× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে

ইমতিয়ার শামীম

প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৪৫ এএম

আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:২৯ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

পাশাপাশি দুটি সংবাদ - দুটিই চোখকে ঝাপসা করে তোলে। প্রতিদিনের বাংলাদেশের প্রথম পাতায় গত ১২ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছিল খবর দুটি। একটির শিরোনাম 'স্বর্ণের ডিমপাড়া হাঁসটিই জবাই', ’আরেকটির বিদায় স্পষ্টভাষী'। নিতান্তই কাকতালীয়, কিন্তু গভীর এক সম্পর্ক রয়েছে খবর দুটির ভেতর। প্রথম খবরটিতে উন্মোচন করা হয়েছে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের, হাসপাতালের একটি ভয়ঙ্কর দুর্নীতি-অনিয়মকে। দ্বিতীয় খবরটি, লেখাই বাহুল্য, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চলে যাওয়ার সংবাদ। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে গণমুখী, জনবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত করে তোলার জন্যে এই মানুষটি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। খবর দুটি পড়তে পড়তে আমরা অজান্তেই উপলব্ধি করি, স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নিরাপদ ও গণমুখী করার প্রতিবন্ধকতা কোথায়; উপলব্ধি করি, স্পষ্টভাষী ও একাগ্র মানুষদের উদ্যোগও কীভাবে কোনো চোরাবালিতে ডুবে যেতে পারে; উপলব্ধি করি- এমন মানুষদের বিদায় ও অনুপস্থিতি আমাদের ভবিষ্যৎকে কীভাবে আরও সংকটজনক করে তুলছে।

“স্বর্ণের ডিমপাড়া হাঁসটিই জবাই' শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে সাংবাদিক রাজবংশী রায় তুলে এনেছেন আমাদের এই দেশে অসুস্থ শিশুকে নিয়ে গরিব অভিভাবকদের শেষ ভরসাস্থল ঢাকা শিশু হাসপাতালের ভয়ানক ও হৃদয়বিদারক এক দুর্নীতিকে। এই ঘটনা দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে অনাথ, গরিব, অসহায় জন্মগত শিশু হৃদরোগীদের সুচিকিৎসার বিশাল এক উদ্যোগকে। কষ্ট আর কান্না পেলেও ডাক্তারদের খুব একনিষ্ঠতা নিয়ে স্বাভাবিক ও নির্বিকারভাবে রোগীদের চিকিৎসা করে যেতে হয়। বোধ করি এ গুণটি তাদের আছে বলে ভয়ানক ও হৃদয়বিদারক এই অনিয়মটিও তারা সংঘটিত করতে পেরেছেন দিনের পর দিন চক্রান্তমূলক পরিকল্পনা করে ভয়ঙ্কর স্বাভাবিকভাবে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে জন্মগত শিশু হৃদরোগীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে রোগী যত কমই হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ খুবই ব্যয়বহুল। যে মেডিক্যাল ডিভাইস ও যন্ত্রপাতি শিশুর এ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করতে হয়, সেটি কিনতে হয় চড়া দামে। তা ছাড়া এর বাইরেও রয়েছে নানা ব্যয় ও দীর্ঘকালীন চিকিৎসার ধকল। গরিব শিশু রোগীদের অভিভাবকদের জন্যে নিঃসন্দেহে এটি এক দুঃসহ পরিস্থিতি। অথচ বাংলাদেশে প্রতিবছর এই ডিভাইস ও যন্ত্রপাতি কিনতে হয় মাত্র ৪০ থেকে ৫০ জন শিশুর জন্য। জন্মগত এই শিশু হৃদরোগীরা যাতে সঠিক চিকিৎসা ও শুশ্রূষা পান, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ত্রাণ তহবিল থেকে ১০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিলেন।

অর্থ বিভাগ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ অর্থ পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, টাকাগুলো এফডিআর করে রাখা হবে এবং এ থেকে প্রতিবছর যে লভ্যাংশ মিলবে, তা দিয়ে হাতে গোনা ওই শিশুদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। অনেক চিন্তাভাবনা করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কেউ বলতে পারেন, কেন, এফডিআর করার এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো কেন? এর উত্তর খুবই পরিষ্কার- পুরো ১০ কোটি টাকা খরচ করে যদি এ চিকিৎসায় ব্যবহৃত মেডিক্যাল ডিভাইস ও যন্ত্রপাতি কিনে ফেলা যেত, তা হলে টাকাগুলোই নষ্ট হতো। কেননা, প্রথমত. এত বেশি রোগী আমাদের নেই; দ্বিতীয়ত, পুরো টাকা দিয়ে ডিভাইস ও যন্ত্রপাতি কিনে ফেললে তার পরিমাণ হতো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি এবং ব্যবহারের মেয়াদও সেগুলোর শেষ হয়ে যেত দ্রুত। সংশ্লিষ্টরা চিন্তা করে দেখেন, এফডিআর করা গেলে প্রতিবছর যে টাকা লাভ হিসাবে পাওয়া যাবে, তা প্রতিবছর এক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। সে ক্ষেত্রে এই ১০ কোটি টাকা দিয়ে সম্ভব হবে বছরের পর বছর জন্মগত শিশুদের চিকিৎসা করা। কিন্তু কমিশনখোর কয়েকজন ডাক্তার বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখেননি। তারা সুযোগ বুঝে এক বছর পেরোতেই না পেরোতেই এফডিআর আর রিনিউ করার সুযোগ না দিয়ে পুরো ১০ কোটি টাকার ডিভাইস আর যন্ত্রপাতি কিনে ফেলেছেন, যার পরিমাণ চাহিদার তুলনায় চার-পাঁচগুণ বেশি। তা ছাড়া এসব যন্ত্রপাতি-ডিভাইসের কর্মক্ষমতা বা কার্যকারিতাও ফুরিয়ে যাবে ২০২৫ সালের মধ্যেই! স্বাস্থ্য খাতে এর চেয়ে বড় বড় দুর্নীতি ঘটেছে। এর চেয়ে অনেক বেশি-বেশি কমিশন আদানপ্রদানেরও খবর শুনেছি আমরা। সে তুলনায় এই হাঁস জবাই করে লুটে নেওয়া কমিশনের পরিমাণ খুব বেশি নয়।

কিন্তু এ ঘটনার তাৎপর্য এখানেই, সামান্য কমিশন লুটপাটের জন্যও আমাদের শিক্ষিত, জ্ঞানী, পেশাদার একশ্রেণির মানুষ এতই হন্যে হয়ে আছেন যে, সে জন্যে শিশুদের ভবিষ্যৎকে কাটাকাটি করতেও তাদের দ্বিধা নেই। আরেক দিক থেকেও এ ঘটনার তাৎপর্য আছে- লুটপাটকারী এই চক্রটির ভিত এতই শক্তিশালী যে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে পাওয়া অর্থও তারা লুটে নিতে পারে নিপুণভাবে। যারা এই সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন, তারা নিঃসন্দেহে এই সরকারের বিবেচনায় বিশ্বস্ত; আর বিশ্বস্ত বলেই তো অর্থ বিভাগ ও ব্যবস্থাপনা বোর্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তাদের পদায়ন ঘটেছে। এমনকি এমন একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পরও তারা দিব্যি আছেন। এ দেশে দুদক আছে, শিশুস্বার্থ সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী অনেক সংগঠন আছে, আছে মানবাধিকার কমিশন থেকে শুরু করে একাধিক নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে সক্রিয় সংগঠন, এমনকি রয়েছেন হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট করার মতো অনেক আইনজীবী। তাদের কাউকেই এখন পর্যন্ত সক্রিয় হতে দেখা যায়নি এই ইস্যুতে। তার পরও এই দেশের মানুষ যে এখনও স্বপ্ন দেখতে পারে, এখনও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে জানে, তার কারণ বোধ করি এই, হাজারে না হোক, লাখে না হোক, কোটিতে অন্তত একজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো মানুষ এখানে এখনও জন্ম নেন। শুধু জন্মই নেন না, ইস্পাতদৃঢ় প্রত্যয়ে নিজের লক্ষ্যে অবিচলও থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশে বেসরকারি উদ্যোগে বিশেষত তিনটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ঘটনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যার একটি এই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, আর অন্য দুটি হলো ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংক। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানই তাদের কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে সাধারণ মানুষকে। যদিও ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের উপসংহারের সঙ্গে গণস্বাস্থ্যকে কখনই মেলানো যায় না। ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে, সুশীল ও করপোরেট কালচারের স্পৃহাদীপ্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের আশীর্বাদ ক্ষেত্রে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বেশ পিছিয়েই আছে। কিন্তু গণস্বাস্থ্যের কৃতিত্ব এখানেই, প্রতিষ্ঠানটি প্রমাণ করেছে কত কম খরচে মানুষের কাছে তার মৌলিক সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব, কত রকমভাবে মানুষের ভোগবাদী প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করা সম্ভব এবং তার সুপ্ত কর্মোদ্দীপনাকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে নিয়ে তার যাত্রা শুরু করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের ধারাবাহিকতায়।

