× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

প্রান্তেও কি থাকতে পারবে না প্রান্তিকেরা?

ইমতিয়ার শামীম

প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৩ ০১:১২ এএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

কনট্রাক্ট ফার্মিংÑ আপাতনিরীহ এই শব্দযুগল গভীর এক আবেদন নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে দেশেরখাদ্য ঘাটতি মেটানোর উদ্দেশ্যেঅবশ্য ওই চুক্তিভিত্তিক খামার কার্যক্রম আরও আগে থেকেই শুরু হয়েছিল ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে উদ্যোগ নেন এটিকে আরও উৎসাহিত করার, আরও ক্ষমতাধর করে তোলার অস্বাভাবিক ছিল না তাদের সে প্রত্যাশা কেননা সেনাশাসিত ওই সরকার ছিল মূলত সুশীল সামাজিক বাণিজ্যবাদীদের রাজনৈতিক এজেন্ডা পূরণের সরকার ২০০৮-০৯ সালের বাজেটের আগে তাই চুক্তিভিত্তিক খামারে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হতে থাকে কর অবকাশ সুবিধা, কম সুদে ব্যাংকঋণসহ বীমা সুবিধা ইত্যাদি ধরনের সুবিধা প্রান্তিক কৃষকদের দিতে সরকার বরাবরই নারাজ ছিল বা এখনও আছে কিন্তু কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এগুলো যাতে সহজশর্তেঋণ পায়, সরকারের পক্ষ থেকে সে ব্যাপারে বেশ উৎসাহই দেখানো হয় তখন ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবশ্য বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি কিন্তু কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ধারণা পল্লবিত হয়েছে

দেশের কৃষিতে পুঁজির অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছিল দেশ স্বাধীন হতে না হতেই পুঁজি প্রবাহের ফলে গ্রাম আর কৃষিকাঠামোতে যেসব রূপান্তর অনিবার্য হয়ে উঠেছে এবং পুঁজিবাজারের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে এর যে সম্পৃক্ততা তৈরি হয়েছে, তাতে করে মধ্যবিত্তের পুঁজি বিনিয়োগ কিংবা সঞ্চয়নের জন্য প্রত্যক্ষ কৃষি খাত ক্রমশই অনিরাপদ একটি খাতে পরিণত হয়েছে এমন একটি শূন্যতার মধ্যে দেশের বিশেষত প্রান্তিক কৃষকরা খুব সহজেই কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ফাঁদে পড়েছে যদিও কোনো ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কনট্রাক্ট ফার্মিং দেশে জায়গা করে নিচ্ছে কিংবা স্থান করে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে এটি আবার সামগ্রিক গ্রামীণ কৃষিকাঠামোয় কী ধরনের পরিবর্তন আনছে এবং অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে সাধারণভাবে আলোচনা তেমন হয় না বললেই চলে সত্তর দশক থেকে শুরু করে আশির দশকের শেষদিকেও বামপন্থিদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক ছিল দেশের কৃষিব্যবস্থা কৃষিকাঠামো নিয়ে; কৃষিতে পুঁজিতন্ত্রের প্রবেশ বিকাশের ধরন নিয়ে কিন্তু এখন, এককথায় বলতে গেলে, ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য লেফট ফ্রন্ট গ্রাম কৃষির রূপান্তর এবং পুঁজিপ্রবাহের সার্বভৌমত্ব এখন এত পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান যে, বেশ বলে কয়টি করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের খুঁটি পুঁতছে কৃষিক্ষেত্রেও বিশেষত উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের আওতায় ধানসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের উৎপাদন চোখে পড়ার মতো যদিও এসব খামারে যুক্ত কৃষকদের কী মূল্য দিতে হচ্ছে, তা নিয়ে এখনও আলোচনা শুরু হয়নি বললেই চলে

এদিকে ভাগ্যান্বেষী পরিশ্রমী উদ্যোক্তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট-বড় দেড় লাখের মতো মুরগির খামার গড়ে তুলেছিলেন কিন্তু করপোরেশন কোম্পানিগুলোর আগ্রাসনে তা ইতোমধ্যে নেমে এসেছে ৬০ হাজারে! কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের পথে এগিয়ে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে এই পোলট্রি খাতে বছর পাঁচেক আগে কিছু বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান এই চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থার আওতায় প্রান্তিক খামারিদের যুক্ত করতে শুরু করে বর্তমানে এই খাতে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমপক্ষে ২৫ তবে এদের মধ্যে আবার ব্যাপক ক্ষমতাধর মোটামুটিভাবে বলতে গেলে চারটি কোম্পানি বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের পরিসংখ্যানমতে, খামারিদের ১২ শতাংশের সঙ্গে অর্থাৎ ১৯ হাজার খামারি কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ রয়েছে অবশ্য কোম্পানিগুলো কতগুলো খামারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, সে বিষয়ে অবাধ তথ্য দিতে চান না তাই এর প্রকৃতি সংখ্যা বলা কঠিন এমনকি চুক্তির শর্তও বলতে গেলে কোম্পানিগুলো গোপনই রাখে তবে এই চুক্তির নিয়ম মোটামুটিভাবে রকম যে, বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের খাবার বাচ্চা সরবরাহ করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ওষুধ আর জীবাণুনাশকও দেওয়া হয় তবে শর্ত থাকে, মুরগি বড় হলে খামারিদের তা অবশ্যই কোম্পানির কাছেই বিক্রি করতে হবে

ব্যবস্থায় খামারি পাবেন বাচ্চা বড় করে দেওয়ার বিনিময়ে মুরগির কেজিপ্রতি একটাগ্রোয়িং চার্জ তার যদি শ্রমিক নিয়োগের প্রয়োজন হয়, তা হলে সেটা তাকেই করতে হবে, এর জন্যে কোম্পানি আলাদাভাবে কোনো খরচ দেবে না বলা যায়, - এক ধরনের বর্গাদারি প্রথাই ক্ষেত্রে খামারি নিজের উদ্যোগে ঘর ভাড়া করেন, মুরগির জন্যে শেড বানান, বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ নেন, খাবার রাখার গুদাম তৈরি করেন, এমনকি খামারে চলাচলের উপযোগী রাস্তাও বানাতে হয় খামারিকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করতে গিয়ে এসব ব্যয় ধর্তব্যে নেয় না কোনো কারণে লোকসান হলে সেটার সম্পূর্ণ ভার বহন করতে হয় খামারিকেই টাকা পরিশোধে কোনো প্রান্তিক চুক্তিবদ্ধ কৃষক ব্যর্থ হলে ২০ হাজার টাকা লোকসানের বিপরীতে ২০ লাখ টাকার মামলা করে বসছে করপোরেট লোকগুলো

করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এর মধ্যেই মুরগি ডিম উৎপাদনের ১০ শতাংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেছে তবে বাকি ৯০ শতাংশের ওপরেও তাদের রয়েছে নীরব কিন্তু কঠোর নিয়ন্ত্রণ কেননা মুরগির ছানা, ফিড অন্যান্য উপকরণ রয়েছে তাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসব উপকরণকে তারা ব্যবহার করছে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে উপকরণের মূল্যকে তারা এমন একপর্যায়ে নিয়ে যায় যে, খামারিরা বাধ্য হয় তাদের সঙ্গে চুক্তি করতে এমনও শোনা গেছে, কোম্পানির প্রতিনিধিরা চুক্তির আগেইনিরাপত্তা জামানতহিসেবে খামারির জমির দলিল কিংবা ব্যাংকের স্বাক্ষর করা চেক বইয়ের কয়েকটি পাতা নিয়ে নেয়!

করপোরেটগুলো ক্ষুদ্র খামারিদের গ্রাস করতে চাইছে, এই অভিযোগ কেবল খামারিদেরই নয়Ñ বিশেষজ্ঞদের মুখ থেকেও শোনা যাচ্ছে ইদানীং সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রি ইকোনমি অ্যান্ড রুর্যাল সোশিওলোজি অনুষদের ডিন খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানকে গণমাধ্যমে বলতে শোনা গেছে, কনট্রাক্ট ফার্মিং ব্যবস্থাটি খামারিদের জন্যে মঙ্গলজনক হয়নি তিনি বলছেন, খামারিরা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন যে তারা জিম্মি হচ্ছেন তিনি শুধু এটুকু বলেই ইতি টানেননি বলেছেন, ‘এতে অর্থনীতি ঠিক থাকে না যারা আসল উৎপাদক, তাদের হাতে আর ক্ষমতা থাকছে না বাজারও কোম্পানির হাতেই খামারি শুধু উৎপাদন করে যাচ্ছেন

এই যে ব্রয়লার মুরগির দাম একেবারে আকাশে তুলে আবার মাটির ওপর নামিয়ে আনা হলো বলতে গেলে ধপাস করে, সেটা করপোরেট কোম্পানিগুলোর এই নিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট উদাহরণ প্রান্তিক খামারিরা যা বলছেন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমেও বিষয়টি যেভাবে এসেছে, তা থেকে পরিষ্কার, করপেরেট কোম্পানিগুলো চায়, প্রান্তিক খামারিরা তাদের বশ্যতা স্বীকার করুক এখন এসব ঘটনা ঘটছে ডিম ব্রয়লার মুরগির ক্ষেত্রে, ভবিষ্যতে তা ঘটবে চালসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের বাজারের ক্ষেত্রেও এটা কোনো মনগড়া আশঙ্কা নয় যে, অচিরেই প্রান্তিক চাষিদের জন্য ধানের উৎপাদন বিণণন আরও অলাভজনক করে তোলা হবে; বীজ সারসহ বিভিন্ন উপকরণগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রান্তিক চাষিদের নাগালের বাইরে চলে যাবে এবং তারা বাধ্য হবেন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বেঁধে দেওয়া শর্তে কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের পথে হাঁটতে

গত বছরের ডিসেম্বরে পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে কৃষিশুমারি ২০১৯-এর যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে, গত ১১ বছরে বড় মাঝারি শ্রেণির কৃষক পরিবারের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে দেশের কৃষক পরিবারগুলোর ৯১ দশমিক শতাংশই এখন ক্ষুদ্র কৃষক পরিবার এদিকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে অনেক দিন থেকেই বিদেশে জমি কিনে দেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে গিয়ে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টির প্রচেষ্টা রয়েছে বিশেষত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এই কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের সম্ভাবনা রয়েছে দেশের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তো ২০১১ সালে নাকি পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়াতে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে এই কনট্রাক্ট ফার্মিং শুরু করে, যা নিয়ে এখনও তেমন কোনো আলোচনা হয়নি সম্প্রতি মার্চের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পশ্চিম আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ দেশ মৌরিতানিয়ায় চাষযোগ্য জমি বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এই প্রক্রিয়াকে মৌরিতানিয়াও স্বাগত জানিয়েছে বিদেশে কনট্রাক্ট ফার্মিং চালুর এই উদ্যোগ যে দেশের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের অনুকূলে থাকবে, তা লেখাই বাহুল্য কিন্তু উদ্যোগে এই প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থের দিকটি যদি এখনই সুস্পষ্ট না করা যায়, নিশ্চিত না করা যায় তাহলে বিদেশবিভুঁইয়ে গিয়ে তাদের শ্রমদাসে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না

এদিকে কয়েক মাস ধরে দেখা যাচ্ছে, দেশে কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে সীমাহীন মুনাফা লুটের অশুভ প্রবণতা প্রকাশ্যে চলে এসেছে সময় সাধারণ জনগণ শুধু মুরগি ডিম কেন, বেশি দামে চাল-ডালও কিনতে বাধ্য হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে তাদের অধীনস্থ করার অপচেষ্টা চলেছে এর ফলে কৃষি কাঠামোয় যে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থা দেখা দিয়েছে, তা সমাজকে অস্থির করে তুলেছে এমনিতেই সাম্প্রতিককালে কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে তার ওপর এই অস্থিরতা যেভাবে আমাদের স্পর্শ করছে, তাতে ভবিষ্যতও শঙ্কাপূর্ণ হয়ে উঠছে কেবল পোলট্রি খাত নয়, কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রেই নৈরাজ্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে কনট্রাক্ট ফার্মিংকে ব্যবহারের যে অশুভ পাঁয়তারা দেখা যাচ্ছে, তা প্রান্তিক কৃষক তো বটেই, মধ্যবিত্তকেও অসহায় করে তুলেছে কৃষি আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড Ñবলি আমরা; কিন্তু কী করে তার উন্নয়ন ঘটবে, কী করে কৃষকের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটবে, যদি কৃষককেই আটকে রাখা হয় এমন ফাঁদে? যদি প্রান্তিক উৎপাদকরা প্রান্তে দাঁড়িয়েও না পারেন টিকে থাকতে?

 

  • সাংবাদিক  কথাসাহিত্যিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা