ফারিহা জেসমিন
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৩ ১৫:১৮ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
পুরো পৃথিবীতেই জ্বালানি, খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা, মুদ্রাস্ফীতি, জলবায়ু সমস্যা এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার মতো সমস্যাগুলো নিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র উদ্বেগান্বিত। এমনকি বৈশ্বিক জোটগুলোও বিষয়গুলোকে অনুধাবন করেছে, যার মধ্যে জি-২০ একটি। ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’- প্রতিপাদ্য নিয়ে ২০২৩ সালের জি-২০ সম্মেলন শুরু হতে চলেছে। আয়োজক দেশ ভারত ইতোমধ্যে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ৯টি দেশকে এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। স্বভাবতই সম্মেলনটি নিয়ে দেশে নানা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। কারণ বর্তমান সময়ে যে সংকটগুলো নিয়ে বিশ্ব শঙ্কিত, সেগুলোই এ সম্মেলনে আলোচিত হবে।
বিশ্বের বৃহত্তম ২০টি অর্থনীতির একটি সম্মিলিত জোটকে
বলা হয় জি-২০, যার সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আছে যুক্তরাজ্য এবং
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা,
চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স,
জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া,
ইতালি, জাপান, মেক্সিকো,
রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ
আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তুরস্ক। সম্প্রতি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নতুন মোড় নিয়েছে এবং
জোটশক্তি হিসেবে জি-২০কেও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ রাশিয়াও এই জোটের সদস্য। ২৪
ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হওয়ার এক দিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত
হলো জি-২০ অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহের অর্থমন্ত্রীদের একটি বৈঠক। বৈঠকে জোটটির বাকি
১৮টি দেশ ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার প্রতি নিন্দা প্রকাশ করে যৌথ বিবৃতি দিতে সম্মত
হয়। কিন্তু রাশিয়া এবং চীন এর বিরোধিতা করে। ভারত যেহেতু তেলের
জন্য অনেকাংশে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল, তাই এ বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান রেখেছ এবং যেহেতু
জি ২০-এর বর্তমান সভাপতি ভারত; তারা চীন ও রাশিয়ার অসম্মতিকে ইস্যু হিসেবে
লিপিবদ্ধ করেছে।
জি-২০ সম্মেলনে ভারতের সভাপতিত্ব নিঃসন্দেহে দক্ষিণ
এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর জন্য আশাপ্রদ বিষয়। এর আগে ইন্দোনেশিয়া এ ঐক্যজোটের সভাপতিত্ব
করেছিল। এখান থেকেই বোঝা যায়, বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে ভারতের রাজনৈতিক এবং ভূ-কৌশলগত
গুরুত্ব কতটা। প্রশ্ন হলো, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সামিটকে কতটা সফলতার দিকে এগিয়ে
নিয়ে যেতে পারবে ভারত? ভারত ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সম্পর্ক বিবেচনায় এ প্রশ্নটি
বোঝা জরুরি। কারণ আমাদের দেশীয় স্বার্থও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
জি-২০ সম্মেলনে ভারত নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং
রাজনৈতিক আগ্রহ তুলে ধরার একটি বিরল সুযোগ পাবে আশা করা যায়। তা ছাড়া ভারতের
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা বিপুল
সম্ভাবনা তৈরি হবে স্বাভাবিক। আয়োজক দেশ হিসেবে নিজ দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণ,
বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ, জলবায়ু সমস্যা ইত্যাদি ইস্যুতেও ভারত অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর
একটি ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারবে। এশিয়া অঞ্চলে চীনা পরাশক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে
ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।
এ সম্মেলন আমাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে ৯টি
দেশকে ভারত আহ্বান জানিয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল
থেকে একমাত্র বাংলাদেশকেই আহ্বান জানানো হয়েছে। সন্দেহ নেই, গুরুত্বপূর্ণ এই
জমায়েতে বাংলাদেশকে ভারতের আমন্ত্রণ দুদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে।
সেই সঙ্গে অন্যান্য বৃহৎ এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ নানা বিষয়ে
একান্ত আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে। এসব ছাড়াও এই আমন্ত্রণ বিশ্ব মানচিত্রে
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা এবং শক্তির ইঙ্গিত দেয়। দক্ষিণ
এশিয়ায় ভারত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী হলেও এই ধারা অব্যাহত রাখতে ভারতের
বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকে নিজের
নিরাপত্তা এবং প্রভাব বজায় রাখতে এবং সেই অংশের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান দেশটির জন্য অত্যন্ত জরুরি।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অবস্থান বৃহৎ শক্তিগুলোর
মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে একটি বাস্তবতা। আর তাই বাংলাদেশকে উপেক্ষা
করে চীনকে দমিয়ে রাখা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। এই কঠিন বৈশ্বিক বাস্তবতায়
বাংলাদেশের সঙ্গে সুপ্রতিবেশীর মতো আচরণ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া ভারতের আর কোনো বিকল্প
নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশও মনে করে কোভিডপরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির নাজুক অবস্থা এবং
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জটিলতায় একটি টেকসই দক্ষিণাঞ্চল গড়ে তুলতে পারস্পরিক
সহযোগিতা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ
নানাভাবে জি-২০ জোটের সদস্যদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যা
রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য একটি বিরাট বাজার এবং সস্তা শ্রমবাজার হিসেবে লোভনীয়। অর্থনৈতিক
এবং রাজনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ জি-২০ সম্মেলনে
বিশ্বের কল্যাণে এবং নিজের উন্নয়নে একটি শক্ত অবস্থান নিতে পারে। ভুক্তভোগী দেশ
হিসেবে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা এবং এর কূটনৈতিক সমাধানে প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহের
সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা করতে পারে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ হতে পারে আরেকটি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জি-২০ সম্মেলনে অংশ নিয়ে উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু ইস্যুতে
জরুরিভাবে কাজ করার জোরালো দাবি জানাতে পারে বাংলাদেশ।
এ ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে টানাপড়েন, ডেভেলপমেন্ট এইড, নানা অর্থনৈতিক স্বার্থ, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে বৃহৎ শক্তিগুলোর সহযোগিতা কামনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে। বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আন্তরিক আলাপের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করি। সবশেষে যোগ করতে চাই, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত জি-২০ সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে একে আঞ্চলিক সৌহার্দ্য এবং সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এবং এই সামিটে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ এ বিষয়ে একটি কার্যকর পদক্ষেপ বললে অত্যুক্তি হবে না। বর্তমান বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানে এই প্ল্যাটফর্ম অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।