× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলে ধর্মনিরপেক্ষতা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৩ ১৫:২২ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাধ্যক্ষ রাও ফরমান আলী যে দক্ষিণপন্থি ছিলেন সে সম্পর্কে তার নিজস্ব স্বীকারোক্তি রয়েছে। ইসলামপন্থি দলগুলোর প্রতি তার পক্ষপাত স্পষ্ট। সত্তরের নির্বাচনের সময় ইসলামপন্থিদের সাহায্য করার জন্য শিল্পপতিদের ওপর চাপ দিয়ে ২২/২৩ লাখ টাকা যে তুলে দেওয়া হয়েছিল সেটা উল্লেখ করে তিনি দুঃখ করে বলছেন, টাকা দেওয়াতে তেমন একটা কাজ হয়নি। কারণ ইসলামপন্থিরা ৫-৬টি দলে বিভক্ত ছিল। তার একটি রচনাতে বেশ কয়েকটি সত্যের স্বীকৃতি আছে। যেমন তিনি বলছেন, আইয়ুব খানের সময় পাকিস্তানের ৪ ডিভিশন সৈন্যের বেতন আমেরিকা বহন করত। তিনি এটাও জানাচ্ছেন, লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ফরমান নিশ্চয়ই বলবেন যে এদের মধ্যে অবাঙালিরাও আছে। তা আছে বৈকি। কিন্তু যুদ্ধটা তো বাঙালিরা শুরু করেনি, যুদ্ধ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ রূপ নিয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে।

মনে হতে পারে অবিশ্বাস্য। যে ব্যক্তি গণহত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত, গণহত্যার ব্যাপারে যার কোনো দ্বিধা ছিল না, যিনি নিজেদের অস্ত্রবলের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে আলবদর-রাজাকার বাহিনী তৈরি করেছিলেন, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যার যোগাযোগ প্রত্যক্ষÑ তিনি কী করে স্বীকার করছেন যে তারা অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশুর ওপর নির্যাতন করেছেন এবং বাঙালিরা পাকিস্তানি নয়, তারা একটি স্বতন্ত্র জাতি? ব্যাখ্যা সম্ভবত এটা যে, ওই যে আদর্শবাদীটির মধ্যে একজন বাস্তববাদীরও অবস্থান ছিল। আদর্শবাদী ব্যক্তিটি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদকে রক্ষা করার জন্য নিকৃষ্টতম পদক্ষেপ নিতে পিছপা হননি, কিন্তু বাস্তববাদীকে মেনে নিতে হয়েছে যে ওতে কাজ হয়নি, স্বীকার করে নিতে হয়েছে যে বাঙালিরা একটি জাতি এবং একাত্তরে তারা তাদের নিজস্ব একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।

ফরমান আলী যে ভালো রকমের বাস্তববাদী ছিলেন তার প্রমাণ অন্যদের আত্মকথন থেকেও পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক জানিয়েছেন, ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া যখন ঢাকা ছাড়ছিলেন তখন পিন্ডিতে গিয়ে যে বক্তব্য তার প্রচার করার কথা, তাতে কী কী পয়েন্ট থাকা উচিত তার একটা খসড়া তালিকা ফরমান আলী ইয়াহিয়াকে ধরিয়ে দেন। পয়েন্টগুলো ছিল এ রকমের : মুজিবকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা চলবে না, বলতে হবে তিনি চরমপন্থিদের হাতে আটকেপড়া একজন দেশপ্রেমিক; বলতে হবে যে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, প্রটেকটিভ কাস্টডিতে নেওয়া হয়েছে মাত্র; এবং পূর্ব পাকিস্তানকে কী পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবেÑ তারও পরিষ্কার ধারণা বক্তৃতায় থাকতে হবে। বলা বাহুল্য, ইয়াহিয়া এসব পরামর্শ মোটেই গ্রাহ্য করেননি এবং সম্পূর্ণ উল্টো বক্তব্য দিয়েছিলেন।

পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ জিনিসটা ছিল কৃত্রিম। ছিল তা প্রতারণায় ভরপুর। ওই জাতীয়তাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটিও কৃত্রিম না হয়ে পারেনি। রাষ্ট্রের শাসকরা একে রক্ষা করার জন্য চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে প্রতারণাও করেছেন। এই কৃত্রিম রাষ্ট্রটি শাসিত হয়েছে সুবিধাভোগী সামরিক আমলাতন্ত্রের দ্বারা, যাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল বেসামরিক আমলাতন্ত্র।

উপমহাদেশের মুসলমানরা একটি অভিন্ন জাতি ছিল না, তারা ছিল একটি সম্প্রদায়। সম্প্রদায়কেই জাতি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল। এর পেছনে হিন্দু সম্প্রদায়ের সুবিধাভোগীদের চাপ ছিল। তারা নিজেদের জাতি হিসেবে পরিচয় দিত। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্তরা দেখল ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে সেটি একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হবে, যেখানে তারা স্থায়ীভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের অধীনে থাকবে। মুসলিম সম্প্রদায়ের সুবিধাকামীরা দাবি করল যে তারাও একটি জাতি, তাই তাদের অধিকার সংরক্ষিত রাখা চাই এবং সে জন্য একটি স্বতন্ত্র বাসভূমিই ছেড়ে দিতে হবে। ব্রিটিশের প্রস্থানের সম্ভাবনা যতই এগিয়ে এলোÑ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ততই শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকল এবং পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের জন্য একটি রাষ্ট্রই কায়েম করে ফেলল। হিন্দুস্থানি ও পাকিস্তানি, দুই দিকের এই দুই জাতীয়তাবাদের মধ্যে মিলটা দাঁড়াল এই যে উভয়পক্ষই রাজনীতির স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করল এবং ধর্মের সাহায্যে আচ্ছাদিত করে দিল অভ্যন্তরীণ শ্রেণিবৈষম্যকে।

কৃত্রিম জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটি নড়বড়ে ছিল। এর দুটি ভৌগোলিক অংশের মাঝখান ছিল হাজার মাইলের ব্যবধান। সামরিক আমলাতন্ত্রের প্রায় সবটাই ছিল পাঞ্জাবিদের দখলে। তাদের শাসনে দুই অঞ্চলের ভেতর বৈষম্য বাড়তেই থাকল। ভৌগোলিক দূরত্ব এবং বৈষম্য দুটোই ছিল রাষ্ট্রীয় ঐক্যের শত্রুপক্ষ। সেই সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্যও অতিদ্রুত পরিষ্কার হয়ে উঠতে থাকল। এই পার্থক্যের বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে। যেমন জাতীয় সংগীত ও দেশপ্রেমিক গান। পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত হিসেবে যেটি গৃহীত হয়েছিল সেটি পূর্ববঙ্গের মানুষের কাছে শুধু দুর্বোধ্যই নয়, ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। আবার বাংলা ভাষায় দেশপ্রেমিক বলে কথিত যেসব গান বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয় ছিলÑ সেগুলোর উপমা, সুর ও গাওয়ার ধরন এমনই ছিল যে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের কানে ওগুলো বিষ-বর্ষণ করত।

পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের যথার্থ প্রতিনিধি হিসেবে যদি কাউকে বেছে নিতে হয় তবে হাতের কাছেই পাওয়া যাবে ওই রাও ফরমান আলীকে। এর জাতীয়তাবাদ পুরোপুরি ধর্মভিত্তিক। এ ব্যাপারে তার জন্য আপসের কোনো স্থান নেই। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে তিনি এক রাখবেন জোর করে নয়, ভাষা চাপিয়ে দিয়েও নয়, রাখবেন ধর্মীয় আদর্শবাদের দ্বারা। হৃদয়েরও ভাষা আছে, যে ভাষা মুখের ভাষার চেয়ে শক্তিশালী, তিনি সেই ভাষার চর্চা করবেন। তার ধারণাÑ পূর্ব পাকিস্তানিরা পাকিস্তানকে অপছন্দ করেনি, পশ্চিম পাকিস্তানিদের অপছন্দ করেছে এবং এই অপছন্দটা দূর করা সম্ভব ধর্মীয় আদর্শবাদের অনুশীলনের দ্বারা। তিনি দক্ষিণপন্থি এবং বামপন্থিবিরোধী। কারণ বামপন্থিরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী।

ফরমানের মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা চলত বলে এই প্রতিষ্ঠানকে তিনি খুবই অবিশ্বাস করতেন। এটিকে ‘জয়’ করার অন্য উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত বলপ্রয়োগ করেছেন। মানুষের চেয়ে তার কাছে আদর্শ বড়; আদর্শের প্রয়োজনে প্রতারণা বৈধ, এমনকি মানুষ হত্যাও অবৈধ নয়। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন বলেই শুধু নয়, বড় কারণ ছিল তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন বলে।

হামুদুর রহমান কমিশনের কাছে অভিযোগ ছিল ফরমান আলী পূর্ব পাকিস্তানকে রক্তে লাল করে দিতে চেয়েছিলেন। ভুট্টো যখন বাংলাদেশে আসেন তখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ফরমান আলীর ডায়েরির একটি পাতা তাঁকে দেওয়া হয়, যাতে লেখা ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ প্রান্তর লাল রঙে রঞ্জিত করতে হবে।’ কমিশনের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে ফরমান আলী বলেছেন যে, কথাগুলো তার নিজের নয়, ভাসানী ন্যাপের নেতাদের। ১৯৭০ সালে পল্টন ময়দানের এক জনসভায় ওই কথাগুলো তারা বলেছিলেন। তাদের বক্তব্যের অর্থ ছিল এই যে, পূর্ব পাকিস্তানকে তারা সমাজতন্ত্রী না-করে ছাড়বেন না। এই ব্যাখ্যাটা হয়তো ঠিক, কিন্তু কথাগুলো তিনি যে গুরুত্ব দিয়ে ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলেন তাতে বোঝা যায় যে বক্তব্যটি তার মোটেই পছন্দসই ছিল না। বামপন্থিদের প্রতি বিদ্বেষের পাশাপাশি কট্টর ডানপন্থিদের প্রতি তার পক্ষপাত ছিল, যার দরুন একাত্তরের অক্টোবরে জাতীয় পরিষদের শূন্য ঘোষিত আওয়ামী লীগের আসনগুলো তিনি দক্ষিণপন্থিদের মধ্যে উৎসাহের সঙ্গে ও উদার হস্তে বণ্টন করে দিয়েছিলেন। সাধারণ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী একটিও আসন পায়নি, অথচ তাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছিল গুনে গুনে পঞ্চাশটি আসন; নেজামে ইসলামের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। অথচ তারাও পেয়ে গেছে পাঁচটি আসন।

তদন্ত কমিটি যে ফরমান আলীর প্রশংসা করবে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তাদের দিক থেকে তার মধ্যে একজন খাঁটি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীর সন্ধান পাওয়ার কথা। অন্যরা হয় অসম্পূর্ণ, নয় বিচ্যুত। আমরা বলব যে, তাকে জানলে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের যথার্থ স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে ভালো একটি ধারণা পাওয়া যায়। একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে ওই স্বভাব ও চরিত্র দুটোই পরিপূর্ণরূপে উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল।

পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের তুলনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে অগ্রসর, তার প্রমাণও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পরিষ্কারভাবে পাওয়া গেছে। অগ্রসরতার বিশেষ প্রমাণ এর ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র। কিন্তু ওই জাতীয়তাবাদের পক্ষে কি বাঙালির মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? না, হয়নি। না হওয়ার কারণ এর অভ্যন্তরে পুঁজিবাদী তৎপরতা।


  • শিক্ষাবিদ ও সমাজবিশ্লেষক 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা