× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বন দিবস

পাথারিয়া পুড়েছে তবুও দায়িত্বশীলদের টনক নড়েনি

পাভেল পার্থ

প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৩ ১৩:৪৪ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

দিনের পর দিন আগুনে পুড়েছে পাথারিয়া, কিন্তু কেউ বনের আহাজারি আগলে দাঁড়ায়নি। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরে বনবিভাগ সেখানে যেতে বাধ্য হয়। সমনবাগ বিট কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, উপকারভোগীদের মাধ্যমে ২০ হেক্টর জায়গায় একটি আগর বাগান করার কথা আছে। তাই বন কেটে পরিষ্কার করা হচ্ছে এবং আগুনের বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত। বনবিভাগের দায়িত্বশীলদের এই ভাষ্য যদি সত্য ধরে নেই, তাহলে বিষয়টি আগুনের চেয়েও বিপজ্জনক। কারণ আমাদের মনস্তত্ত্ব যদি একটি বনের চেয়ে বাজারে বেশি দামে বিক্রি হওয়া আগর চাষকেই প্রাধান্য দেয়, তবে কীভাবে প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষিত হবে? পাথারিয়া পাহাড়ের প্রাচীন বনের চেয়ে আগরবাগান কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে? কারা এইসব বিলাসী বাহারি পণ্য ব্যবহার করে? দুনিয়ার কিছু ধনী মানুষের ভোগবিলাসিতার পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে কতদিন এভাবে আমাদের প্রাচীন অরণ্য অঙ্গার করব কিংবা নোনাপানিতে খুন করব উপকূলের জমিন! একটি আগরবাগান কোনোভাবেই কোনো প্রাকৃতিক অরণ্য বাস্তুতন্ত্রের সামগ্রিক পরিবেশগত অবদানের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বড়লেখা থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছে বনবিভাগ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী গণমাধ্যমকে পাথারিয়া বনে আগুন লাগার বিষয়টিকে ‘দুঃখজনক’ হিসেবে উল্লেখ করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। আশা করব, মন্ত্রী তার পরিবেশগত অঙ্গীকার ভঙ্গ করবেন না। পাথারিয়া পাহাড় দেশের প্রাচীন অঞ্চল। ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়েই এখানে বিকশিত হয়েছে সভ্যতা। যদিও পাথারিয়া পাহাড়ের সেই আদি প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য এখন নেই। বিলাসী দামি সুগন্ধি আগর ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলের আগর গাছ থেকে আহরণ করা হয়। আর বাণিজ্যিকভাবে আগর আহরণই এ অঞ্চলের অরণ্য বাস্তুতন্ত্রকে প্রথম বিপন্ন করে তোলে। পাথারিয়া পাহাড়ের সমনবাগ বনাঞ্চলটি ‘ইন্দো-বার্মা প্রাণবৈচিত্র্য অঞ্চলের (বায়োডাইভার্সিটি হটস্পট এরিয়া)’ অংশ। এ বনের আয়তন প্রায় ১৮০০ একর। পদ্মা, যাদুকাটা, নাফ, সিমসাং কিংবা তিস্তা যেমন আমাদের আন্তঃসীমান্ত নদী; তেমনি পাথারিয়া পাহাড়ের বনাঞ্চলও  আন্তঃসীমান্ত অরণ্য। বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃসীমান্তব্যাপী ছয়টি সংরক্ষিত বনের ভেতর সমনবাগ বনভূমি একটি। এখানে প্রায় ৬০৩ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ২০৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী আছে। এর ভেতর ২০ প্রজাতি উভচর, ৪৫ প্রজাতি সরীসৃপ, ১১৩ প্রজাতি পাখি, ৩১ প্রজাতির স্তন্যপায়ীসহ বহু কীটপতঙ্গ, অণুজীব ও লতাগুল্ম পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের বাসস্থান এই বন। নির্দয় আগুনে অঙ্গার হওয়া বনভূমি বহু বুনোপ্রাণের বিচরণস্থল, প্রজনন অঞ্চল ও খাদ্যের উৎস। চশমা পরা হনুমান, কচ্ছপ, বনরুই, অজগর, পাখি ও পতঙ্গসহ বহু বিরল বন্যপ্রাণ ও উদ্ভিদ লতাগুল্ম সমনবাগ বনের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডে বিপন্ন হয়েছে। আগুনের কারণে ব্যাপক ক্ষতি হবে বনের সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ এবং পাখির বাসার।

জীবনজীবিকা ও জাতীয় অর্থনীতিতে প্রাকৃতিক বনের প্রতিবেশগত অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু দিনের পর দিন বনগুলো পুড়লেও দায়িত্বশীলদের কলিজা একটুখানি কাঁপে না। অগ্নিদগ্ধ অরণ্যের ঝলসানো জীবনের সুরক্ষায় কী কোনো দায় বা দায়িত্ব নেই? উত্তর আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রাকৃতিক দাবানল আমাদের অঞ্চলে হয় না। আমাদের বনে আগুন লাগায় মানুষ। ব্যক্তিগত বা করপোরেট লোভ ও মুনাফা বাণিজ্যের কারণেই অঙ্গার হয় আমাদের বন। ১৯৯৭ সালে মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের আগুনে অঙ্গার হয় লাউয়াছড়া। দেশের সেই সর্ববৃহৎ পরিবেশ-গণহত্যার বিরুদ্ধে আমরা কতটা সোচ্চার হয়েছিলাম? সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে বছরে বছরে সংঘটিত হচ্ছে প্রশ্নহীন অগ্নিকাণ্ড। ২০২৩ সাল যেন প্রাকৃতিক বনের জন্য নিদারুণ অশনিসংকেত। এ বছর একের পর এক আগুন লাগছে বনে। চা-বাগানের আগুনে পুড়েছে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের হাতিমারা। লোভের আগুনে পুড়ছে গাজীপুরের সখীপুর শালবন। চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের গ্যাস জরিপের নামে মৌলভীবাজারের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনের সাঙ্গাইসাফি, কাঁঠালকান্দি ও বাঘাছড়া টিলাবন পুড়ে গেছে। আর পুড়ছে পাথারিয়া পাহাড়ের সমনবাগ বন। মৌলভীবাজারের জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় বিস্তৃত পাথারিয়া সংরক্ষিত বনে লাগানো আগুনে অঙ্গার হয়েছে ধলছড়ি ও মাকালজোরার প্রায় ৪০ হেক্টর বন!

২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল বনবিভাগের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে লাউয়াছড়া বনের একটি অংশে আগুন লাগে ও পুড়ে যায় বন। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় কমলগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ইউনিট ও বনবিভাগ আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। বনবিভাগ তৎক্ষণাৎ তদন্ত কমিটি গঠন করে। ঘটনার তিন দিন পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। প্রাকৃতিক বনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে তৈরি হয় এই তদন্ত প্রতিবেদন। লাউয়াছড়া পারলে পাথারিয়া কেন পারবে না? বনবিভাগ, স্থানীয় সরকার, প্রশাসন কেউ কী এর দায় এড়াতে পারে? প্রাকৃতিক বনে অগ্নিকাণ্ড ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২’ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। আমরা আশা করব, রাষ্ট্র পাথারিয়া পাহাড়ের প্রতি ন্যায়পরায়ণ হবে এবং সুবিচার নিশ্চিত করবে। তবে কেবলমাত্র প্রহরা, তল্লাশি, আইন, বিচার বা দণ্ড দিয়ে বনের নিরাপত্তা ও বিকাশ সম্ভব নয়। মানুষের মনে বনের প্রতি দরদ ও দায় তৈরি হতে হবে। নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা ‘শোভা বুড়ো’ নামে এক সাঁওতাল প্রবীণের মাধ্যমে মৌলভীবাজারের পাথারিয়া পাহাড়ে তার ছেলেবেলাকার প্রকৃতি পাঠের শিক্ষার এক দীর্ঘ বিবরণ হাজির করেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। পাথারিয়া পাহাড়ে বনের ভেতর দমকা হাওয়ায় বনমর্মর আর শব্দে ঐক্যতানের রূপ দেখে সেই শোভা বুড়ো শিশু দ্বিজেন শর্মাকে বলেছিল, বন ভগবানের কাছে ভিক্ মাংছে, বারিশ চাইছে। পঞ্চাশ বছর আগের এই কাহিনিটার সমাপ্তি টেনে ‘গহন কোন বনের ধারে’ বইতে দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন, ‘পাহাড়ের ওই এলাকাটা এখন আবাদ, চারদিকে লোকবসতি। কিন্তু হঠাৎ তার সেই এলাকাটির কথা মনে পড়ে। সামনে এসে দাঁড়ায় প্রকৃতির সন্তান শোভা বুড়ো, মাথায় মস্ত টাক, গায়ে ফতুয়া, পরনে হাফপ্যান্ট, যার কাছ থেকে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম, প্রকৃতিকে জানতে শিখেছিলাম। কেননা ভালো না বাসলে তো কাউকেই জানা যায় না, আর সেই জানাটুকু আজও আমার জীবনের একটা অবলম্বন হয়ে আছে’। পাথারিয়া পাহাড়ের শোভা বুড়োদের খুঁজে বের করা জরুরি, যারা আমাদের প্রকৃতি সুরক্ষার বিরল সূত্র ও দর্শন উপহার দিতে পারেন। পাথারিয়া পাহাড়কে আগলে জনঐক্য গড়ে উঠুক। 


  • লেখক ও গবেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা