× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সিদ্দিকবাজার ট্র্যাজেডি : বোমার ওপর বসবাস, লাশের পর লাশ

ড. আকতার মাহমুদ

প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩ ১৫:৫৯ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

‘টেকসই নগর ও জনপদ’ এসডিজির ১৭টি বৈশিষ্ট্যের অন্যতম। জাতিসংঘ এই লক্ষ্যগুলো প্রণয়ন করে ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা’ হিসেবে প্রচার করেছে, যা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক। ‘টেকসই নগর ও জনপদ’-এর লক্ষ্য সাধারণের জন্য নগরকে নিরাপদ করা। কিন্তু আমাদের বেলায় কি বিষয়টি শতভাগ খাটছে? গত ৭ই মার্চ রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এর কয়েকদিন আগে রাজধানীর ব্যস্ততম আরেকটি এলাকার ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এর দুদিন আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ঘটেছে আরও একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা। এই যে পরপর কয়েকটি ঘটনা, এর পেছনের কারণগুলো কী? অনেকে এর সঙ্গে নাশকতার সম্পর্ক দেখছেন। যদি তেমনটি হয়, তবে খতিয়ে দেখে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তবে রাজধানীতে পরপর দুটি বিস্ফোরণের পেছনে প্রাথমিকভাবে জমানো গ্যাসকে দায়ী মনে করা হচ্ছে। এই যে ভবনগুলোতে গ্যাস জমছে, তা আসছে কোথা থেকে? তা জমছে ভবনে থাকা গ্যাসের লাইন অথবা সুয়ারেজের লাইনের মাধ্যমে। জমা হওয়া গ্যাসই এক সময় হয়ে উঠছে বিস্ফোরক। এর অর্থ, আমরা প্রত্যেকেই যেন বসবাস করছি এক বোমার ওপর!

ভবনে গ্যাস জমার পেছনের কারণগুলো অজানা নয়। কিন্তু জানা কারণগুলো কোন অজানা কারণে সমাধান হয় না? আমাদের ভবন নির্মাণে ত্রুটি রয়েছে। ত্রুটি দেখার জন্য দায়িত্বশীল সংস্থা ও জববল রয়েছে। কিন্তু ত্রুটি সংশোধনে বাধ্য করতে কার্যত উদ্যোগ নেই। আমরা কোনো একটি ঘটনা ঘটার পর প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি। কিন্তু সেই প্রতিক্রিয়া ঘটনা ঘটার আগে জানাচ্ছি না। অথচ এই প্রতিক্রিয়া যদি আগেই দেখানো যায়, তাহলে লাশের পর লাশ দেখার মতো বেদনাদায়ক অধ্যায়ের জন্ম হতো না। এ জন্য আমাদের আগেই দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু সেই দায়িত্ব নিতেই যেন আমাদের অনীহা। আমাদের প্রস্তুতি নেই। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের ঢাল নেই তলোয়ার নেই, পালন করছি নিধিরাম সর্দারের ভূমিকা। সিদ্দিকবাজারের যে ভবনটিতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটল, ওই ভবনটিতে যথানিয়মে তদারকির বিষয়গুলো কাজ করেছে, এমনটি জানা যায়নি। ভবনটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় ছিল, তাও জানা যায়নি। আসলে সত্যিকার অর্থে ঝুঁকি রোধে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষগুলোর কার্যকর ভূমিকা বা পদক্ষেপ কম।

পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকা। আমাদের এই দুই এলাকার জন্য কিন্তু একই ধরনের পরিকল্পনা ফলপ্রসূ না। কারণ দুই এলাকার প্রেক্ষাপট দুই রকমের। দুই এলাকার ঝুঁকি দুই রকম। পুরান ঢাকার মানুষ নগরকে অতীতে যেভাবে ব্যবহার করেছে, তেমনটি করার সুযোগ এখন আর নেই। বর্তমানের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেকেই হয়তো পুরান ঢাকার সংস্কৃতির কিংবা ঐতিহ্যের কথা বলবেন। তারা বলবেন ব্যবসা এবং বসতিÑএ এলাকায় একই সঙ্গেই হয়ে আসছে। কিন্তু এর সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তো বটেই, আগের নিরিখেও দ্বিমত পোষণ করি। কারণ, বর্তমানে এ এলাকায় যেভাবে প্লাস্টিকের সামগ্রী, কেমিক্যাল, বিস্ফোরক বস্তুর গুদাম তৈরি হয়েছে, তা তো কখনই এ এলাকার সংস্কৃতির অংশ ছিল না। এগুলোর সবই তো নতুন বিষয়। অন্যদিকে নতুন ঢাকাতে যেসব বহুতল বিল্ডিং উঠছে, তা হচ্ছে নির্দিষ্ট নকশা অনুযায়ী। ভবনের নকশা অনুমোদন করছে অনুমোদিত কর্তৃপক্ষ। অথচ সেই অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন করে, ভবন মালিক এবং অনেক সময় অনেক অসাধু ডেভেলপার কোম্পানি ভবন নির্মাণ করছে। নকশা পরিবর্তন বা নির্ধারিত নকশা অনুযায়ী ভবনগুলো উঠছে কি না তা দেখার জন্য রয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাদের নিয়োজিত পরিদর্শকও রয়েছে। কিন্তু সেই কাজগুলো কি যথাযথভাবে সম্পাদন হচ্ছে? যথাযথভাবে সম্পাদন হলে তো বারবার এমন বেদনাদায়ক অধ্যায়ের জন্ম হতো না।

নানাক্ষেত্রে অপরাধ ঘটছে এবং অপরাধের ফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ। এ জন্য তদারকির ক্ষেত্র বাড়ানো প্রয়োজন। আইন অনুযায়ী কোনো ভবনে বসবাস বা ব্যবহারের আগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের থেকে ভবন ব্যবহার বা বসবাসের সনদ নিতে হয়। আইনটি চালুর পর পেরিয়েছে প্রায় এক দশক। এ সময়ে রাজধানীতে ভবন হয়েছে প্রায় অর্ধলক্ষ। প্রশ্ন রাখা যায়, এসব ভবনের সবগুলো কি ব্যবহার সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) নিয়েছে? এই ভবনগুলো কি নির্ধারিত নকশা ও নিয়ম মেনে নির্মাণ হয়েছে? এসব বিষয়ের কিছুই নিয়মিত তদারকি হয় না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারিই-বা কতটা, তাও অজানা। নিয়মিত তদারকি হলে নকশায় পরিবর্তন এনে ভবন নির্মাণ হলে তা ধরা পড়ত। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনও চিহ্নিত হতো। ভবন ব্যবহারের সনদ না নিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু কখনও কারও বিরুদ্ধে এ আইন কার্যকর হয়েছে, এমনটিও শোনা যায় না। আবার এই যে এত এত দুর্ঘটনা, এ ক্ষেত্রে নগরবাসীরও যে সচেতনতা প্রয়োজন, সেদিকটিও উপেক্ষিত। কারণ ভবনে বসবাসের জন্য যে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের সনদ নিতে হয়, তা অনেকেরই অজানা। আবার যারা জানেন, তারাও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত নন। ভবন ব্যবহার বা বসবাস সনদেরও রয়েছে নির্ধারিত মেয়াদ। প্রতি পাঁচ বছর পর সনদ নবায়ন করা বাধ্যতামূলক। এতে যে বিষয়টি নিশ্চিত হয়, তাহলো ভবনগুলো চিহ্নিত হয় ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে। নিয়মিত তদারকির ফলে এসব ভবনে গ্যাস বা বিদ্যুতের লিকেজ, গ্যাস জমার মতো বিষয়ে অসতর্কতা, অগ্নিঝুঁকি থেকে নিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি হয়। কিন্তু তদারকির অভাবে এবং আইন না মানায় র্নিধারিত এই কাজগুলো ঠিকভাবে হয় না বিধায়ই প্রতিনিয়ত মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটছে এবং ঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতাও।

এ ক্ষেত্রে ভবন নির্মাণের ত্রুটি সংশোধন করতে হবে। সেই ত্রুটি সংশোধনের জন্য ভবনগুলো নিয়মিত তদারকির আওতায় আনতে হবে। ত্রুটি দেখা দিলে তা মেরামতের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস এই তিনটি সংস্থার কাজের মধ্যে সমন্বয় আনতে পারলেও দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনাপরবর্তী হতাহতের সংখ্যা কমানো সম্ভব। সংস্থা তিনটির কাজের মধ্যে সমন্বয় হলে তারা ঝুঁকিহ্রাসে অধিক ভূমিকা রাখতে পারবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেটা কীভাবে সম্ভব? পুরো শহরকে যদি ছোট ছোট ব্লক ও ওয়ার্ডে ভাগ করা যায় এবং সে অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তাহলে কাজ অনেকটা সহজ হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এ সমস্যার সমাধান একদিনে বা রাতারাতি সম্ভব না। চট করে যদি সমস্যার সমাধান ভাবা হয়, বিশেষত কোনো দুর্ঘটনার পরই যখন নানামুখী তৎপরতা দেখা যায়, সেগুলো স্থায়ী সমাধান নয়, সেগুলো হলো তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া। কিন্তু স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। না হলে নিমতলী, কদমতলী, চুড়িহাট্টা, সিদ্দিকবাজারের মতো মর্মান্তিক ঘটনা বারবার ঘটতেই থাকবে। আর ঘটনার পর যত উদ্যোগই নেওয়া হোক, তা স্থায়ী সমাধান না এনে লোকদেখানো কর্মকাণ্ড হিসেবেই চিহ্নিত হতে থাকবে। আমাদের এর বাইরে আসতে হবে। এজন্য ভবনগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ব্যবহারোপযোগী করতে হবে, নিরাপদ করতে হবে।

বিল্ডিং ডিজাইনে পরিবর্তন আনতে ভবন মালিক, ভূমি ব্যবহারকারীদের নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা বাড়ি বানাতে গিয়ে বক্স বানিয়ে ফেলি। প্রতিটি ভবনের মাঝে, বিশেষত দুই ভবনের মাঝের জায়গা ক্রমেই কমেছে। একটি বাড়ির জানালার সঙ্গে অন্য বাড়ির লাগোয়া জানালা। এ জন্য কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার তৎপরতা চালানোও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই সব থেকে প্রথমে দরকার সচেতনতা। এই সচেতনতা আসতে হবে নাগরিকদের ভেতর থেকে, সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। সেই সঙ্গে দরকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ। যদি অপরাধের শাস্তি না হয়, তাহলে পুনঃপুন অপরাধ ঘটবেই। অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে। কাঠামোগত কারণে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, কিন্তু যত দিনই গড়াক, অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নিকট অতীতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলগুলোর তরফে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিরসনে শিল্পকারখানাসহ সম্ভাব্য সবখানে তদারকি বাড়ানো হবে। কিন্তু দুভার্গজনক হলেও সত্য, এরও কোনো প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনি। দায় কিন্তু সুনির্দিষ্ট এবং এই দায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কোনো মহলই এড়াতে পারেন না। তবে এ ক্ষেত্রেও দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হলো, কেউই যেন দায়ের ভার নিতে রাজি নন। অথচ এই যে একের পর এক ঘটনা ঘটছে, এগুলো তো নিছক দুর্ঘটনা নয়। কাঠামোগত ত্রুটির ভয়াবহ ফল। এও এক ধরনের হত্যাকাণ্ড। ব্যবস্থাগত ত্রুটির বিরূপ ফল। লোকমুখে প্রচলিত এ কথাটিকেও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। 


  • নগর পরিকল্পনাবিদ ও অধ্যাপক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা