২১ মার্চ ১৯৭১
মামুন রশীদ
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৩ ১৩:০৫ পিএম
আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৩ ০০:৪৪ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
১৯৭০-এর নির্বাচনে
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে টালবাহানা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী
শুরু করেছিল, ১৯৭১-এর মধ্য মার্চ পেরিয়ে সেই ষড়যন্ত্রের জাল আরও বিস্তৃত হতে শুরু করে।
শুধু ক্ষমতা হস্তান্তর না করার মধ্যেই সে ষড়যন্ত্র সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা ধীরে ধীরে
রূপ নেয় বাঙালি নিধনের দিকে। একদিকে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ; অন্যদিকে গোপনে গোপনে
সেনা ও অস্ত্র আনার কাজও চালাতে থাকে পাকিস্তানিরা। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মার্চের প্রথম দিন থেকেই অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে সারা বাংলায়।
২১ মার্চেও অসহযোগ আন্দোলনের সে ধারা অব্যাহত থাকে।
এ দিন সকালে প্রেসিডেন্ট
ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের
নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পঞ্চম দফা বৈঠকটি অনির্ধারিত
হলেও তা স্থায়ী হয় প্রায় ৭০ মিনিট। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ
সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এই বৈঠকে অংশ নেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু তাঁর
নিজ বাসভবনে পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম
কৌঁসুলি একে ব্রোহির সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন।
‘শান্তিপূর্ণ সুশৃঙ্খল নিয়মে আন্দোলন চালাইয়া যান’ শিরোনামে ১৯৭১ সালের ২১ মার্চ
দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হয় একটি বক্স করে ছাপানো প্রতিবেদন। সংবাদমাধ্যমে জনগণের প্রতি
আহ্বান জানিয়ে এ বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশের জনসাধারণ সারা বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয়
মানুষের অন্তর জয় করেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে একটি অনুপ্রেরণাদায়ী দেশ হিসেবে
পরিগণিত। মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।’
এ দিন বিকালে
চট্টগ্রামে পোলো গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসভায় অংশ নেন ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ
খান ভাসানী। জনসমাবেশে বক্তৃতাকালে তিনি বলেন, ‘আলোচনায় ফল হবে না। এ দেশের হাইকোর্টের
প্রধান বিচারপতি থেকে চাপরাশি পর্যন্ত যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে মানে না, এখন শাসন
ক্ষমতা শেখ মুজিবের হাতে দেওয়া উচিত’। বিকালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার
আলী ভুট্টো সদলবলে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে এ জন্য অতিরিক্ত
সেনা মোতায়েন করা হয়।
বিমানবন্দর থেকে
কড়া পাহারায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আসার সময় রাস্তার দুপাশে মানুষ ভুট্টোবিরোধী
স্লোগান দিতে থাকে। হোটেলে এসে ভুট্টো অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলে সরাসরি
লিফটে চড়ে রুমে চলে যান। লিফটে কথা বলার জন্য সাংবাদিকরা চাইলে অস্ত্র উঁচিয়ে ভুট্টোর
প্রহরীরা বাধা দেয়। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক ‘হঠ যাওÑ সব কুছ ঠিক হো যায়ে গা’ শিরোনামে
ভুট্টো ঢাকা সফরের খবর প্রকাশ করে। ভুট্টো এ দিন প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রায় দুই ঘণ্টার
বেশি সময় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকা
পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা এদিন হোটেল কর্মচারীদের জামায় লাগানো কালোব্যাজ খুলে ফেলার
জন্য চাপ দিলে বাঙালি হোটেলকর্মীরা ‘ভাত-পানি’ বন্ধ করার পাল্টা হুমকি দেয়। পরিস্থিতি
সামলাতে পরে কয়েকজন সেনাসদস্যকে হোটেল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
২৩ মার্চ পাকিস্তান
দিবস পালন করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একমত হয়ে এদিনকে ‘প্রতিরোধ দিবস’
হিসেবে পালনের আহ্বান জানায় এবং কর্মসূচি ঘোষণা করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এ কর্মসূচির
সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। ২৩ মার্চ থেকে পশ্চিম
পাকিস্তানি পণ্য বর্জনের সপ্তাহ পালনের ঘোষণা দেয় স্বাধীন বাংলাদেশ শ্রমিক সংগ্রাম
পরিষদ।