১৯ মার্চ ১৯৭১
গাজীপুর তখন জয়দেবপুর নামে পরিচিত। জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কার্যালয় ছিল। ওই সেনানিবাসে ২০-২৫ জন বাদে বাকি সবাই ছিলেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। মার্চে পাকিস্তানিরা এক ভয়াবহ পরিকল্পনা করেছিল বাঙালি নিধনের। দমনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যারাকের সব কর্মকর্তাকে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে বাঙালি সৈন্যরা অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। তারা অস্ত্র নির্ধারিত সময়ে জমা দেয়নি। সৈন্যদের এই সিদ্ধান্ত শুনে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিতে জয়দেবপুর সেনানিবাসে যান ১৯ মার্চ।
মুহূর্তেই
খবরটি জানাজানি হয়ে যায় আশপাশের
এলাকায়। গাজীপুরের বিভিন্ন
এলাকা থেকে জনতা
লাঠি, তীর-ধনুক নিয়ে
জয়দেবপুর বটতলায় জড়ো হয়ে প্রতিরোধ
গড়ে তোলে। ওই প্রতিরোধ যুদ্ধে
মনু খলিফা,
কিশোর নিয়ামত,
ফুটবলার হুরমত আলী ও কানু
মিয়া শহীদ হন। আহত হন আরও অনেকে। জয়দেবপুরে
পাক হানাদারদের সঙ্গে
জনতার সম্মুখযুদ্ধ হয়। স্লোগান
ছিলÑ ‘জয়দেবপুরের পথ ধর,
বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ১৯৭১
সালের ১৯ মার্চ
জয়দেবপুর থেকে অস্ত্রশস্ত্র
নিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ
ঘটনার বর্ণনা দেন প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রতিরোধে অংশ নেওয়া মো. নুরুজ্জামান আকন্দ। তার ভাষ্য,
বেলা আনুমানিক ১১টার
দিকে রানী বিলাসমনি
উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীদের কাছে জয়দেবপুর
থেকে পাকবাহিনীর অস্ত্র
নিয়ে যাওয়ার ঘটনা
জানায়। পরে ওই দুই বিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীসহ আশপাশের বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভাওয়াল
বদরে আলম সরকারি
বিদ্যালয়ে আসে। মাধ্যমিক
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংবাদ
পেয়ে ভিপি আসকর
আলী সরকার,
মাইরাল চেয়ারম্যানের ছেলে
দেলোয়ার হোসেন,
ছাত্রনেতা নিয়ত আলী ওরফে আমজাদসহ
তারা সব নেতাকর্মী, শিক্ষার্থী একযোগে
জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা
হন। ততক্ষণে পাকবাহিনী
অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে
রাজবাড়ী ক্যাম্প থেকে
বেরিয়ে পড়ে।
অস্ত্রসহ
কমপক্ষে ১৫টি জিপগাড়ি
চেপে দুপুর আনুমানিক
১টার দিকে পাকিস্তানি
হানাদার বাহিনীর সদস্যরা
রাজবাড়ী থেকে বের হয়। তাদের
রুখতে নেতাকর্মী শিক্ষার্থীরা
রাজবাড়ী সড়কের বর্তমান
পোস্ট অফিসের সামনে
অবস্থান নেন। প্রতিরোধের
মুখে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী। দুই পক্ষের মধ্যে
দূরত্ব ছিল আনুমানিক
৫শ ফুট। পাকিস্তানী
বাহিনীর কয়েকজন প্রতিরোধকারীদের
সড়ক থেকে অবরোধ
তুলে নিতে অনুরোধ
করে। ছাত্র-জনতা অবরোধে
অনড় থাকলে পাকিস্তানী
সেনারা গুলি চালাতে
বাধ্য হবে বলে ঘোষণা দেয়। একপর্যায়ে
একটি বাঁশির আওয়াজ
শোনা যায়। তাৎক্ষণিক
পাকিস্তানী সেনারা গাড়ি
থেকে লাফিয়ে নেমে
অবরোধকারীদের লক্ষ্য করে সড়কের দুই পাশে অস্ত্র
তাক করে অবস্থান
নেয়। কিছুক্ষণ পর আবারও আরেকটি
বাঁশির আওয়াজ হওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে নিরস্ত্র
ছাত্র-জনতার ওপর মুহুর্মুহু গুলি
ছোড়ে পাকিস্তানি সেনারা।
গাজীপুরে
এদিন উত্তাল এই ঘটনার পর আরেকটি ভয়াবহ
ঘটনার আভাস পাওয়া
যায় ভুট্টোর এক ভাষণে। পিপলস
পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার
আলী ভুট্টো এদিন
পশ্চিম পাকিস্তানে গণ-আন্দোলন শুরুর
লক্ষ্যে তার দলের
প্রস্তুতি গ্রহণের কথা ঘোষণা করে সংবাদ সম্মেলনে
বলেন, ‘ক্ষমতার ব্যাপারে
পিপলস পার্টিকে হিস্যা
থেকে বঞ্চিত করার
ষড়যন্ত্র হলে আমি চুপ করে বসে থাকব
না। পূর্ব পাকিস্তানের
লোকদের শক্তি দেখেছেন, এবার আপনারা
পশ্চিম পাকিস্তানিদের শক্তি
দেখবেন।’