× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ঝুঁকির মধ্যে বসবাস নিয়তি হতে পারে না

রাশেদ মেহেদী

প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৩ ১৪:০৯ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

ভূমিকম্প নয়, বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নাশকতা বলেও কেউ তথ্য উপাত্ত হাজির করছেন না। তবু গত সপ্তাহজুড়েই ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপেছে দেশ। ৫ মার্চ রাজধানী ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় এবং ৭ মার্চ গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজার এলাকায় পৃথক দুটি বিস্ফোরণে দুটি ভবনের কিছু অংশ উড়ে গেছে। দুটি ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাচিত্র অনেক স্ফীত। ধারাবাহিক ভয়াবহ বিস্ফোরণের শুরুটা হয়েছিল ৪ মার্চ দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায়। সেখানে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট নামে একটি সিলিন্ডারজাত অক্সিজেন উৎপাদন কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৬ জন নিহত হন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এসব বিস্ফোরণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির নাশকতা হিসেবেও সন্দেহ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন। আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকার দুর্ঘটনার দায় এড়ানোর অপকৌশল হিসেবে বিরোধী দলকে দোষারোপ করছে’। অর্থাৎ এত মানুষের প্রাণহানি, আর্তনাদও রাজনীতিবিদদের মানবিক করে তোলে না উপরন্তু তারা দুঃসময়েও কাঁদা ছোড়াছুড়ির সংকীর্ণ রাজনীতিতেই জড়িয়ে পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন! তবে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের প্রাথমিক তদন্তে রাজধানীর দুটি ভবনেই বিস্ফোরণের মূল কারণ উঠে এসেছে। কারণটা হচ্ছে, রাজধানীতে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস বিতরণে নিয়োজিত রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি তিতাসের পরিত্যক্ত গ্যাস লাইন থেকে গ্যাসের লিকেজ। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তিন দিন ধরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বিভিণ্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এর মূল কথা হচ্ছে, সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরিত ভবনটির বেসমেন্টে এক সময় খাবারের দোকান এবং রান্নাঘর ছিল। সেখানে তিতাসের বাণিজ্যিক লাইন ছিল। ২০০১ সালে রান্নাঘরের গ্যাস সংযোগের লাইনটি রাইজার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু রাইজার পর্যন্ত পরিত্যক্ত পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয়নি, যে কারণে যেকোনো মুহূর্তে এই পাইপলাইন কিংবা রাইজারের অংশে লিকেজ থেকে বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি বছরের পর বছর ধরেই ছিল। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, সম্ভবত ওই পরিত্যক্ত পাইপলাইনের লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে নিচতলার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে জমা হয়েছিল। একটা পর্যায়ে ওই গ্যাস কোনো স্ফুলিঙ্গ বা কোনোভাবে আগুনের সঙ্গে সংস্পর্শে এসে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা আরও জানান, বিস্ফোরণের পরপরই যখন তারা উদ্ধারকাজে যান তখন ভবন থেকে তীব্র মিথেন গ্যাসের গন্ধ আসছিল। বিষয়টি তিতাসকে জানানোর পর দ্রুত তিতাস কর্তৃপক্ষ ওই এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখে এবং তিতাস এর বিপরীত বক্তব্য দেয়।

রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবেও ভবন বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে তিতাসের লাইন থেকে গ্যাস লিকেজের কথাই বলা হয়েছে। নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুল গনি সাংবাদিকদের জানান, সায়েন্স ল্যাবের বিস্ফোরিত ভবনটির তিন তলাতেও তিতাসের গ্যাসের সংযোগ লাইন পাওয়া গেছে। ওই ভবনের তৃতীয় ও দ্বিতীয় তলায় বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। অথচ তিতাস কর্তৃপক্ষ বিস্ফোরণের পর দাবি করে, ওই ভবনের নিচতলায় একটি গ্যাসের সংযোগ ছিল, তিন তলায় ছিল না। অর্থাৎ তিতাস কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রেও তথ্য গোপন এবং ভুল তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এর আগে ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে একটি ভবন একইভাবে বিস্ফোরিত হয়। ওই ভবনের বিস্ফোরণের কারণ হিসেবেও পুলিশের তদন্তে স্পষ্টভাবে তিতাসের ঝুঁকিপূর্ণ পাইপলাইনের লিকেজের কথা ওঠে আসে। একই সঙ্গে ৬০ বছরের পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে রাজউক নিয়ম লঙ্ঘন করে বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল, তাও উঠে আসে। এরও আগে ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি মসজিদের ভেতরে তিতাসের পাইপলাইনের লিকেজ থেকে গ্যাস জমে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। সরকারি দুটি সংস্থার রিপোর্টে এখানে গ্যাস সরবরাহ লাইন স্থাপন ও সংযোগের ক্ষেত্রে তিতাসের সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্রও উঠে আসে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনের পর তিতাসের সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হলে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের আন্দোলনের হুমকির মুখে শেষ পর্যন্ত আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কি বিস্ময়কর!

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের অক্সিজেন প্ল্যান্টে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক তদন্তে কারখানার কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের গাফিলতির কথা বলা হয়েছে। একটি ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক কারখানায় জরুরি অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা ছিল না, অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তাবিধি মেনে চলা হয়নি এবং সেখানে অবৈধভাবে অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাশাপাশি নাইট্রোজেন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডেরও সিলিন্ডার ছিল—এসবই তো ঝুঁকিপূর্ণ। মালিকপক্ষের সীমাহীন অনিয়ম ও গাফিলতির চিত্র উঠে আসার পরও সরকার গত কয়েকদিনে মালিকপক্ষের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। একটি মামলা হয়েছে এবং সেখানে মালিকপক্ষের কয়েকজনসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কাউকেই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও ডাকা হয়নি। যদিও রাজধানীর সিদ্দিকবাজারের ঘটনায় ভবনের দুই মালিক এবং একজন দোকান মালিককে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। সম্ভবত সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের মালিকদের মতো সিদ্দিকবাজারের মালিকরা অতটা প্রভাবশালী নন। ব্যক্তি বা মহল বিশেষের কারণে চরম ঝুঁকির মধ্যে বসবাস তো নিয়তি হতে পারে না।

এত বড় মর্মস্পর্শী ঘটনার পরও তিতাসের এমডি মিথ্যাচার করেছেন এবং বহালতবিয়তে আছেন। প্রয়াত দেশবরেণ্য স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন একটা কথা প্রায়ই বলতেন। বাংলাদেশে গ্যাসের লাইন, বিদ্যুতের লাইন এবং সড়কে যানবাহন চলাচল ব্যবস্থা যে ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে, সেখানে আমাদের কারও এক মুহূর্তের নিরাপত্তা নেই। কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনার পর তার সেই কথাটিই বারবার মনে পড়ছে। ভবনে বিস্ফোরণ হচ্ছে, সড়ক-মহাসড়কে মানুষ মরছে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায়, প্রতিকারহীনতার দীর্ঘ ছায়া আরেক অপরাধের ক্ষেত্র তৈরি করছে। মানুষের জীবন তো তুচ্ছতুল্য হতে পারে না। মানুষ অনিয়মের বলি হবে আর এর প্রতিকার নিশ্চিত হবে না তা তো হতে পারে না।

তিতাসের মতো আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিতে যদি  এমন মর্মন্তুদ ঘটনার পরও কেন সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না? সরকারের দায়িত্বশীলরা সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী কিংবা বিরোধী দলকে দোষারোপ করে দায় শেষ করতে চাইবেন এ কেমন কথা? স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের সেই আশঙ্কার কথা মেনে নিয়ে প্রতি মুহূর্তে আমাদের ভয়াবহ জীবন ঝুঁকির মধ্যেই বাস করতে হবে, এটাই কি তাহলে নিদারুণ বাস্তবতা।


  • সাংবাদিক 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা