× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কেন বাড়ছে অন্তর্দ্বন্দ্ব

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২৩ ০৪:২৪ এএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তর্কোন্দল বাড়ার খবর সংবাদমাধ্যমে ফের উঠে এসেছে। ১ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার নয়াপাড়া রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলায় ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সদস্যের পরিবারের দুজন আহত হয়েছেন। ৩১ মার্চ ভোরে কামাল গ্রুপের সদস্য মোহাম্মদ আলম লালা, সাদ্দাম হোসেনসহ ৮-১০ জন কমিটির সদস্য সৈয়দ আহমদের ঘরে হামলা চালায়। এ হামলায় দুই ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সঙ্গত কারণেই জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের মধ্যেই কেন অন্তর্দন্দ্ব বেড়েছে- এ প্রশ্নটির উত্তর সবার প্রথমে দেওয়া জরুরি। প্রথমেই মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যাটি ভূরাজনৈতিক। রোহিঙ্গাদের জন্যও বিষয়টি ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অপরাধকে তারা চালিকাশক্তি হিসেবে বেছে নিচ্ছে। অপরাধের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের প্রবণতা কোনো অঞ্চলে বেড়ে গেলে অপরাধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন বৈকি। কক্সবাজার এলাকাতেও এই চিত্র আমাদের চোখে পড়ছে। তবে কক্সবাজার অপরাধের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠার পেছনে ভূরাজনৈতিক সমস্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত আরেকটি কারণ রয়েছে। যখনই এই ভূরাজনৈতিক সংকট সমাধানের দিকে আমরা এগিয়ে যাই, তখনই ক্যাম্পের ভেতর অন্তর্কোন্দল অনেকাংশে বেড়ে যায়। অর্থাৎ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথ কন্টকাকীর্ণ করতে একটি অপশক্তি তৎপর হয়ে আছে। অপরাধপ্রবণতার সুযোগ নিয়ে এই অপশক্তি ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। ক্যাম্পের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারলে আন্তর্জাতিক চোরাচালান বা অপরাধের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগও বাড়বে। এই লক্ষ্য অর্জনের পথে কাউকে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেখলেই গুম বা হত্যা করা হয়। অনেক সময় তাদের ওপর সতর্কতাবাচক হামলাও করা হয়।

কোনো অঞ্চলে একটি অপশক্তি তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালায়- এটিও কক্সবাজার এলাকায় অপরাধপ্রবণতা বাড়ার আরেকটি বড় কারণ। যখনই ক্যাম্পের বাসিন্দারা এমন অপরাধমূলক কাণ্ড চোখের সামনে ঘটতে দেখবে তখন তাদের শঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ এই অপশক্তি সাধারণ মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ভয়ে জবুথবু কোনো মানুষই তার ইচ্ছাশক্তি অনুসারে কোনো মন্তব্য বা দায়িত্ব পালন করতে পারে না। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের স্বার্থে উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর মানুষের ইচ্ছাশক্তিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে, তারা নিজ ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী কি না। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে এমন আশার আলোর উপলক্ষ তৈরি হলেও অপশক্তি নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এমনকি বিভিন্ন রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীও এ ব্যাপারে সক্রিয় থাকতে পারে। অপরাধের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের জন্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জন করতে হচ্ছে অপশক্তিকে। এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অন্তর্কোন্দল বাড়াটাই স্বাভাবিক। রোহিঙ্গাদের এই অন্তঃসংঘাত নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কঠিন- এ প্রশ্নে যাওয়ার আগে আমাদের আরেকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী যে সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা কতটা সততার সঙ্গে বা বাস্তবায়ন করছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কতগুলো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের গতিবিধির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার কিছু পথ তৈরি হওয়ার খবর আমরা সংবাদমাধ্যমেই জেনেছি। এই পথগুলো এখনও আমরা বন্ধ করতে পারিনি। যদিও নিরাপত্তার বেড়াজাল বাড়ানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিকট অতীতে পদক্ষেপ নিয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক মহল থেকে এই পদক্ষেপের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য আসে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নিজস্ব কৌশলে অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও মহলের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে তাদের নিরাপত্তার বেড়াজাল তৈরি করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণের লড়াই যে অপশক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, তারা সুযোগ নিচ্ছে। এ জন্য বাড়ছে অন্দর্কোন্দল ও অপরাধের মাত্রা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রধান ফটকে নিরাপত্তার যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে। প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পের বাসিন্দা ছাড়া আর কাউকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় না। তবে অন্য পথগুলোতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই বলে ক্যাম্পে অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করছে। এই পথগুলোর ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব না থাকায় কেউ অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করলে তাকে নজরদারির মধ্যে পড়তে হয় না। বলা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্প অপরাধীদের গা ঢাকা দেওয়ার একটি জায়গা হয়ে পড়েছে। ক্যাম্পে অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশের ব্যাপারে নিকট অতীতেও প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র বাদেও মাদকের বিস্তার ঘটছে ক্রমবর্ধমান হারে। অল্প সময়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের সহজ পন্থা হিসেবে অবৈধ অস্ত্র এবং মাদকের চোরাচালান বাড়ছে। সঙ্গত কারণেই এই পন্থার সঙ্গে জড়িত ভাগীদাররা তাদের অর্থের উৎস বন্ধ হওয়ার বিষয়ে খুশি হবে না। অবৈধ অস্ত্র অবৈধ ব্যবসার টাকা দিয়েই ক্যাম্পে আরও অস্ত্র কেনা হয় এবং এই অস্ত্র দিয়েই রোহিঙ্গাদের ইচ্ছাশক্তি দমিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি অবৈধ অর্থোপার্জনের পথগুলো শনাক্ত করে বন্ধ করা যায়, তাহলে অপরাধপ্রবণতা অনেকাংশে কমে আসবে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিদ্যমান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা বেষ্টনী কড়াকড়িভাবে আরোপ করলে অপরাধ কমবে কি না, এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা যায়, তাহলে অপরাধপ্রবণতা না কমার কোনো কারণ দেখি না। স্মরণে আছে, নিকট অতীতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন পথ বন্ধ করার জন্য ক্যাম্পের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্মরণে আছে, ওই সময় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাসহ কিছু দেশও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। অতএব, বৈশ্বিক মহল থেকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসন করে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক রাষ্ট্রই এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করছে না। কেন করছে না? আগেই বলেছি, এর পেছনে ভূরাজনৈতিক কারণের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত নিবিড়। রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থাপনের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নানা সময়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল গড়ে উঠেছে। এই সংস্থাগুলো চায় রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে থাকুক। সম্প্রতি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় তোড়জোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং তখনই স্বার্থান্বেষীরা তৎপর হয়ে উঠেছে। এর ফলে ক্যাম্পে খুনখারাবি ও অপরাধের মাত্রা বেড়ে চলেছে। অতীতের দিকে তাকালে এই বিষয়টি আমাদের দৃষ্টি এড়াবে না। ২০১৭-২০২২, এই পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। শঙ্কার বিষয় হলো, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ১৮টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। অপরাধীচক্র হীনস্বার্থবাদী প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় অপরাধকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পের ভেতরেই রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাশক্তি দমনের জন্য তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। রোহিঙ্গাদের মতামত গঠনের ক্ষেত্রে ক্যাম্পে ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গাদের কথাও ভাবতে হবে। ক্যাম্পের ভেতর অনেক রোহিঙ্গাকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যারা রোহিঙ্গাদের নিজ ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে জনমত গঠনে কাজ করছেন কিংবা ক্যাম্পে অবস্থানরত অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন তাদের ওপর হামলা হচ্ছে বেশি। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণেও ক্যাম্পের ভেতর অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। ক্যাম্পের ভেতরকার অস্থিতিশীল পরিবেশ আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বড় বাধা। কিন্তু এ সংকট নিরসনের উপায় কি? একটি বিষয় আমরা বরাবরই এড়িয়ে যাচ্ছি। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্যাম্পের ভেতর একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। এই প্রজন্মই আগামী দিনে আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আমরা বিভিন্ন উদ্বাস্তু ও শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশু পূর্ণ বয়সে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বেশি জড়িয়ে পড়ে। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য রোহিঙ্গাদের দ্রুত তাদের নিজ বাস্তুভিটায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একক ভূমিকাই সব নয়। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বলে, রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ খোলা নেই। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ভেতরে যাতে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয় সেইলক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। তাদের নিজভূমে ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরির দায় আন্তর্জাতিক মহল এড়াতে পারে না।


  • নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (আইসিএলডিএস) নির্বাহী পরিচালক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা