× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাধাবতীর কলাবতী

লোপা মমতাজ

প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৪০ এএম

আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৪৮ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

বাংলাদেশে এই প্রথম কলাগাছের আঁশ দিয়ে শাড়ি তৈরি হয়েছে। এই শাড়ির নাম 'কলাবতী সুতি শাড়ি'। তৈরি হয়েছে বান্দরবানে। খবরের কাগজে এই তথ্যটি জেনে খুব ভালো লাগল। ক্ষণিকের জন্য যেন চলে গেলাম ইতিহাসে আরও একটি বিখ্যাত শাড়ি তৈরির সময়ে যার নাম ঢাকাই মসলিন। চড়কা দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হতো, যার ফলে মসলিন হতো কাচের মতো স্বচ্ছ। কথিত আছে, মসলিনে তৈরি করা পোশাকসমূহ এতই সূক্ষ্ম ছিল যে ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেত। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলায় আগত মরক্কো দেশীয় পর্যটক ইবনে বতুতা তার কিতাবুর রেহালায় সোনারগাঁওয়ে তৈরি সুতিবস্ত্রের বিশেষ প্রশংসা করেন। পঞ্চদশ শতকে বাংলাদেশে আসা চীনা লেখকরাও এখানকার সুতিবস্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেন। মোগল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল পর্যন্ত সোনারগাঁওয়ে প্রস্তুতকৃত এই সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্রের প্রশংসা করতে ভোলেননি।

ওই যুগেও মসলিন ছিল অনেক রকমের। সবচেয়ে সূক্ষ্ম আর দামি মসলিনের প্রশংসা করে নানা নাম দিতেন রাজকীয় কবিরা। এ যুগেও প্রশংসা করে শাড়ির নামকরণ হয়েছে ‘কলাবতী সুতি শাড়ি'। আর সে যুগে একটি মসলিন শাড়ির নাম ছিল 'বাফৎ হাওয়া’, অর্থাৎ ‘বাতাস দিয়ে বোনা কাপড়'। নামেই বোঝা যাচ্ছে, এসব উচ্চস্তরের মসলিন ছিল হাওয়ার মতোই হালকা আর নরম। এভাবে সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকাকে বাংলার রাজধানী ঘোষণার পর হতেই ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা বাংলায় আসা শুরু করেন। এসব বণিক কোম্পানির তৎকালীন দলিল-দস্তাবেজ এবং ওই সমকালীন ইউরোপীয় লেখকদের বিবরণে মসলিন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। অবশেষে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজরা ক্ষমতাকে তাদের হাতে কুক্ষিগত করে ফেললে আস্তে আস্তে মসলিন বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করে এবং একটা সময় মসলিন হারিয়ে যায়। অথচ সে যুগে মসলিনের মর্যাদা ছিল ধনরত্নের মতোই, আর ঢাকাই মসলিনের সমাদর ছিল পৃথিবীজুড়ে। নানা কারণে আঠারো শতকের শেষার্ধের দিকে বাংলায় মসলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এত বছর পরে, যখন মণিপুরের রাধাবতী দেবীর এই শাড়ির উদ্ভাবনের গল্প নয় বাস্তবেই প্রত্যক্ষ করা গেল সংবাদমাধ্যমের কল্যানে। তখন মনে মনে এই সৃষ্টিকে অভিনন্দন জানাতে থাকলাম। অভাবনীয় ব্যাপার! কলাগাছের বাকল দিয়ে এতদিন বাহারি হস্তশিল্প তৈরি হয়ে আসছিল। এবার বান্দরবানে প্রথমবারের মতো কলাগাছের বাকল থেকে সুতা তৈরি করে সেই সুতায় বানানো হয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ শাড়ি। শাড়িটি লম্বায় সাড়ে তেরো হাত এবং প্রস্থে আড়াই হাত। তবে অদ্ভুতভাবে খেয়াল করলাম, এই অসাধারণ সাফল্যগাঁথা কিছুদিন পত্রিকাতে ছাপা হয়ে আবার সব আলোচনার বাইরে! তখন মনে হলো আরও একটি অর্জন কি আমরা হেলায় হারিয়ে ফেলব? মসলিন ধরে রাখতে পারিনি, কিন্তু কলাবতীর কি হবে? বান্দরবান তথা সারা বাংলাদেশে প্রচুর কলাগাছ জন্মে। কলা এক ফসলি গাছ। এই ফেলে দেওয়া গাছের ছাল থেকে আঁশ বানিয়ে শাড়ি। কী এক দারুণ ব্যাপার! খুব সহজেই এর কাঁচামাল আমরা সংগ্রহ করতে পারব প্রকৃতি থেকে। সেকালে অর্থাৎ প্রায় ২শ বছর আগে মসলিন তৈরি হতো ১৬ ধাপের এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। ফলে মসলিনের মর্যাদা ছিল ধনরত্নের মতোই। আর এর সমাদর ছিল পৃথিবীজুড়ে। এ তো গেল অনেককাল আগের কথা। আজ যখন যত্রতত্র জন্মানো একটি গাছের আশ থেকেই, তৈরি করা যাচ্ছে নিত্যব্যহার্য শাড়ি, তা নিয়ে কি খুব বেশি হইচই হচ্ছে? পত্রিকায় লেখা হয়েছে, খবরটি বড় করে; হয়তো কোথাও ছাপাও হয়েছে। তার পর? এটি কি শুধুই কোনো প্রকল্পের অংশ হয়ে থাকবে? প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে এই শাড়ি বানানোর কর্মকাণ্ডও কি বন্ধ হয়ে যাবে? অতীতে এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে, যেখানে দেখা গেছে  কোনোকিছু উদ্ভাবনের পর কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা না পেয়ে তা আবার বন্ধ হয়ে গেছে। যেমনটি মসলিন কাপড়ের বেলায় ঘটেছিল। কলাগাছের তন্তু বা আঁশ থেকে সুতা ও শাড়ি তৈরির ঘটনা বাংলাদেশে সম্ভবত বান্দরবানেই প্রথম। এ শাড়ি তৈরির মূল বয়ন কারিগর মৌলভীবাজারের রাধাবতী দেবী। যিনি বান্দরবানে গিয়ে এ শাড়িটি বুনে দিয়েছেন। শুধু শাড়িই নয়, এই সুতা থেকে পর্দার কাপড়, পাপোস, ব্যাগ, কলমদানিসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরি করা হয়েছে। পরে সুযোগ পেলে হয়তো আরও অনেক কিছুই তৈরি করা সম্ভব হবে। আর এ ঘটনার ফলে প্রচুর পরিমাণে জন্মানো কলাগাছ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হলো, যা এতদিন ফল সংগ্রহের পর কেটে ফেলে দেওয়া হতো। এবার আসি প্রধান কারিগর রাধাবতী প্রসঙ্গে। যখন বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি কলাগাছের তন্তু থেকে শাড়ি বানিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন রাধাবতী দেবীকে। তখন তিনি একটু দমে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জীবনে কলাগাছের সুতা চোখে দেখি নাই। কীভাবে শাড়ি করব? পরে অবশ্য রাধাবতী ঠিকই কলাগাছের সুতা বা তন্তু দিয়ে শাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। রাধাবতী তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আট দিনে এই শাড়িটি তৈরি করেছি। প্রথম যখন এই চ্যালেঞ্জ নেই, তখন আমার প্রতিবেশী বা সহকর্মীরা বলেছিল, কঠিন কাজ। সফল না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে পারব। তবু প্রথমে কিছু দ্বিধা ছিল। এখন সবাই এত প্রশংসা করছে যে, খুব ভালো লাগছে। আমিই প্রথম কলাগাছের সুতা দিয়ে শাড়ি তৈরি করেছি। সুতা লেগেছে পৌনে এক কেজি। কলাগাছ দিয়ে এমন একটি শাড়ি তৈরিতে খরচ পড়বে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকার মতো। তবে প্রযুক্তির সাহায্য এবং বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করতে পারলে খরচ আরও কমে আসবে।' তিনি এই শাড়ি তৈরি করতে পেরে দারুণ খুশি হয়েছেন তার প্রতিক্রিয়াই এ সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই ভেবে আমিও আপ্লুত, কলাগাছের সুতা থেকে শাড়ি তৈরি হওয়ায় তাঁতশিল্পে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। এখন এটিকে বাণিজ্যিক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজন গবেষণা ও পৃষ্ঠপোষকতা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হবে, সেই সঙ্গে জেলায় কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হবে। তবে তার জন্য কারিগরি সহায়তা ও কারিগরদের প্রশিক্ষণের দরকার রয়েছে। এগুলো সমন্বয় করা গেলে কারিগররা আরও দক্ষ হয়ে উঠবে। তবে কলাগাছের সুতা মসৃণ নয়। এই সুতাকে কীভাবে আরও মসৃণ ও নরম করা যায়, তার জন্য গবেষণা দরকার। সব ধরনের সহযোগিতা পেলে হয়তো বাংলার তাঁতশিল্পে নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে।

  • লেখক ও সাংবাদিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা