প্রজেক্ট সিন্ডিকেট-এর বিশ্লেষণ
মারিয়ানা মাজুকাটো
প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৩ ০১:০৯ এএম
আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৩ ০১:০৯ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
বিশ্বজুড়ে নিরাপদ পানির সংকট এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। পানির হিস্যা যথাযথভাবে বণ্টন না করা গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে আমাদের আরও ভুগতে হবে।
বিশেষত এসডিজি লক্ষ্য অর্জনের পথেও নানা বাধার সম্মুখীন হতে হবে।
গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আকস্মিক বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় এবং লু হাওয়ার প্রকোপ অনাগত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত ভালোভাবেই দেখিয়েছে। এসব বিপর্যয় সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলেও নিরাপদ পানির শঙ্কা নিয়ে এখনও অনেকেই ভাবিত নন। পানির সংকট যেকোনো রাষ্ট্রকে নানা সমস্যার মুখে ফেলে দিতে পারে। কারণ পানি সংকট ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে স্বাস্থ্য এবং খাদ্য সংকটও।
প্রতি ৮০ সেকেন্ডে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন ৫ জন। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা যে আরও বাড়বে তা বলে দিতে হবে না।
পানির অভাবে জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুত হচ্ছে। অনেক জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় ওই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে।
তপ্ত মাটির বুক থেকে বিষাক্ত গ্যাস বায়ুমণ্ডলে জমা হয়ে নতুন নতুন গ্রিন হাউস গ্যাসের জন্ম দিচ্ছে।
কোনো রাষ্ট্রই আর কৃষি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির উৎস অর্থাৎ বৃষ্টিকে পরিকল্পনায় রাখতে পারে না।
তবে নিরাপদ পানির জন্য এখনও আমাদের বৃষ্টির ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে। বৃষ্টির জন্য থিতু সমুদ্র, যথেষ্ট পরিমাণ বনভূমি এবং সুস্থ-স্বাভাবিক বাস্তুসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিটি রাষ্ট্রকেই এ বিষয়ে মনোযোগ বাড়াতে হবে।
আপাতত এ বিষয়ে তেমন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
গ্লোবাল কমিশন অন দ্য ইকোনমিক্স অব ওয়াটারের সহ-সভাপতি হিসেবে বৈশ্বিক পানি সংকটের বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
পৃথিবীজুড়ে আমরা এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে চাই এবং ‘জলজ অর্থনীতি’র (ইকোনমিক্স
অব ওয়াটার) ধারণা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। এ জন্য আমাদের সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমে পৃথিবীর পানিচক্রকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পানির প্রবাহ এবং জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য যূথবদ্ধ চেষ্টা ও পরিকল্পনার বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত, মানবকল্যাণে পানির ভূমিকা অনুধাবন করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
নিরাপদ পানিপ্রাপ্তির প্রত্যাশাও মানবাধিকার। শিল্প খাতে পানির ব্যবহার এবং ব্যবহারের পর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন না করলে জলাশয় রক্ষা করা যাবে না।
প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বিকল্প নেই।
ভুলে গেলে চলবে না, খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার মূল ব্যবস্থা কৃষির উৎপাদন পানির ওপর নির্ভরশীল।
শুধু পানি হলেই হবে না।
পানির সঠিক ব্যবস্থাপনাই পারে কৃষি খাতের পথ মসৃণ করতে।
তৃতীয়ত, পানির মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই ভুলনীতি অনুসরণ করে।
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় রেখে পানির আলাদা মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে বিস্তৃত পরিসরে পানির সরবরাহ বাড়ানোর জন্য অর্থায়ন নিশ্চিত করতে এ বিষয়টি ভাবতে হবে এবং প্রত্যেককে পানির ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হবে। চতুর্থত, কৃষি খাতের জন্য আলাদা পানি বরাদ্দ করা যেতে পারে। লক্ষ্য রাখতে হবে প্রকৃতি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় কোনো অবস্থাতেই। যদি ক্ষতি হয় তাহলে ক্ষতি চিহ্নিত করে তা সংশোধনের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখতে হবে। এভাবেই দেশের নদ-নদী ও জলাশয়গুলো রক্ষা করা সম্ভব হবে। পঞ্চমত, নিম্ন ও মধ্য আয়ের রাষ্ট্রগুলোকে একটি আঞ্চলিক জোট তৈরি করতে হবে এবং জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় পানি ব্যবস্থাপনাকে অন্তর্ভুক্ত করে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। আঞ্চলিক জোট গঠনের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার হওয়ার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের পথও সুনিশ্চিত হবে। পানি ব্যবস্থাপনাকে প্রাধান্য দিয়ে গড়া জোটের ইতিবাচক ফল দ্রুতই দৃশ্যমান হবে।
ষষ্ঠত, বিষয়টি থেকে আমাদের পরিকল্পনা জটিল হয়। পানির উৎস ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এই উৎস শনাক্তকরণে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। উদ্ভাবন সব সময় আমাদের লাভবান করেছে। চাঁদে মানুষ পা রেখেছিল বলে মহাকাশবিজ্ঞানে আমরা এত উন্নতি করেছি। পুষ্টিবিজ্ঞান, যোগাযোগব্যবস্থা, ধাতু এবং সফটওয়্যার ব্যবস্থার উন্নয়নের পথ উন্মুক্ত হয়েছে এই একটি ঘটনায়। তাই পানির সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগ বাড়ালে আমরা অবশ্যই লাভবান হব। আশা করা যায়, অন্যান্য খাতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। নিরাপদ পানি সংরক্ষণের জন্য অত্যাধুনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়গুলোর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের সহজ পদ্ধতি খুঁজে নিতে হবে। এ জন্য আঞ্চলিক পরিসরে রিসাইকেলের ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। শিল্প খাত এবং গৃহকার্যে ব্যবহৃত নোংরা পানি পরিশোধনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে নিরাপদ পানি সরবরাহের সহজ পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। সঠিকভাবে পরিকল্পনা করতে পারলে বছরের যেকোনো সময় সেচ সুবিধা এবং খরার সময়ে কৃত্রিমভাবে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। আর পানিবণ্টনে সাম্য নিশ্চিত হলে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে ভাবিত হওয়ার কোনো কারণ থাকার কথা নয়। বিশেষত বাণিজ্যিকভাবে পানি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও কমে যাবে এবং এভাবে সাশ্রয়ও করা যাবে।
পানি ব্যবস্থাপনার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও সংস্থা গড়ে তোলা জরুরি। পানি সংকট সারা বিশ্বের জন্য একটি বড় সমস্যা। সব রাষ্ট্রই নানাভাবে পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সে জন্য পানিকে গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করতে হবে। বাণিজ্য খাতে পানি ব্যবহারের নীতিমালা এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য আইন তৈরি করতে হবে। এভাবে পানির অপচয় এবং প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর নোংরা পানি উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমানো যাবে। কিন্তু এ জন্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তা, নারী, কৃষক, অর্থাৎ সব স্তরের ভোক্তাকেও পানির গুরুত্ব অনুধাবন করাতেই নীতি ও আইনের বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের তরফে নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। পানি সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা নিলে অর্থনীতি বিকাশের নতুন সম্ভাবনা এখনও আমরা উন্মুক্ত করতে পারি। কিন্তু সে জন্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে পরিবর্তন আনতে হবে দ্রুত। তা না হলে পৃথিবী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর : আমিরুল আবেদিন