× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জিনপিংয়ের মস্কো সফর ও পুতিনের সামনের পথ

এম হুমায়ুন কবির

প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৩ ১৪:৩৬ পিএম

অলঙ্করন : প্রবা

অলঙ্করন : প্রবা

আশা-নিরাশার দোলাচলে ২০ মার্চ শুরু হয়েছিল চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের তিন দিনের রাশিয়া সফর। রাশিয়ার রাজধানী মস্কো পৌঁছে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত রাশিয়া সফর হতে যাচ্ছে একটি ফলপ্রসূ সফর এবং এই সফর চীন-রাশিয়া সম্পর্কের সুস্থ ও স্থিতিশীল উন্নয়নে নতুন গতি দেবে।

পরস্পরের ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’ চীন-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বয়স এক দশকেরও বেশি। এই দীর্ঘসময়ে দুই দেশের দুই রাষ্ট্রনায়কের দেখাও হয়েছে অনেকবার। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে এবারই প্রথম মিত্র রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ২০ মার্চ স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ৫৯ মিনিটে মস্কোর নুকোভো বিমানবন্দরে শি জিনপিং অবতরণ করেন। চীনের রাষ্ট্রপতির তিনদিনের এই সফর শেষ হয়েছে ২২ মার্চ। বিশ্লেষকরা এ রাষ্ট্রীয় সফরকে ‘শান্তি সফর’ হিসেবে দেখলেও চীন যে মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নেমেছে, সফর শেষে তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। সফরে উভয় নেতার দুই দফা বৈঠকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে বেইজিংয়ের দেওয়া ১২ দফা শান্তি প্রস্তাব নিয়ে কথা বলেছেন। এই প্রস্তাবকে ইউক্রেনে শান্তির ভিত্তি বলে মনে করে পুতিন বলেছেন, কিয়েভ ও পশ্চিমা প্রস্তুত থাকলেই কেবল শান্তি পরিকল্পনাটি এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এর অর্থ চীনা প্রস্তাব মেনে রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে আগ্রহী। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কারণ ওয়াশিংটন মনে করছে, চীনের প্রস্তাব মেনে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে রাশিয়া লাভবান হবে। যুদ্ধ বন্ধে চীনের ১২ দফা প্রস্তাব নিয়ে শুরু থেকেই পাশ্চাত্য দেশগুলো সন্দিহান। তবে আশার কথা, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি প্রস্তাবগুলো খতিয়ে দেখার পাশাপাশি শির সঙ্গে আলোচনাকে স্বাগত জানানোর কথা বলেছেন। একই সঙ্গে ইউক্রেনে মস্কোর আক্রমণের অবসান ঘটাতে শি বেইজিংয়ের প্রভাব ব্যবহার করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন।

শি জিনপিংয়ের মস্কো সফরের মধ্য দিয়ে দুটো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রথমটি, পুতিনকে যুদ্ধ বন্ধের জন্য শি জিনপিংয়ের প্রস্তাব। তবে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি একটু উদ্বেগজনক। যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব যদি ফলপ্রসূ না হয়, তাহলে এক্ষেত্রে অনেকে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সামরিক সহযোগিতা বাড়ারও সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যদি এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে চাই, তাহলে সামরিক সহযোগিতার সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ইউক্রেনে হামলা করার জন্য রাশিয়াকে যেমন চীন নিন্দা জানায়নি, তেমনি রাশিয়াকে সমর্থন করছে এমন কোনো বক্তব্যও মেলেনি। তবে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সিদ্ধান্তটি ভালো নয়, এমন একটি মন্তব্য কিছুদিন আগে চীনের তরফে মিলেছিল। বিশ্লেষকদের অভিমত, চীন মধ্যপন্থা অবলম্বন করছে। ধরে নিতে পারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে চীন রাশিয়াকেই সমর্থন করছে। কারণ চীন-রাশিয়া এই দুটি রাষ্ট্র একটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। আর তা হলো বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন আর শক্তিবৃদ্ধি কিংবা প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। এ জন্য দুটি দেশই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। যুদ্ধে রাশিয়ানদের শক্তিসামর্থ্য যদি অটুট থাকে, তাহলে চীন-রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। চীনও সম্ভবত এমন কিছুই প্রত্যাশা করছে।

এ কথা এখন প্রমাণিত, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে সামরিক অভিযান চালানোর বিষয়ে যৌক্তিকতা নেই। উন্নত বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র অবশ্য রাশিয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে দোদুল্যমান অবস্থানে। তবে পুরো বিশ্বের প্রত্যেক রাষ্ট্রই রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানকে নিন্দা জানানোর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডা অবস্থান নিয়েছে রাশিয়ার বিপক্ষে। এই অভিযান থেকে রাশিয়া যেন কোনো ধরনের সুবিধা আদায় করতে না পারে, সে জন্যও দেশগুলো সক্রিয়ভাবে ইউক্রেনকে সহযোগিতা করছে। সামরিক ও কূটনৈতিকÑ এই দুই দিক থেকেই ইউক্রেন পশ্চিমা শক্তির সহযোগিতা পাচ্ছে। ধারণা করা যায়, ভবিষ্যতে ইউক্রেন দেশগুলো থেকে আর্থিক সহযোগিতাও পাবে। অবস্থা যা-ই হোক, যুদ্ধটা বন্ধ হওয়া দরকার। মতামতটি শুধু আমার নয়, বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সবাই এই মতই প্রকাশ করছেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান থাকুকÑ এমন কোনো মন্তব্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের তরফেও মেলেনি। চীন যদি ভাবে রাশিয়াকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়ে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে, তাহলে যুদ্ধ থামার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো চীনের এই তৎপরতা সুনজরে দেখছে না। ইউক্রেন ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রত্যাশাই রাখে তা হলো, ইউক্রেনের সার্বভৌম ভূখণ্ড থেকে রাশিয়ান সৈন্য প্রত্যাহার। যুদ্ধ বন্ধে চীনা প্রস্তাব ও তৎপরতাকে অনেক দেশ সাধুবাদ জানালেও বিষয়টি নিয়ে তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটেনি। এই যুদ্ধ সামগ্রিকভাবে পুরো বিশ্বকে বড় ধরনের নাড়া দিয়েছে। বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, এমনকি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব আমরাও অনুভব করতে পারছি। ডলারের মূল্য বাড়ায় উন্নয়নশীল অনেক দেশ আর্থিক টানাপড়েনের শিকার হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি পুরো বিশ্বেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকব্যবস্থাও বিপর্যয়ের মুখে। বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় খাদ্য আমদানি ও রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে। কাজেই পুরো বিশ্বই চায় যুদ্ধটা থামুক। কিন্তু চীনের আগে কেউই এই যুদ্ধ থামানোর উদ্যোগ নেয়নি। এ কারণে চীনের উদ্যোগ ইতিবাচক বলা যায়। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের বিষয়ে কোনো দরকষাকষির সুযোগ নেই। চীনকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ইউক্রেন অভিযান থেকে রাশিয়া ফল আদায় করতে পারলে আন্তর্জাতিক রীতির বরখেলাপ হবে।

ইউক্রেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে দেশটির সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দিতে রাশিয়াকে সদিচ্ছার পরিচয় দিতে হবে। এছাড়া বিশ্ব নিরাপত্তার বিষয়েও রাশিয়াকে মনোযোগী হতে হবে। কোনো দেশ অন্য আরেকটি দেশের সার্বভৌমত্ব যেন ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে, এমন নিশ্চয়তার নজির রাশিয়াকেই তৈরি করতে হবে। এখন পর্যন্ত শি জিনপিংয়ের সফরে সুফলের কথাই বেশি শোনা যাচ্ছে। এই সফরের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও ভালো হওয়ার সুযোগও বেড়েছে। চীন যেহেতু উদ্যোগ নিয়েছে, সেহেতু তাদের দুই দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে মীমাংসা করতে হবে। দুই দেশের মধ্যকার বিরোধ মেটানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসরণ করা যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজন ইউরোপ ও পুরো বিশ্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই সফরের ফলে যুদ্ধ বন্ধে  ইতিবাচক কিছু হবে এমন প্রত্যাশায় দূরবর্তী অবস্থানে আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সাম্প্রতিককালে চীন বেশ কয়েকটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। তাই তাদের উদ্যোগে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে এমনটি দুরাশাও নয়। ইতোমধ্যে তারা ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে শান্তিপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। দীর্ঘমেয়াদে এই সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যে ইতিবাচক ফল আনবে তাতেও সন্দেহ নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পারলে চীনের কূটনীতির জন্যও এটি হবে বড় অর্জন। শান্তির দূত হিসেবে চীন যেভাবে নিজেকে প্রচার করছে, যুদ্ধ থামাতে পারলে তারা আরও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।

এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই রায়কে যৌক্তিক বলে অভিমত দিয়েছেন। অনেকে ধারণা করছেন, যুদ্ধের সময়ে এমন রায় যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এক্ষেত্রে আইনগত ও প্রায়োগিক দিকটি বিবেচনা করা দরকার। আইনগত দিক বিচার করলে বলা যায়, এই রায় পুতিনের ওপর চাপ তৈরি করবে না। কারণ রাশিয়া আইসিসির দলিলে স্বাক্ষর করেনি। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বড় বড় দেশও এই দলিলে স্বাক্ষর করেনি। যেহেতু রাশিয়া এই দলিলে স্বাক্ষর করেননি; তাই আইনগতভাবে এই রায় বাস্তবায়ন করা মুশকিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এই রায়ে রাশিয়া যে চিন্তিত নয়Ñ এমন মন্তব্যও শোনা গেছে। তবে রায়ের পর পুতিনের জন্য বেশকিছু রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। রায়টিকে পুতিনের যুদ্ধাপরাধের নোটিশ হিসেবে ধরে নিতে হবে। পুতিন যদি এমন একটি দেশে সফর করেন যে দেশটি আইসিসির দলিলে স্বাক্ষর করেছে, তাহলে কিন্তু প্রায়োগিক দিক থেকে পুতিনকে গ্রেপ্তার করা যাবে। সম্প্রতি চিলির প্রাক্তন সামরিক শাসক পিনোশে স্পেন সফরে গেলে তাকে আটক করা হয়। সে জন্য রাজনৈতিকভাবে পুতিনের জন্য আরেকটি নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় নিরপেক্ষ অনেক দেশের পক্ষেই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা বেশ জটিল হয়ে পড়বে। 


  • কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা