× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বৈশ্বিক খাদ্যসংকট ও আমাদের বাস্তবতায় করণীয়

এ এম এম শওকত আলী

প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৩ ১৩:৫২ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

২০২২ সাল থেকে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় নানা প্রতিবন্ধকতা এবং সমস্যার কারণে খাদ্যসংকটের আশঙ্কা বেড়েছিল। চলতি বছরে জলবায়ু পরিবর্তন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতিসহ বৈশ্বিক রাজনীতিতে অস্থিরতার কারণে খাদ্যসংকট নিয়ে উদ্বেগ নতুন করে দেখা দিয়েছে। এমনকি আমাদের দেশে চালের দামবৃদ্ধি ও গমের সরবরাহ নিয়েও উদ্বেগ বেড়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘গম নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি দেশের আমদানিচিত্র পাল্টে যাওয়ার খবর দিয়েছে। সঙ্গত কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্যসংকট মোকাবিলায় কৃষির উৎপাদনে বেশি জোর দিয়েছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে খাদ্যসংকট মোকাবিলায় আমদানি ব্যবস্থা সুচারু করার বিকল্প নেই। উৎপাদনমুখী অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার পাশাপাশি পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে চৌকস করার কথাও ভাবতে হবে।

অতীতেও আমাদের খাদ্যসংকট ছিল। আগে প্রতিবছর গড়ে আড়াই মিলিয়ন মেট্রিক টন গম আমদানি করতে হয়েছে। এমনকি আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চালও আমদানি করতে হয়েছে এবং এখনও করতে হয়। খাদ্যশস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা এখনও পিছিয়ে রয়েছি। তাই খাদ্যসংকটের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। কিন্তু চলমান বৈশ্বিক সংকটে নিত্যপণ্য ও আমদানিপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় এ সংকট পুরো বিশ্বে ঘনীভূত হয়েছে। পুরো বিশ্বই যখন বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত, তার প্রভাব থেকে আমরাও সহজে মুক্ত হতে পারি না। চলতি বছর খাদ্যসংকটের মূল কারণ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হচ্ছে। রাশিয়া থেকে আমাদের চাহিদার উল্লেখযোগ্য গম আমদানি হয়। এ কারণে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি নিয়ে একটু চিন্তাক্লিষ্ট হতেই হয়েছে। বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করে। চাল, গম কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি সাধারণত প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকেই করা হয়। আমদানির কাজ সরকার যেমন করে থাকে, তেমনি ব্যবসায়ীরাও করেন। যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনে এ কথা সত্য, পুরো বিশ্বের সিংহভাগ গমের জোগান রাশিয়া ও ইউক্রেন দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে আমরা ভারতের ওপর নির্ভর করি। এখন ভারতে চলতি বছর গম কম উৎপাদিত হয়েছে। তাই তারা গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবছে। যদি তা হয় তাহলে আমাদের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে। তবে চাল-গম আমদানি কমে যাওয়ার জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকেই প্রধান কারণ ভাবার কোনো কারণ নেই। যদিও ব্যবসায়ীরা বিশ্ববাজারে মূল্যের গড়পতন দেখে অনেক সময় ইউক্রেন-রাশিয়া থেকেও গম আমদানি করতে পারেন। তবে আমরা পুরোপুরি গমের জন্য ইউরোপের ওপর নির্ভরশীল নই। সে জন্য আমাদের পার্শ্ববর্তী কোন দেশ থেকে আমদানি করতে পারি, সে বিকল্প পথ অনুসন্ধান করে সঠিক সময়ে যেন আমদানি করা যায়, সে বিষয়ে ভাবতে হবে।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ওই প্রতিবেদনটিতে এও বলা হয়েছে, খাদ্যসংকটের বিষয়টি বাস্তবেই জনজীবনে প্রভাব ফেলছে। অনেক স্থানে ওএমএসে শুধু চাল দেওয়া হচ্ছে। গমের আমদানি কম, তাই আটা দেওয়া হচ্ছে না। অবশ্য ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে ওএমএসের বিতরণ ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অসন্তোষের খবরও ওঠে এসেছে। চলমান কার্যক্রমে কিছু ঘাটতি আছে দেখে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এমনকি টিসিবির পণ্যের মতো ওএমএসের পণ্যও কার্ডের মাধ্যমে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে হয়। তবে ওএমএসের চলমান কার্যক্রমে ঘাটতির বিষয়গুলো শনাক্ত করে সমাধানের ক্ষেত্রে কি করণীয় তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। মনে রাখতে হবে, ওএমএস সবার জন্য নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়মিত কেনার সামর্থ্য নেই, নিঃস্ব কিংবা অসহায় মানুষদেরই ওএমএসে পণ্য দেওয়া হয়। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই ওএমএস চালু রয়েছে। দরিদ্রদের সাহায্য দেওয়ার জন্যই এ ব্যবস্থা চালু হয়। সে জন্য সব শ্রেণির ভোক্তা এখানে ভিড় করলে ভোক্তার চাহিদাপূরণ হওয়ার নয়। বাজারব্যবস্থায় সিন্ডিকেট অবশ্যই ভোক্তার চাহিদাপূরণে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। তবে ভোক্তার চাহিদাপূরণে রাষ্ট্র যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তা সুচারুরূপে যেন সম্পন্ন হয়, এ বিষয়ে এখন মনোযোগ দেওয়া জরুরি। ওএমএস সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলে এই ব্যবস্থা এক সময় ধসে পড়বে। সে হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনাটিকে সাধুবাদ জানাতেই হবে।

এর পরও নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধি নিয়ে নানা উদ্বেগ রয়েছে। সামনে রমজান। এ সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বাড়ে। চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে যেন আগুন লেগে যায়। কতিপয় মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য মজুদ করে রাখেন এবং সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। আমাদের বাজারব্যবস্থাই এমন যে অসাধু ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সুযোগসন্ধানে ওঁৎ পেতে থাকেন। এমনকি কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হওয়ার পরও আমরা মধ্যস্বত্বভোগীদের অস্তিত্ব নির্মূল করতে পারছি না। এসব ছাড়াও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। নানা মহলে এ নিয়ে প্রায়শই প্রশ্ন ওঠেÑ দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা দায়ী কি না, সিন্ডিকেটই সমস্যা করছে কি না, সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ আদৌ নিচ্ছে কি না ইত্যাদি। কিন্তু এই সমস্যা নিরসনে ভোক্তার সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। ভোক্তা যখন তার চাহিদার নিরিখে জোগানের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে, তখন যেকোনো অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন। তখন বাজারে কোনো অসাধু ব্যবসায়ীগোষ্ঠী সুযোগসন্ধান করতে পারবে না। যখন বাজারে একজন ভোক্তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন, তখন স্বভাবতই ব্যবসায়ীরা সতর্ক হয়ে উঠবেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে ভোক্তার সচেতনতা একেবারেই নেই। এখানে ভোক্তা নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করছেন। ভোক্তার সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নীতিনির্ধারকরা চিন্তা করতে পারেন। অবশ্য দেশে ভোক্তা অধিকার দিবসসহ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মাঠপর্যায়ে ভালোমতোই দায়িত্বপালন করছে। তবে বাজারব্যবস্থায় অবাধ দামবৃদ্ধি রোধের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং মাঠপর্যায়ে তাদের কার্যকারিতা বাড়াতে হবে। এ দায়িত্ব সরকারের। সরকার যদি এসব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে পারে, বাজারব্যবস্থায় বিদ্যমান অনেক সংকটই সমাধান করা সম্ভব।

সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি এবং খাদ্য সংকটের উদ্বেগ থেকে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির মূলনীতিগুলোই কি আমাদের জন্য সমস্যা হয়েছে কি না। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু আছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচলন অনেক আগে হলেও সরকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু পণ্যের ওপর নিজ নিয়ন্ত্রণ রেখেছে। বিশেষত খাদ্যশস্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে। দেশে এই অর্থনীতি আদৌ আমাদের জন্য সুফল আনছে নাকি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা বোঝা একটু জটিল বৈকি। কারণ পশ্চিমারা যে অর্থে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণাকে ব্যবহার করে, আমরা সে অর্থে তা নেইনি। আমাদের এখানে ব্যবসায়ীদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তবে সরকার কিছু বিষয়ে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। এমনকি বাজারে ভারসাম্যের জন্য নানা উপকরণও ব্যবহার করে। যেমন ওএমএস এমনই একটি উপকরণ। মুক্তবাজার অর্থনীতির কিছু ভালো দিক রয়েছে অবশ্যই। এ বাজারব্যবস্থার কারণে পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত হয়। এমনকি ভোক্তাও তার ইচ্ছানুসারে পণ্য কিনতে পারেন। আমাদের দেশে অবশ্য অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্য লুকিয়ে রাখে কিংবা পরে বেশি দামে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে গুদামজাত করে। এ ছাড়া এলসি আমদানির ক্ষেত্রে এমনভাবে রাখা হয় যেন অভাবের পরিস্থিতি সব সময় বিরাজমান থাকে। এসব কারণে মুক্তবাজার অর্থনীতির ভালো দিক আমরা টের পাই না। অসাধু মহলের কারসাজি বন্ধে কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করতেই হবে।

মুক্তবাজার অর্থনীতির সুফল পেতে হলে যে সমস্যাগুলোর কথা বলেছি, সেগুলো সমাধানের কথা ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রত্যেককেই তৎপর হয়ে উঠতে হবে। ভোক্তা যেন তার পছন্দ ও চাহিদা অনুসারে পণ্য কিনতে পারে তা নিশ্চিত করার সদিচ্ছা রাখলে পণ্য সরবরাহ অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। মনে রাখতে হবে, বাজারে চাহিদার অনুপাতে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখাই মুক্তবাজার অর্থনীতির মূলনীতি। যদিও এই সাফল্যের ক্ষেত্রে সরকারের খুব বেশি কিছু করার নেই। ব্যবসায়ীদের দায়দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। ব্যবসায়ীরা দায়িত্বশীল হলে কোনো সমস্যাই থাকার কথা নয়। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণেও ব্যবসায়ীরা ভূমিকা রাখতে পারে।

পরিশেষে বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের বিষয়টি আমলে রাখতেই হবে। রাষ্ট্র গরিব মানুষদের চাহিদাপূরণের দিকেই জোর দিবে। সংকটে নিঃস্ব, অসহায় ও দুস্থ মানুষদের পণ্য সরবরাহ করার প্রস্তুতি রাখতে হবে এবং তাদের শনাক্ত করার একটি সুষ্ঠু পদ্ধতি তৈরি করতে হবে এবং এর ফলে খাদ্যসংকট মোকাবিলার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হবে। 


  • সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা