একাত্তরের মার্চের প্রতিটি দিনই কাটছিল আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আজকের দিনে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে টানা ১৪তম দিনের মতো চলে অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১-এর ১৭ মার্চ দিনটি আর দশটি দিনের মতো স্বাভাবিক ছিল না। আগের দিন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক কোনো পরিণতির দিকে এগোয়নি। আজ সেই অসমাপ্ত বৈঠকের দ্বিতীয় দফা। একদিকে বৈঠক চলছে, আরেক দিকে সারা দেশ উদ্বেলিত হয়ে আছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়। শহরগুলো মিছিলের নগরী। দিনটি ছিল অসহযোগ আন্দোলনের ১৬তম দিবস। অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ দিনও বন্ধ ছিল। ঢাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সভা ও শোভাযাত্রা করে। হাজার হাজার মানুষ শহীদ মিনারে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল করার শপথ নেয়। শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠসহ বিভিন্ন এলাকায় কুচকাওয়াজ ও রাইফেল চালনার প্রশিক্ষণ শুরু করে।
বাংলার চলমান অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকাল ১০টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হন। কড়া সামরিক প্রহরার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভবনে এ বৈঠক শুরু হয়। এদিন এক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক চলে। প্রথম দিনের মতোই আলোচনা শেষে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আলোচনা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তবে আলোচনার পরবর্তী সময়ও ঠিক হয়নি।' এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান। আগের মতোই তার সাদা গাড়ির এক পাশে কালো পতাকা এবং অন্য পাশে
শোভা পচ্ছিল বাংলাদেশের প্রস্তাবিত মানচিত্রখচিত পতাকা। সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, পূর্ব বাংলা এখন স্বাধীন, সাড়ে সাত কোট বাঙালি এখন স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, 'আমার ৮৯ বছরের অতীতের সবকটি আন্দোলনের সঙ্গে আমি
জড়িত ছিলাম। কিন্তু একটি সর্বজনীন দাবিতে জনগণের মধ্যে বর্তমান সময়ের মতো একাগ্রতা ও সহযোগিতা আমি এর আগে আর কখনও দেখিনি।' স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে প্রতিরোধ দিবস পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ওই দিন সরকারি-বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
এদিন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম জন্মদিন। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে গিয়ে প্রাণপ্রিয় নেতাকে শুভেচ্ছা জানায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর বাসভবনে পৌঁছালে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের অনুরোধে তিনি তাদের সঙ্গে এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। ৫২তম জন্মদিনে তাঁর কী কামনা- সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি আমার কামনা। আমি জনগণের একজন। আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী! জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে আমাদের সবার মৃত্যু হতে পারে।' শেখ মুজিবের বাসভবনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর পরিবেশে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। রাত পর্যন্ত দলীয় কর্মী ছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শুভেচ্ছা সাক্ষাতে মিলিত হন।