ও সিঁড়ির দাপাদাপিতে চিন্তিত না হতে পারি, কিন্তু এটা তো সত্য যে, অতীতে অনেক বড় বড় সভ্যতাই ধ্বংস হয়ে গেছে। কেবল যে প্রাকৃাতিক বিপর্যয়ের কারণে তা নয়, নৈতিক অধঃপতনও অনেক ক্ষেত্রে কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল বৈকি। আমরা জানি, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সম্প্রতি তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ে আমাদের ভূমিকম্পের ঝুঁকির বিষয়টি সামনে এসেছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার বা এসব ক্ষেত্রে সুরক্ষা বিধি অনুসরণে আমাদের সমাজে দায়িত্বশীলদের এখনও বড়ই চিন্তার অভাব দেখা যায়। শুধুই যে চিন্তার অভাব তাও কিন্তু নয়। আইন অমান্য কিংবা নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে অনেক ক্ষেত্রে উন্নতির অসম প্রতিযোগিতা বিপদাশঙ্কা প্রকট করে তুলছে। আমাদের দেশ প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সত্য বটে, কিন্তু সামাজিক যে অনাচার পরিলক্ষিত হচ্ছেÑ সেক্ষেত্রেও কিন্তু সামাজিক ভূমিকম্পের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কম্পন টের পাচ্ছি। সামাজিক ভূমিকম্প ঠেকাতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মাথাটা পরিষ্কার করা, মস্তিষ্ক থেকে দেয়াল ও সিঁড়ির উৎপাত হটিয়ে ফেলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ঐক্য না গড়লে বাঁচা তো নয়ই, টিকে থাকারও কোনো উপায় দেখি না। সমাজ পরিবর্তনের কাজটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। উন্নতি কখনই টেকসই হবে না, বৈষম্যের ছায়া যদি না সরানো যায়।

আমাদের যে রাজনীতি প্রয়োজন, সেটা প্রচলিত রাজনীতির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ। এটা শুধু মিছিল, বিবৃতিদান বা স্বার্থের গণ্ডিবদ্ধ থেকে সংঘর্ষের রাজনীতি নয়। এটা একাধারে সমাজকে পরিবর্তিত ও সমাজবিপ্লব তরান্বিত করার রাজনীতি। কেবল উৎপাদনের সাবলম্বী হওয়া নয়, সমবণ্টনও চাই।

 

  • শিক্ষাবিদ ও সমাজবিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা