× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সীমান্তে হত্যা : শূন্য ধরা দেবে কবে?

প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:৫৭ পিএম

আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৩২ পিএম

কুড়িগ্রাম সীমান্তে ২০১১ সালে গুলি করে হত্যা করা হয় কিশোরী ফেলানীকে। তার নিথর দেহ ঝুলেছিল কাঁটাতারের বেড়ায়। ফাইল ফটো

কুড়িগ্রাম সীমান্তে ২০১১ সালে গুলি করে হত্যা করা হয় কিশোরী ফেলানীকে। তার নিথর দেহ ঝুলেছিল কাঁটাতারের বেড়ায়। ফাইল ফটো

আগের দিন আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম, আশ্বস্ত হয়েছিলাম, ‘সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যে নেমে আসবে।’ কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। আমরা তাই এক দিন পরেই দেখতে পেলাম, দিনাজপুরের দাইনুর সীমান্তে লুটিয়ে পড়েছে কিশোর স্কুলছাত্র মিনার বাবু। থমথমে, ভারী আকাশ বাতাসে কান্না ভাসছে তার মা-বাবা মিনারা পারভীন আর জাহাঙ্গীর আলমের। স্তব্ধ হয়ে পড়েছে তার আত্মীয়স্বজন।

কিন্তু ঘটনা তো কেবল এটুকু নয়--মিনারকে হত্যা করা হয়েছে গত ৯ সেপ্টেম্বর বুধবারে, তারপর চার দিন পেরিয়ে গেছে, তবু তার লাশ আর মেলেনি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এখনও জানায়নি, লাশ কবে হস্তান্তর করা হবে, বিজিবি কবে মিনারের মরদেহ নিতে পারে। কোথায়, কোনখানে তার লাশ পড়ে আছে, কবে সেই লাশ মিলবে, কে জানে!

ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে পাকিস্তানের। সীমান্ত রয়েছে ভুটান ও নেপালের। কিন্তু সেসব দেশের কোনো নাগরিক সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন, এমনটি কখনও শোনা যায় না। ব্যতিক্রম কেবল বাংলাদেশ। সীমান্তের বাংলাদেশিরা যেন মানুষ নয়--যেন টার্গেট প্র্যাকটিস পয়েন্ট। এসব ঘটনাকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলেও মনে করা হয় না। ২০১৯ সালের মধ্য জুনে ঢাকায় বৈঠক হয়েছিল বিজিবি ও বিএসএফ মহাপরিচালকের। তখন ‘দুর্বৃত্তরা হামলা চালালে আত্মরক্ষার’ তাগিদে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, এ কথা জানিয়ে বিএসএফ মহাপরিচালক জানিয়েছিলেন, এসবই ‘অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু’।

মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত হলে, তেমন মৃত্যু যাতে না ঘটে, সেরকম পরিস্থিতি তৈরি করাই কাক্সিক্ষত হওয়ার কথা। বিভিন্ন সময় তেমন প্রত্যাশার কথা অবশ্য আমরা একেবারে কম শুনিনি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এ ব্যাপারে ২০১৮ সালে একটি চুক্তিও হয়েছিল। যাতে বলা হয়েছিল, সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনা ঘটলেও বিএসএফ কিংবা বিজিবি সদস্যরা কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, চুক্তি করার পরও ভারত শর্ত মানেনি কিংবা মানতে পারেনি। চুক্তির বছর ২০১৮ সালে সীমান্তে নিহত বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ জন। কিন্তু ২০১৯ সালেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ জনে, যা আগের বছরের তুলনায় ১২ গুণ। তবে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা ৪৩। যার মধ্যে ৩৭ জনকে গুলি চালিয়ে এবং ছয় জনকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। অবশ্য আসকের হিসাবে ২০১৮ সালে সীমান্তে তিন জন নয়, মোট ১৮ জন খুন হয়েছেন। আসকের হিসাবে ২০২০ সালে সীমান্তে নিহত হয়েছেন ৪৯ জন, যাদের মধ্যে গুলিতে নিহত হয়েছেন ৪২ জন। এরপর ২০২১ সালে সীমান্তে নিহত হতে হয়েছে ১৯ বাংলাদেশিকে। এদের মধ্যে ১৬ জন নিহত হয়েছেন গুলিতে। আর চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে বা জুলাই পর্যন্ত সীমান্তে নিহত হতে হয়েছে আট বাংলাদেশিকে। এদের আট জনই নিহত হয়েছেন গুলি লেগে।

সব মিলিয়ে সীমান্তে মৃত্যু যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অবশ্য ফেলানী হত্যার ঘটনাতেও যেখানে শুভবুদ্ধি জাগ্রত হয় না, সেখানে এমন হওয়াই স্বাভাবিক। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে কথোপকথনে ভারতেরই মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ বা সংক্ষেপে মাসুমের সচিব কিরীটি রায়কে তিক্ত সত্যটি বলতে শোনা গেছে, ‘বিএসএফ কথা শুনছে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ সরকারের এটা নিয়ে আপত্তি নেই সেরকমভাবে। ভারতের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছে না।’

সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রত্যাশার কথা বিশেষ করে শোনা যাচ্ছে গত এক যুগ ধরে। মনমোহন সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১০ সালে উভয় দেশের সরকার সীমান্তে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছিল। যদিও তার লক্ষণ কখনও দেখা যায়নি। পরিস্থিতি এতই হতাশাজনক হয়ে ওঠে যে, ২০২০ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘সীমান্তে যাতে একজন মানুষও মারা না যায়, সে ব্যাপারে ভারত অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হচ্ছে, সীমান্তে হত্যা ঘটছে। তাই আমরা উদ্বিগ্ন।’ পরিস্থিতির এত অবনতি ঘটেছে যে, ভারতের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও সম্প্রতি এ ব্যাপারে সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছে।

দিন যত যাচ্ছে, উদ্বেগ ও ক্ষোভ আরও বাড়ছে। আগে ক্ষোভ-উদ্বেগের কারণ ছিল হত্যাকাণ্ড; কিন্তু এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের ঘোষিত দৃষ্টিভঙ্গিও। এই গেল জুলাই মাসে ঢাকায় হয়ে গেছে সীমান্ত সম্মেলন। সে সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার সিং। তিনি বলে গেছেন, সীমান্ত এলাকায় গুলি চালানোর সব ঘটনাই ঘটে রাতের বেলায় আর যারা এসব ঘটনায় হতাহত হন, তারা সবাই ‘অপরাধী’।

বিএসএফ মহাপরিচালকের এই কথা শুনে মনে হতে পারে, অপরাধী হলে এবং সময়টা রাতের বেলা হলে তাকে গুলি করা যায়। গুলি করে মেরে ফেলা যায়। এর জন্য কোনো জবাবদিহি প্রত্যাশা করা উচিত নয়। অতএব বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ২০২০ সালে যে ৪৯ জন কিংবা ২০২১ সালে যে ১৯ জন মানুষ জীবন দিয়েছেন, কিংবা তারও আগে যত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে--তার সবই অপরাধীদের মৃত্যু। অতএব এ নিয়ে উচ্চবাচ্য হওয়ার মানে নেই!

এমন বক্তব্য মানুষকে বিস্মিত করেছে, বিক্ষুব্ধ করেছে। আমাদের অতিথিপরায়ণতা এত বেশি যে আমরা বিএসএফ মহাপরিচালকের এমন বক্তব্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিনি! কিন্তু আমরা না তুললেও প্রশ্ন যে উঠবে না, তা তো নয়। খোদ ভারতেই এ নিয়ে কথা উঠেছে। ভারত সফরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় গত ৭ সেপ্টেম্বর শীর্ষ বৈঠক নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওয়েবসাইটে যে যৌথ বিবৃতি প্রচার করা হয়, তাতে অবশ্য দুই নেতাই সীমান্তে প্রাণহানির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা আবারও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার কথাও বলেন।

কিন্তু এর এক দিন পর গত ৯ সেপ্টেম্বর বুধবার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিরস্ত্র মানুষের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে আলোচনা না হওয়ার বিষয়টিকে ‘হতাশাজনক’ বলে মন্তব্য করে ভারতেরই ‘মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’ (মাসুম)। সংগঠনটির বিবৃতিতে এমন তথ্য রয়েছে, যা যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ করবে। এ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ভারতে কংগ্রেস সরকারের আমলে বিএসএফ প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র (নন-লেথাল উইপন) ব্যবহার করত। কিন্তু ২০১৪ সালের থেকে বিএসএফ আবারও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করছে। পরিসংখ্যান দিয়ে সংগঠনটি জানাচ্ছে, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ভারতের ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্সের (ইউপিএ) সরকারের শাসনামলে (২০০৪-২০১৪) সীমান্তে নিহতের সংখ্যা ছিল বছরে গড়ে ১৫০ জন। আর ২০১৪ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) সরকার গঠনের পর সীমান্তে বছরে গড়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০ জনে।

আগে সীমান্তে হত্যার পেছনে প্রধান একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো পশু চোরাচালানকে। কিন্তু বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি একটি খুবই দুর্বল যুক্তি। কারণ গত কয়েক বছরে গবাদিপশু উৎপাদন ও লালনে বাংলাদেশের সক্ষমতা যথেষ্ট বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, ২০২২ সালের ঈদুল আজহায় দেশে কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার। কিন্তু ওই সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোট-বড় খামারে গবাদিপশু ছিল এক কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি। পশু চোরাচালান বন্ধ থাকলে বরং বাংলাদেশের খামারিরাই উপকৃত হয় এবং নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো বোকা বোধকরি এ দেশের কোনো মানুষই নয়। তা ছাড়া সীমান্তপথে যেসব গরু ভারত থেকে আসে, সেগুলো মূলত আসে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা ইত্যাদি প্রদেশ থেকে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নানা চেকপোস্ট পাড়ি দিয়েই আসতে হয় সেগুলোকে। তাই সীমান্তে পশু চোরাচালানই হোক আর মানব পাচার কিংবা মাদক চালান--যে ধরনের অবৈধ কাজই ঘটুক না কেন, তার পেছনে রয়েছে বড় কোনো সিন্ডিকেট, রয়েছে দুই দেশের বিশেষ মহলের মদদ। সেসব দিকে দৃষ্টি না দিয়ে যখন গুলি কিংবা নির্যাতন করে সাধারণ নিরস্ত্র বাহক মানুষকে হত্যা করা হয়, তখন এর অর্থ দাঁড়ায়, একদিকে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নমুখী করা, অন্যদিকে জনগণের মধ্যে ভয়ের বাতাবরণ ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে তারা প্রশ্নই না তুলতে পারে।

এখন, এমন পরিস্থিতিতে কি বাংলাদেশ, কি ভারত উভয় দেশেরই মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উচিত একটি স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা। যাতে এ জাতীয় ঘটনাগুলোর গ্রহণযোগ্য তদন্ত হয়, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংগঠনগুলোকে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয় এবং সাধারণ নিরস্ত্র মানুষ অন্তত এটুকু সান্ত¦না পান যে, তাদের অভিযোগ করার মতো একটি জায়গা রয়েছে। উভয় দেশের যেকোনো ভুক্তভোগীই যাতে অভিযোগ করতে পারে, অভিযোগের সপক্ষে তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে এবং উন্মুক্ত বিচার পেতে পারে, সেজন্যে এমন একটি কমিশন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

স্কুলছাত্র মিনারের বাবা-মার কথাই ধরা যাক। তারা বিচার চাইবেন কার কাছে? কচ্ছপের শুঁটকি আনার জন্য সীমান্তে গিয়েছিল ক্লাস নাইনের ছেলেটি। তাকে মেরেও যেন শান্তি নেই--তাই তার মৃত মুখও এখন অধরা মা-বাবার কাছে। ফেলানীর মৃতদেহ যাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থেকেও অপরাধের হাত আরও বিস্তৃত করতে দ্বিধান্বিত নয় তারা। কমিশন হয়তো খানিকটা হলেও নিবৃত্ত করতে পারবে তাদের, শূন্যের দিকে যাত্রা শুরু করা যাবে অন্তত।


লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা