২৩ মার্চ ১৯৭১
অলঙ্করন : প্রবা
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ২২তম দিনে এসে বাংলা থেকে পাকিস্তানের অস্তিত্ব মুছে যাওয়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ২৩ মার্চ বাংলায় সাধারণ ছুটি পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বৈঠক না হলেও এদিন দুই দফা বৈঠক হয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং বঙ্গব্ন্ধুর উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে। প্রথম বৈঠক দুপুর ১২টা থেকে এক ঘণ্টা এবং দ্বিতীয় বৈঠক সন্ধ্যা ৬টা থেকে দুই ঘণ্টা চলে। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে অংশ নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে অংশ নেন বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা, এমএম আহমদ ও কর্নেল হাসান। এ দিন ছিল পাকিস্তানের পাকিস্তান দিবস। দিনটি লাহোর প্রস্তাব দিবস হিসেবেও পালিত হতো। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, দোকানপাট এবং বাসাবাড়ির ছাদেও উড়ত পাকিস্তানের চাঁদতারাখচিত পতাকা। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাংলার অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বাসাবাড়ির ছাদে ওড়েনি পাকিস্তানের পতাকা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার আলোকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পূর্বঘোষিত ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এদিন পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে বাংলার আকাশে ওড়ায় বাংলাদেশের পতাকা। দিনটিও পাকিস্তান দিবস হিসেবে নয়, বাংলায় পালিত হয় পতাকা উত্তোলন দিবস হিসেবে। সাধারণ ছুটি থাকায় ঢাকা শহরের মানুষ সকাল থেকেই মিছিল নিয়ে পথে বের হয়। প্রতিটি মিছিলের গন্তব্য অন্যান্য দিনের মতোই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি। মিছিলে অংশ নেওয়া মানুষের হাতে হাতে ছিল বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা।
পল্টন ময়দানে
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশে, এদিন বিউগল আর ড্রাম বাজিয়ে সুরের মূর্ছনায় পরিবেশন
করা হয় জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। সামরিক কায়দায় সমাবেশ
মঞ্চে দণ্ডায়মান স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতাকে অভিবাদন প্রদান করা
হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি হিসেবে চার ছাত্রনেতা অভিবাদন গ্রহণ করেন। সমাবেশের শেষ ব্রিগেডটি
অভিবাদন জানানোর পর সবাই পল্টনের গেট থেকে হাত ধরাধরি করে মিছিলে জাতীয় সংগীতের সুর
তুলে আসেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। বঙ্গবন্ধু বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলার
পতাকা হাতে ধরে জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘বাংলার মানুষ কারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির
দুর্জয় ক্ষমতাবলেই তারা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনবে।’ দৈনিক ইত্তেফাক মানুষের
এই স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল, মানুষের উদ্দীপনা ও জাগরণের প্রেক্ষাপটে পরদিন ব্যানার শিরোনামে
লেখে, ‘আমরা শুনেছি ঐ, মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ।’ এদিন প্রেসিডেন্ট ভবন, গভর্নর হাউস, সেনানিবাস
ও বিমানবন্দর ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি বলেও সংবাদ প্রকাশ করে দৈনিক
ইত্তেফাক। এমনকি এদিন জুলফিকার আলী ভুট্টো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করলেও
হোটেলটিতে উড়েছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা। ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কনসুলেট ভবনেও
ওড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা। সকালেই যুক্তরাজ্যের ডেপুটি হাইকমিশন ও সোভিয়েত কনসুলেটে
স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ে এবং জনদাবির মুখে চীন, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, নেপালও নিজেদের
পতাকার পাশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে।
মওলানা ভাসানীর
ন্যাপ পাকিস্তান দিবসকে ‘স্বাধীন পূর্ববঙ্গ দিবস’ হিসেবে পালন করে। ঢাকা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান মধ্যরাত
পেরিয়ে এদিন আরও ৯ মিনিট বেশি চলে। টেলিভিশনের ঘোষক সরকার ফিরোজ উদ্দিন সমাপনী ঘোষণায়
বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা বেজে ৯ মিনিটÑ আজ ২৪ শে মার্চ, বুধবার। আমাদের অধিবেশনের
এখানেই সমাপ্তি।’ এরপর পাকিস্তানি ফ্ল্যাগের সঙ্গে ‘পাক সারজমিন শাদবাদের’ বাজনা বেজে
ওঠে। বাঙালিরা ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবসে টেলিভিশন পর্দায় পাকিস্তানি পতাকা দেখতে না
দিয়ে এক অভূতপূর্ব অধ্যায়ের জন্ম দেন।