অনুপম সেন
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩ ১৫:৫৯ পিএম
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন। বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন বলেই আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। ক্ষমতার মোহ তাঁকে কখনোই টলাতে পারেনি। এদেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে, দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। জনগণের সঙ্গে হঠকারিতা করে, তাদের ঠকিয়ে ক্ষমতাসীন হতে চাননি। তাঁর পুরো জীবনই ছিল জনগণের কল্যাণে নিবেদিত। তিনি শুধু আমাদের জাতির পিতা এবং একটি স্বাধীন দেশের জন্মদাতাই নন, তিনি বিশ্ব ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়। ৫৫ বছরের জীবনে জেলে কাটিয়েছেন প্রায় ১৪ বছর। তাঁর পুরো জীবনই লড়াই আর সংগ্রামের।
শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্লেষণ দুরূহ এবং তিনি কীভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন এই ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। বাঙালির ইতিহাসের পুরো অধ্যায়জুড়ে এবং বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের ইতিহাসে তিনি অনন্য। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া ৭ মার্চের ভাষণটিকে ইউনেস্কো ২০১৭ সালে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। নানা কারণে বাঙালির অধ্যায়জুড়ে এবং বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের ইতিহাসে তিনি অনন্য। একাত্তরের মার্চ এবং ২০২৩ সালের মার্চ মাসের মধ্যে সময়ের ব্যবধান বিশাল। একাত্তরের মার্চ মাস বাঙালির জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা আসে এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বাঙালি শুরু করে মুক্তির যুদ্ধ অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ।
ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা, ’৭১-এর স্বাধীনতাসংগ্রাম সবই বাঙালির ইতিহাসে অনন্য অধ্যায়। বাংলাদেশের জন্মক্ষণের ইতিহাসের কোন অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধু নেই? পশ্চিমা শাসকদের অপশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠায় যা কিছু সম্ভব এর সবকিছু তিনি করেছিলেন এই ভূখণ্ডকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আমরা এই স্বাধীন ভূখণ্ড পেতাম কি না এ নিয়ে গবেষকদের প্রশ্ন অমূলক বলে মনে করি না। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করার ফলেই পরাধীন জাতি মুক্তি পেয়েছিল জগদ্দল পাথরচাপা থেকে। পরাধীন জাতিকে মুক্তির আহ্বান তিনি জানিয়েছিলেন রেসকোর্স ময়দানের এক ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে উত্তাল অধ্যায়ে। বিশ্বনেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভাষণগুলো শুনেছি। বিশ্ব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ভাষণগুলোর মধ্যে পেরিক্লিসের ভাষণ উল্লেখযোগ্য। ফিলিপ এবং আলেকজান্ডারের আক্রমণের মুখে গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ধরে রাখার অনুপ্রেরণা দিতে ডেমোসেলিসও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণগুলোও ইতিহাস-সংলগ্ন হয়ে আছে। আব্রাহাম লিংকনের ঐতিহাসিক ভাষণটিতে তিনি গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এবং ওই ভাষণটিও বিশ্বের
ইতিহাসে অনন্য। মনে পড়ছে মার্টিন লুথার কিং-এর ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ নামক ভাষণটির কথাও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উইনস্টল চার্চিলের ‘উই শ্যাল নেভার সারেন্ডার’ ভাষণটিও অসাধারণ একটি ভাষণ। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ‘গিভ মি ব্লাড, আই উইল গিভ ইউ ফ্রিডম’ ভাষণটিও ইতিহাসখ্যাত। কিন্তু ওই ভাষণগুলো ৭ মার্চের মতো জনসমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে দেওয়া হয়নি। মার্টিন লুথার কিং-এর ভাষণদানকালে অনেক মানুষ উপস্থিত থেকে শুনেছে কিন্তু বাকি ভাষণগুলো দেওয়ার সময় এত মানুষ উপস্থিত ছিল না। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ মানুষের সামনে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের বাক্যগুলোও সব সময় স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
লক্ষণীয়, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে মুক্তির কথা প্রথমে বলে স্বাধীনতার প্রসঙ্গ এনেছেন। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে একটি অপূর্ণ স্বপ্ন রয়ে গিয়েছিল। বাঙালির নিজস্ব সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হবে এই আকাঙ্ক্ষা বহুদিনের। হাজার বছরের বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে প্রকৃত অর্থে বাঙালির কোনো রাষ্ট্র ছিল না। বাঙালির কোনো সাম্রাজ্য ছিল না। বলা চলে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে প্রথম বাঙালির একটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। বাঙালির হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসে বাংলার মানুষের হাতে শাসনভার ছিল না। তাদের নিজস্ব সংবিধান ছিল না। বিদেশ থেকে আগত শাসকরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাজ্য শাসনের কর্তৃত্ব ওই শাসকদের হাতেই ছিল। জনগণের কোনো মতামত ওখানে গুরুত্ব পেত না এবং দাপ্তরিক ভাষা হিসেবেও বাংলা ভাষা স্বীকৃত ছিল না। পাল ও সেন আমলে দাপ্তরিক ভাষা ছিল সংস্কৃত অথবা পালি। দিল্লি সালতানাত কিংবা মোগল শাসনামলে ফার্সি ও তুর্কিই ছিল রাজদরবারের ভাষা। সংস্কৃত ও ফার্সি অবশ্য সর্বভারতীয় ভাষা হয়ে উঠেছিল। ওই শাসনামলে ফার্সি ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের সীমা ছাড়িয়েও বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। পণ্ডিতরাও এ ভাষাতেই চর্চা করতেন। বাংলা ভাষার ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো, যার প্রমাণ আমরা বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের নানা লেখায় পাই। কিন্তু বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী কখনও নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করার সহজ পথ পায়নি। এই ভাষায় অনেক মহৎ সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলায় পদাবলী, গীতিকবিতা, উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত হয়েছে কাব্য। বাংলা মঙ্গলকাব্য আজও সুপ্রসিদ্ধ।
বাংলা ভাষা অনেক আগেই বিকশিত হয়েছে। যদিও গদ্য অনেক পরে বিকশিত হয়েছে এবং এমনটি অস্বাভাবিক নয়। বিশ্বের অনেক জায়গাতেই গদ্য অনেক পরে বিকশিত হয়েছে। যে ভাষায় বিমূর্ত চিন্তাভাবনা করা যায় না সে ভাষা কখনও সমৃদ্ধ হতে পারে না। বাংলা ভাষায় মূর্ত-বিমূর্ত দুই ধরনের চিন্তাই করা যায়। যথেষ্ট উন্নত ও সমৃদ্ধ হওয়ার পরও এই ভাষার নিজস্ব রাষ্ট্র ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি বাঙালিকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে। ৭ মার্চের ভাষণে কতগুলো বাংলা শব্দ বাক্যে যুক্ত হয়েছে, যা ভাষণের ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কারণে। ওই ভাষণে তিনি মুক্তির কথা উচ্চারণের পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বানও জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশের মানুষের যা কিছু আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তবে ৭ মার্চের ভাষণকে কোনোমতেই বিচ্ছিন্নবাদী ভাষণ বলার অবকাশ নেই। যদি তা-ই হতো তাহলে পাকিস্তানি বাহিনীর এই নির্মমতার জন্য বিশ্ব যেভাবে পাকিস্তানি শাসকদের দোষারোপ করেছিল তা বঙ্গবন্ধুর ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হতো। বঙ্গবন্ধুকে এসব নানা কারণেই রাজনীতির কবি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ইতিহাসে ব্যাপৃত বঙ্গবন্ধুকে।