আমাদের দুর্ভাগ্য, এমন গৌরবোজ্জ্বল অতীত পেরিয়ে আমরা কিনা পৌঁছেছি স্বর্ণের ডিমপাড়া হাঁস জবাইয়ের কালে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চেয়েছিলেন জাতীয় ওষুধনীতি ও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও কার্যকর করতে। স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মানুষের দোরগড়ায় নিয়ে যেতে। সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এ নীতিগুলো প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন যত না জনস্বার্থে, তারও বেশি জনগণের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে। আমরা তখন ছাত্র। আমরা সামরিক শাসনের বিরোধিতা করেছি; এ-ও বলেছি, সামরিক, অগণতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলো চায় জনগণের চোখে আইকন হয়ে ওঠা ব্যক্তিত্বকে রাবার স্ট্যাম্প করে তুলতে। এখন অনেককে বলতে শুনি, সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণেই নাকি জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রণয়ন করা যায়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ও অগণতান্ত্রিক শাসনকাঠামোয় যে কোনো ভালো উদ্যোগে জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন থাকার পরও তা কার্যকর হতে পারে না। যদি কার্যকর করতে চাওয়া যায়, তা হলে তা করতে হবে বিপ্লবাত্মক উপায়েই। জাতীয় ওষুধনীতির কথাই ধরা যাক। এই নীতির কারণে আমাদের এখানে ওষুধশিল্পের উত্থান ঘটেছে। ধনীক উদ্যোক্তা শ্রেণির এই স্বার্থটুকু পূরণ ও সংরক্ষণ করার জন্যেই শুধু এ নীতিটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এ নীতিতে জনবান্ধব যে বিষয়গুলো ছিল, সেগুলো আর কার্যকর করা হচ্ছে না।

১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়ার সময় জাতীয় ওষুধনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনও এসেছে। সরকার পাল্টেছে, কিন্তু ওই গণবিরোধী পরিবর্তন রয়েই গেছে। নিরীহ দেশপ্রেমিক জনগণের সামনে দেশীয় শিল্পের মুলা ঝুলিয়ে দিয়ে ওষুধের ভাগ্য এখন নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করছে মূলত ওষুধ কোম্পানিগুলো। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার চোখের সামনে জাতীয় ওষুধনীতিকে গণবিরোধী হয়ে উঠতে দেখে গেছেন। ‘দি পলিটিক্স অব এসেনসিয়াল ড্রাগস' নামে একটি বই লিখেছিলেন তিনি, যাতে উঠে এসেছে ওষুধ নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ঘৃণ্য রাজনীতির কথা। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই শিকার হয়েছেন সে রাজনীতির। আত্মধিক্কারের সুরে বলতে হয়েছে তাকে, গণফার্মেসির ওষুধের দাম এত কম যে মানুষ তাতে আস্থা পায় না। লুটেরা উদ্যোক্তারা মুনাফার স্বার্থে এমন এক জনমানস তৈরি করেছে, যা এখন হাতের লুণ্ঠনের প্রধান হাতিয়ার। যে ওষুধনীতি আশার আলো জ্বেলেছিল তা ব্যবসায়ী শাসিত গণতন্ত্রের ডামাডোলে মরে গেছে, যেমন বিপুল এক অন্ধকারে ঝরে পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের সুবাদে আমাদের এই উঠোনে এসে দাঁড়ানো স্বর্ণের ডিম দেওয়া হাঁসটি।


  • সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা