সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৩ ১১:৫৪ এএম
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৩ ১১:৫৭ এএম
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সবাই মিলে আমরা একটা বড় মাপের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেটি হলো মুক্তির। না, কেবল স্বাধীনতার নয়, অর্থাৎ পরাধীনতার অবসানের নয়, সার্বিক মুক্তিরই। যার অর্থ নতুন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাটা তো ছিলই, আমরা আশা করেছিলাম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নতুন সমাজও গড়ে তুলতে পারব।
মুক্তির এই আকাঙ্ক্ষাটা নতুন নয়। এটি ব্রিটিশ আমলে ছিল, পাকিস্তান আমলে তো অবশ্যই ছিল। কিন্তু স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ হয়েছে একাত্তরে যুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তার আগে মুক্তির ধ্বনি আমরা সেভাবে তুলিনি। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে আমরা স্বাধীনতা পাব ভেবেছিলাম। দেখা গেল সেটা আসেনি। তখন দাবি উঠল স্বায়ত্তশাসনের। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় আমরা বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হোক এমন কথা বলিনি, যদিও আমরা বাঙালিরাই ছিলাম জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন। আমরা চেয়েছি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি। তার ভেতর থেকেই অবশ্য স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়াজ বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সেটা মূল আন্দোলনের রণধ্বনি হয়ে ওঠেনি। ছয় দফায়ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিই ছিল। তারপর এলো এক দফা, অর্থাৎ স্বাধীনতা। স্বাধীনতার যুদ্ধ আমরা শুরু করিনি, সেটি শুরু হয়েছে হানাদারদের ২৫ মার্চের নৃশংস গণহত্যা অভিযানকে প্রতিরোধের ভেতর দিয়েই। তারপর যুদ্ধ যখন চলতে থাকল তখনই স্বপ্নটি পূর্ণরূপ নিল। সেটি হলো মুক্তির স্বপ্ন। ওই স্বপ্নই ছিল যুদ্ধের চালিকাশক্তি। আমরা মুক্তি চেয়েছি, কেবল স্বাধীনতা চাইনি। মুক্তির জন্য সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল, সেই সামাজিক বিপ্লবের কথাই লোকে ভেবেছে। যদিও অস্পষ্টভাবে। আমাদের যুদ্ধ স্বভাবতই হয়ে দাঁড়িয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। যারা একে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ বলেন তারা ব্যাপারটা বোঝেন না, কেউ কেউ হয়তো-বা বোঝেন, কিন্তু মানেন না; কোনো কোনো মহল হয়তো-বা বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি করতে চান।
একাত্তরের যুদ্ধে দুটোই ছিল। একদিকে ব্যক্তিগত দুঃস্বপ্ন, অপরদিকে সমষ্টিগত মুক্তির আশা। দুইয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না, সে অবস্থায় সেটা থাকবার কথাও নয়। বরঞ্চ ব্যক্তিগত দুঃস্বপ্ন সমষ্টিগত মুক্তির স্বপ্নকে সংহত ও দৃঢ় করেছে। আমরা বুঝে নিয়েছি যে, ব্যক্তির মুক্তি নিহিত রয়েছে সমষ্টির মুক্তির ভেতর। হত্যা, নিপীড়ন, ধর্ষণ, উচ্ছেদ, আতঙ্ক সব মিলিয়ে এমন ব্যাপক দুঃসময় বাঙালির জীবনে আগে কখনও এসেছে কি না সন্দেহ। না, আসেনি। তবু ওই ভীষণ অন্ধকারও মুক্তির সমষ্টিগত আশাটিকে নির্বাপিত করে দিতে পারেনি। বরঞ্চ অত্যাচার যত বেড়েছে, মানুষের মনোবল তত দৃঢ়তা পেয়েছে। অস্পষ্টভাবে হলেও মানুষ এমন একটি সমাজ গড়ে তুলবে বলে আশা করেছে- যেখানে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা ঘটবে।
হানাদারেরা পরাজিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা বাধ্য হয়েছে তাদের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আত্মসমর্পণে। অপ্রত্যাশিত এই জন্য যে তাদের তো কোনো কিছুর অভাব ছিল না। অস্ত্র প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ, সরবরাহ, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর অকুণ্ঠ সমর্থন, যা ইচ্ছা তা করবার অবাধ স্বাধীনতা- সবকিছু পর্যাপ্ত পরিমাণেই পেয়েছে। তাহলে হারল কেন? হারল কার কাছে? হারল সমষ্টিগত স্বপ্নের কাছে। যত আঘাত করেছে ততই তারা টের পেয়েছে ওই স্বপ্ন শক্তিশালী ও অপরাজেয় হয়ে উঠছে। হারল এই স্বপ্নের কাছেই। বাইরে তারা আত্মসমর্পণ করেছে ভারতীয় ও বাংলাদেশি যৌথ বাহিনীর কাছে, কিন্তু ভেতরে তাদের আত্মসমর্পণ বাঙালির সমষ্টিগত মুক্তির যে স্বপ্ন তার কাছেই। মুক্তিযুদ্ধের জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। প্রশিক্ষণ তো ছিলই না, অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ, অভাব ছিল সবকিছুরই। যুদ্ধ যে করতে হবে এই ধারণাটিও ছিল অনুপস্থিত। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্রোতের মতো মানুষ এসেছে যোগ দিতে- এসেছে কৃষক, শ্রমিক, সেনাবাহিনীর সদস্য, ইপিআর, পুলিশ, ছাত্র, নারী, কে আসেনি। এসেছে স্বপ্নের ডাকে, এসেছে দুঃস্বপ্নের দ্বারা তাড়িত হয়ে।
কিন্তু জয়ের পরই সূত্রপাত ঘটল আমাদের ঐতিহাসিক পরাজয়ের। অন্য কারও কাছে নয়, পরাজয় ঘটল আমাদেরই ব্যক্তিগত স্বপ্নগুলোর কাছে। হানাদারেরা যা পারেনি, না পেরে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেছে। আমরা তা করলাম, আমরা সমষ্টিগত স্বপ্নটাকে ভেঙে খান খান করে দিলাম ব্যক্তিগত স্বপ্নগুলোর আঘাতে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধিকেই মনে করা হলো মুক্তির পথ। লোভ, লালসা, দখলদারিত্ব উগ্র হয়ে উঠল। বিদেশি হানাদারদের হটিয়ে দিয়ে আমরা নিজেরাই হানাদার হয়ে উঠলাম। লুণ্ঠন, ছিনতাই, ভেজাল, ঘুষ, চোরাচালান, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট সংগ্রহ, পরিত্যক্ত এবং সামাজিক সম্পত্তিকে ব্যক্তিগত করা, জাতীয়করণের নামে কলকারখানা দখলে নেওয়া, পরীক্ষায় নকল, চাকরিতে অবৈধ উন্নতি, সম্পদ পাচার- কোনটা বাদ রইল! বাঙালি বাঙালির সঙ্গে এমন ব্যাপক শত্রুতা আর কখন করেনি।
এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও ইতর রকমের টানাটানি শুরু হয়ে গেল। ব্যক্তি বড় হয়ে উঠতে চাইল সমষ্টিকে পেছনে ফেলে। তাই আমার একাত্তর, একাত্তরের আমি, মুক্তিযুদ্ধে আমি, আমার এলাকায় যুদ্ধ- এসব কাহিনী সরব হয়ে উঠল, লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের ভূমিকাকে দমিত করে দিয়ে। অসংখ্য ‘আমি’কে পাওয়া গেল, ‘আমাদের’ জায়গাতে। গৌরব ছিনতাইয়ের উন্মাদ প্রতিযোগিতায় স্বভাবতই বিপন্ন হলো গৌরব নিজে। একাত্তরে আমরা সমাজতন্ত্রী ছিলাম, তারপর থেকে আমরা ক্রমাগত পুঁজিবাদী হচ্ছি এবং পুঁজিবাদের যত রকম গ্লানি, বিচ্ছিন্নতা, অপরাধ সব প্রবল হয়ে উঠেছে।
এটা তো খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, পুঁজিবাদী বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করবে এবং সেটা তারা করেছেও। কিন্তু কেন? তাদের আপত্তিটা ছিল কোথায়? আপত্তি নয়, আসলে ছিল শঙ্কা। বাংলাদেশ স্বাধীন হোক, কিংবা তাদের ভাষায় বিচ্ছিন্ন হোক- এটা নিয়ে তাদের ততটা দুশ্চিন্তা ছিল না, যতটা ছিল এই যে সামাজিক বিপ্লব ঘটবার সম্ভাবনা তা নিয়ে। বাংলাদেশ একটি সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটবে- এটা তখনকার পরিবেশে ওই রাষ্ট্রগুলোর জন্য মোটেই উৎসাহিত হওয়ার মতো ব্যাপার ছিল না। তারা বরঞ্চ চিন্তিতই হয়েছে এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারল না, সমষ্টিগত স্বপ্নের জয় হলো, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটল।
জাতীয়তাবাদীরা যে সমাজতন্ত্রী হতে পারবে না এমন কোনো বিধান নিশ্চয়ই নেই, কিন্তু তার জন্য যে অঙ্গীকার দরকার ছিল আমাদের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব তার ধারেকাছে ছিল না, দূরেই ছিল। সমাজতন্ত্রের কথা এই নেতৃত্ব বলেছে, কিন্তু বলেছে বাধ্য হয়ে, অন্তর থেকে নয়। নতুন শাসকশ্রেণির কাছে সমষ্টিগত স্বপ্ন নয়, ব্যক্তিগত স্বপ্নই হয়ে দাঁড়াল নিয়ামক শক্তি। সাতচল্লিশের জাতীয়তাবাদীরা এমনকি ধর্মনিরপেক্ষও ছিল না, যে-ধর্মনিরপেক্ষতা হলো গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত; একাত্তরের জাতীয়তাবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষতা চেয়েছে, কিন্তু তাকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেয়নি এবং তাদের মুখ্য চেষ্টা ছিল নিজেদের স্বার্থকে বিকশিত করার প্রয়োজনে সমাজ বিপ্লবের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দেওয়া। পুঁজিবাদীরা তাদের ধর্মে দীক্ষিত শাসকদের হাতে পেয়ে খুশি হলো এবং তাদেরকে আরও বেশি বেশি করে ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের ব্যাপারে লোভী করে তুলতে থাকল।
ওদিকে সঙ্গতভাবেই সমষ্টিগত মুক্তির স্বপ্নকে যারা লালন করে, তারা পরিণত হলো শত্রুতে। এ ঘটনা পাকিস্তানের কালেও ঘটেছে। তখনও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছে যে রাজনৈতিক দল, সেই কংগ্রেস নিষিদ্ধ হয়নি, নিষিদ্ধ হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। কেবল নিষিদ্ধ করে সন্তুষ্ট হয়নি, কমিউনিস্টদের যতভাবে পারা যায় নির্যাতিত করা হয়েছে এবং তাদের অনেককে বাধ্য করা হয়েছে দেশত্যাগ করতে।
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু মোটেই অপ্রত্যাশিত নয় এমন ঘটনাও ঘটল যে, রাজাকার, আলবদররা ক্ষমা পেয়ে গেল। কেবল ক্ষমা পেল না, এক সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদারই হয়ে বসল। পাকিস্তানি শাসকরা যেমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা বিরোধিতা করেছে তাদেরকে শত্রু মনে করেনি, শত্রু ভেবেছে সমষ্টিগত মুক্তির স্বপ্নের পক্ষের মানুষদেরকে; বাংলাদেশের শাসকেরাও তেমনি এবং একই নিয়মে রাজাকার আলবদরদের কাছে টেনে নিয়েছে। ফলে পোয়া বারো হয়েছে ধর্মব্যবসায়ীদের। তারা ফুলেফেঁপে উঠেছে। দেশে অভাব, সুবিচারের অনিশ্চয়তা এবং জাতীয়তাবাদীদের ব্যর্থতা যে হতাশা তৈরি করে তা-ই ইসলামি জঙ্গিবাদের জন্য উর্বর লালনভূমিতে পরিণত হওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেয়। ধর্মব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুঁজিবাদীদের আপাত-পার্থক্যের অভ্যন্তরে চমৎকার আত্মীয়তা রয়েছে। উভয় পক্ষই ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মুনাফায় বিশ্বাসী। ইসলামি জঙ্গি বলে যারা পরিচিত, তাদের স্বপ্নটাও ব্যক্তিগত পুণ্য সঞ্চয়ই। পুণ্যের সঙ্গে মুনাফার মূল ব্যবধানটা নামেরই। নইলে পুণ্যসঞ্চয়ী যেমন মুনাফালোভীও তেমনি, ব্যক্তিগত লাভের কথাই ভাবে, সমষ্টিগত অর্জনকে লাঞ্ছিত করে।
একাত্তরের পরে দেশে যে নতুন প্রজন্ম এসেছে তারা পাকিস্তান দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধও দেখেনি, তাদের সামনে দেশপ্রেমিকতার ও আত্মত্যাগের কোনো দৃষ্টান্ত নেই এবং অন্যদিকে তারা সঠিক ইতিহাসও জানে না, সুযোগ পায় না জানবার, শাসকশ্রেণি তাদেরকে সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করে রাখে। তরুণ প্রজন্ম মনে করে এ-দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দেওয়াটা যে সম্মানজনক- এটাও তারা বোধ করে না। তাদের স্বপ্ন ব্যক্তিগত।
কিন্তু ব্যক্তিগত স্বপ্নের লালনপালন যা করে এবং করতে পারে তা তো আমরা দেখছি। ওই সব স্বপ্নের পরস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সার্বক্ষণিক দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশ এখন নৈরাজ্যের দিকে এগোচ্ছে। এ থেকে মুক্তির পথ আমাদের অবশ্যই জানা আছে। সেটা হলো সমষ্টিগত স্বপ্নের কাছে ফিরে যাওয়া। সেই স্বপ্নকে চালিকাশক্তি করে তোলা। কারা করবেন? করবেন তাঁরা যাঁরা দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক, যাঁরা মনে করেন ব্যক্তিগত স্বপ্নকে মুখ্য করে আমরা উন্নতি নয়, অধঃপতনের রাস্তা ধরেছি। মুক্তির স্বপ্নকে সামনে রেখে তাঁরা সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হবেন। যে যুদ্ধ শেষ হয়নি, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। নইলে আমরা নামতেই থাকব, উঠতে পারব না।