× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শামীম সিকদারের ভুবন

লোপা মমতাজ

প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৩ ১৩:৫৯ পিএম

আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৩ ১৫:০৯ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক শামীম সিকদার আর নেই। এখন তাকে নিয়ে তৈরি হবে নানা মিথ, আলোচনায় আসবে নানা ঘটনা। মুখে মুখে কিছু গল্প আবারও চর্চিত হবে, যার কিছু সত্য আর কিছুটা কল্পনা। তবে সব কথার মুখ্য হলো, তিনি একটা সময়ের আইডল। যেভাবে ভাস্কর নভেরা আহমেদ আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের পথিকৃৎ হয়ে আছেন; যেমন করে ঝরা পাতা, মরা ডাল, গাছের গুঁড়ি দিয়ে নানা শিল্পকর্ম তৈরি করে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আমাদের কাছে অনন্য; ঠিক তেমনি স্বোপার্জিত স্বাধীনতা নামক ভাস্কর্যের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন শামীম সিকদার। কেউ তাকে বলেন নারীবাদী, কেউ তার পরিচয় দেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারের ছোট বোন। আবার কেউ বলেন, আহমদ ছফা প্রেমে পড়ে বিয়ে করতে চাইছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি...। কিন্তু আমি তাকে চিনি তার সময়ের সাহসী মানুষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়কদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য স্বোপার্জিত স্বাধীনতার শিল্পী হিসেবে।

চিত্রগ্রাহক : শাকুর মজিদ

 কৈশোরে তার নাম যখন প্রথম শুনেছিলাম- নামটার মধ্যে কেমন একটা পুরুষ-পুরুষ ভাব মনে হতো, চাল-চলনেও ছিলেন মারমার কাটকাট। কাউকে ভয় পেতেন না। শুনেছি কোমড়ে পিস্তল থাকত সবসময়। একাই ধরাশায়ী করতেন পাড়ার মাস্তান অথবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। পরতেন জিনসের শার্ট আর প্যান্ট। সমাজের তথাকথিত রেওয়াজকে তোয়াক্কা না করেই সিগারেট ফুঁকতেন। গলার স্বরও ছিল অত্যন্ত বোল্ড। তিনি জন্মেছেন ৫২ সালের দিকে। আর আজ যখন শামীম সিকদারকে নিয়ে কথা বলছি, তখন সালটা ২০২৩। মাঝে দীর্ঘ একটা সময় আমরা অতিক্রম করে এসেছি। রাজনৈতিক, সামাজিক পটভূমি পরিবর্তিত হয়েছে অনেক। উন্নয়নে কোনো কোনো সেক্টরে দেশ ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে বহির্বিশ্বে। কিন্তু নারী উন্নয়ন? নারীবিষয়ক প্রশ্নে এই সমাজ কতটুকু এগোল? এখানে এসে আমাদের থমকে দাঁড়াতেই হবে। কারণ একজন নভেরা, একজন ফেরদৌসী অথবা একজন শামীম সিকদারের পর তেমনভাবে আর কোনো নারীকে অন্তত ভাস্কর্যশিল্পে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ আমাদের এমন অনেক নাম উঠে আসার কথা। আশ্চর্যজনকভাবে এখানে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে। এই রকম একটা পিছিয়ে পড়া সমাজে একজন শামীম সিকদার নিশ্চিতভাবেই একটি মিথের নাম। তিনি সেই ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তরের দশকে খিলগাঁও থেকে সাইকেলে করে আর্ট ইনস্টিটিউটে যাতায়াত করতেন। শুনেছিলাম একবার কোনো এক বখাটে তার ওড়না ধরে টান দেওয়ার পর থেকে শরীর থেকে সালোয়ার-কামিজ ঝেড়ে ফেলেন। পরেন নিজের সুবিধামতো পোশাক প্যান্ট-শার্ট। ওই সময়ের মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীদের কেউ এই রকম সাহস দেখায়নি। শামীম সিকদার নারী ভাস্কর হিসেবে নানা প্রতিবন্ধকতা জয় করে অনন্য সব কীর্তি গড়ে বাংলাদেশের নারী-পুরুষ সবার কাছে পথিকৃৎ হয়ে আছেন। পুরুষ আধিপত্যের সমাজে অত্যন্ত দাপট ও সাহসের সঙ্গে তিনি কাজ করে গেছেন। এ কারণেও প্রাতস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

তিনি ছিলেন উদ্দাম ও সাহসী ভাস্কর। তবে তাকে তার কাজ দিয়ে নয়, তার শিল্পকর্মের চেয়ে অধিক আলোচনার বিষয় ছিল তাকে নিয়ে নানা গল্প! এই সমাজে একজন নারী যখন সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করেন, কোথাও কোথাও পুরুষকে ছাড়িয়ে যানÑ তখন তাকে নিয়ে তৈরি হতে থাকে নানা গল্প। আহমদ ছফার উপন্যাস অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী প্রকাশের পর এই গল্প আরও বেড়ে গিয়েছিল ভাস্কর্য নিয়ে দেশে যখন প্রবল বিরোধিতা ছিল তখন শামীম সিকদার ঢাকা আর্ট কলেজে এ বিষয়ে পড়তে যান। পরে তিনি এ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষাও গ্রহণ করেন। তার চরিত্রে একটা বিপ্লবী চেতনা ছিল, যা তিনি তার কাজের মধ্যেও প্রকাশ করেছেন। যখন ভাস্কর্য নির্মাণে প্রয়োজনীয় উপাদান পাওয়া যেত না, তখন রড-সিমেন্ট দিয়েই কাজ শুরু করেন। পরবর্তীকালে তার ভাস্কর্যের মাধ্যম হিসেবে যুক্ত হয় কাদা, কাগজ, সিমেন্ট, গ্লাস ফাইবার, ব্রোঞ্জ এবং স্টিল। সমাজে নারীদের পেলব, নরম কোমল হিসেবেই দেখা হয়, কিন্তু একজন শামীম সিকদার তাদের সেসব ভুল প্রমাণ করে হাতুড়ি, বাটাল হাতে নিয়ে নানা মাধ্যমে তৈরি করে গেছেন একের পর এক ভাস্কর্য। সেসব কাজ কতটা শিল্পোত্তীর্ণ তা নিয়ে আলোচনা করবেন শিল্পবোদ্ধারা। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বলব, তার জীবন বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য পথপ্রদর্শনকারীর। তিনি তার সময়ের একজন ঐতিহাসিক চরিত্র। তাকে পাঠ করে পরবর্তী জেনারেশনের নারীরা সাহস পাবেন ভয় না পেয়ে কাজ করতে।

তিনি চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ললিতকলা অনুষদের ফ্যাকাল্টি মেম্বার ছিলেন। ২০০০ সালে একুশে পদক অর্জন করেন শামীম সিকদার। ১৯৭৪ সালে এই ভাস্কর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ শিরোনামের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ভাস্কর্যটির মূল বেদিতে আছে একাত্তরের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র। স্বামী বিবেকানন্দের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন ১৯৯৪ সালে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে অবস্থিত। ফুলার রোড এলাকায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এ তার করা ১১৬টি ভাস্কর্য রয়েছে। ষাটের দশক থেকে আশির দশকÑ নানা সময়ে ছিলেন আলোচিত একজন শিল্পী। ভাস্কর্যগুচ্ছ বানানোর সময় নানা খবরের অংশ হতেন তিনি। গত কয়েক দশক তিনি এক ধরনের নির্বাসনের মতো জীবনযাপন করেছিলেন। মাস ছয়েক আগে লন্ডন থেকে দেশে আসেন নিজের শিল্পকর্ম সংরক্ষণ এবং নতুন কিছু কাজ করবেন বলে। ৭০ বছর বয়সি শামীম সিকদার হৃদরোগ, শ্বাসতন্ত্র, কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। অসুস্থ হওয়ায় চার মাস আগে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২১ মার্চ বিকাল সাড়ে ৪টায় শামীম সিকদার রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

আচরণে, ব্যক্তিত্বে, পোশাকে, সৃজনে শুধু নারী হয়ে থাকেননি- মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। অলীক কিছু নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে চাই তার আদর্শিক জার্নি, তার কর্মময় জীবন, তার সৃজনশীলতা গীত হোক মানুষের মুখে মুখে। সৃজিত হোক তার সাহসী অধ্যায়।

তাকে স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে।

 


  • লেখক ও সাংবাদিক

 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা