খন্দকার ফারজানা রহমান
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৩ ১৩:৪৭ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
‘মাদকপ্রবণ এলাকা
ঘোষিত হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার’ শিরোনামে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত
হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগর ও কক্সবাজার জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা
হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির
সুপারিশে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে এবং এ বিষয়ে রূপরেখা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। জাতীয়
সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে দেশের ওই দুই এলাকাকে আমাদের মাদক প্রবেশের সবচেয়ে
বড় রুট মনে করা হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে সংসদীয় কমিটির এ সিদ্ধান্তকে
সাধুবাদ জানাতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে মাদক কারবারের অশুভ
চিত্র স্পষ্ট। প্রতিনিয়ত মাদক সম্পর্কে যেসব খবর জানা যায়, তা যেমন উদ্বেগেরÑ তেমনি
উৎকণ্ঠারও।
চলতি বছর একটি
জরিপের ফল থেকে জানা যায়, আমাদের পশ্চিমাঞ্চল সীমানা দিয়ে দেশে ঢুকছে আফগান হেরোইন।
আফগানিস্তানে উৎপাদিত হেরোইন শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢোকার
পর বিক্রি হয় খুচরা পর্যায়ে। এই মাদকের ক্রেতা বিশেষত তরুণদের একাংশ। তবে আরেকটি বিষয়ও
উদ্বেগের যে, আমাদের মাদকসেবীদের মাঝে নারীর অংশগ্রহণও উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাবাহিনীর পরিচালিত অভিযানের পর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, অধিকাংশ এলাকাতেই
গড়ে উঠেছে নারীনির্ভর হেরোইনচক্র। শুধু তাই নয়, মাদক চোরাকারবারে মাসিক বেতনে প্রতিনিধি
রাখার খবরও সংবাদমাধ্যম থেকেই জানা যায়। সমাজের এই দুষ্টক্ষত নিয়ন্ত্রণে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর চেষ্টার কমতি নেই। কিন্তু
উদ্বেগজনক হলেও সত্যি, এক্ষেত্রে সাফল্য কম। এ অবস্থায় দেশে মাদক প্রবেশের সবচেয়ে বড়
রুট বিবেচেনায় এনে দুটি এলাকাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে অপরাধ এবং বিষয়ের
গুরুত্ব যেমন স্পষ্ট হবে, তেমনি সংসদীয় কমিটির এ সিদ্ধান্ত মাদক কারবার কমাতেও ভূমিকা
রাখবে। যুবসমাজের একটি বড় অংশ ক্রমশ মাদকে আসক্ত ও জড়িত হয়ে পড়েছে। ফলে মাদক চোরাচালানের
ঘটনা যেমন বাড়ছে, তেমনি এ মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে অন্যান্য অপরাধের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, মাদক চোরাচালানে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও জড়িয়ে পড়া। নারীদের
প্রধানত ব্যবহার করা হয় ক্যারিয়ার হিসেবে। আর এক্ষেত্রে মাসিক বেতনে দরিদ্র নারীর অসহায়তার
সুযোগ নিয়ে সহজেই তাকে এমন অপরাধে যুক্ত করা সম্ভব।
আমরা মাদক
উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও মাদকের ভয়াবহতার শিকার। আমাদের আশাপাশের অনেক দেশেই মাদক উৎপাদিত
হয়। ফলে ভৌগোলিক কারণেই আমরা মাদকের শিকার হচ্ছি।এ থেকে পরিত্রাণ পেতে জরুরি সাড়াশি
অভিযান। সংসদীয়
কমিটির বৈঠকে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব জানিয়েছেন, ‘মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল
মেথ, ভারত থেকে হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিল ও ইনজেকটিক ড্রাগের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটে।’
এ ছাড়া সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মাদকদ্রব্যগুলোর
মধ্যে অন্যতম হেরোইন আফগানিস্তানে উৎপাদিত হয়ে ভারত থেকে আমাদের সীমান্তবর্তী জেলা
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢুকছে। সেখান থেকে কয়েকবার হাত
বদল করে ধাপে ধাপে পৌঁছে যাচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। র্যাব ও পুলিশের তথ্যানুযায়ী,
বাংলাদেশে মাদক ঢোকে ভারতের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ এলাকা দিয়ে। এরপর সিন্ডিকেট মুর্শিদাবাদ
ব্যবহার করে রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানা এলাকার পদ্মার চর, সুলতানগঞ্জ, কোদালকাটি, চর আশারিয়াদহ,
মানিকের চরে চালান পৌঁছে দেয়। তাদেরই অন্য চক্র মালদহ দিয়ে চাঁপাইয়ের সদর থানার চরবাগডাঙ্গা,
সুন্দরপুর, শাহজাহানপুর ইউনিয়ন ব্যবহার করে হেরোইন আনছে। এসব মাদক দেশে ঢোকার পর বিভিন্ন
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে অনেক নারী সদস্য জড়িত রয়েছে। সম্প্রতি
গ্রেপ্তার হওয়া মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত এক প্রতিনিধির দেওয়া তথ্য বলছে, প্রত্যেক
গ্ৰুপেই ১০ থেকে ১২ জন করে নারী সদস্য রয়েছে এবং মূলত সেবকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজগুলো
এই নারীরাই করে থাকে। পরিবহনের জন্য তাদের ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ দেওয়া
হয়। সাধারণত গ্রেপ্তার এড়াতে মাদকের সঙ্গে জড়িত এসব সিন্ডিকেট নারী সদস্যদের ব্যবহার
করে। এ ছাড়াও এসব নারী সদস্যের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীও রয়েছে। সম্প্রতি
প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত অন্য একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইয়াবা রাখার অভিযোগে
রাজধানীর আদাবরের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে গ্রেপ্তার
করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই ছাত্রী জানিয়েছে, সে ও তার পরিবার
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পথে ঢাকায় ইয়াবা এনে বিক্রি করত।
সমাজবিজ্ঞানী
রবার্ট কে. মার্টনের মতে, চারদিকে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার জন্য যারা নিম্নবিত্ত
বা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয়, তাদের মধ্যে এক ধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হয়। ফলে তারা
অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিভিন্ন অসামাজিক পন্থা বেছে নেয়। সে জন্য অনেক ক্ষেত্রেই
অসুস্থ প্রতিযোগিতা যেমনÑ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, দুর্নীতি এবং মাদক ও অবৈধ জিনিস চোরাচালানের
মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে
নারীরাও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা চায় এবং তাদের সুযোগসুবিধা কম থাকায় মাদক চোরাচালানের
মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
মাদক চোরাচালান
ও নারীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি যদিও সাম্প্রতিক সময়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে খুব আলোচিত
নয়, তারপরও এটি প্রতিরোধে বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন। সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করা,
উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি এবং স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় স্তরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর
মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের পাশাপাশি নারীদের সম্পৃক্ততা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে শিক্ষা ও
চাকরিতে বিনিয়োগ এবং তাদের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক চাপ ও ব্যক্তিগত
ট্রমা অনুভব করা নারীদের জন্য সহায়তা এবং পরিসেবা প্রদান অপরাধমূলক কার্যকলাপের ঝুঁকি
কমাতে সাহায্য করতে পারে। অবশেষে, অপরাধমূলক কার্যকলাপের প্রভাব এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি
সম্পর্কে পারিবারিক শিক্ষা এবং সচেতনতা নারীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে নিরুৎসাহিত
করতে সাহায্য করতে পারে।
সর্বোপরি, মাদকের রুটগুলো শনাক্ত করে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা পুরোপুরি সম্ভব হয়তো নয়। কারণ আধুনিক সময়ে অপরাধের নতুন পন্থা প্রতিনিয়ত তৈরি করা হচ্ছে। তবে দেশের জনগণ যেন অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য আইনি পদক্ষেপ জোরদার করা জরুরি। মাদক ব্যবসার মাধ্যমে দ্রুত অর্থ আয়ের সম্ভাবনা থেকেই অনেকে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। এই ভয়াবহ আগ্রাসন ঠেকাতে সর্বাগ্রে নজর দিতে হবে উৎসে।