× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শান্তিচুক্তির উদ্দেশ্য ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩ ১৩:৩১ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

বান্দরবানের রুমায় সেনাবাহিনীর একটি টহল টিমের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে। কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) সন্ত্রাসীদের চালানো এ হামলায় সেনাবাহিনীর দুজন সৈনিক নিহত এবং দুই অফিসার আহত হয়েছেন। ১৭ মে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) বিবৃতিতে জানানো এই খবরটি ১৮ মে প্রকাশ পেয়েছে দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ। বান্দরবানের রুমা উপজেলার সুংসুপাড়ায় সেনা ক্যাম্পের অধীন জারুলছড়িপাড়ায় কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) আস্তানা থাকার কথা জানতে পারে সেনাবাহিনী। ১৬ মে সেনাবাহিনীর একটি দল ওই জায়গার উদ্দেশে রওনা দেয়। দুপুরের দিকে জারুলছড়িপাড়াসংলগ্ন পানির ছড়ার কাছাকাছি পৌঁছানোর পর কেএনএ-এর সন্ত্রাসীরা আইইডি বিস্ফোরণ ঘটায় এবং অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ ঘটনায় দুজন অফিসার ও দুজন সেনা আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে আহতদের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে আসার পর দুজন সেনা মারা যান। কেএনএফের তৎপরতা এতটাই বেড়েছে যে তারা সেনাবাহিনীর ওপরও হামলা করতে শুরু করেছে। পুরো ঘটনা পর্যালোচনা করে একথা স্পষ্ট, অতর্কিত এই হামলা সন্ত্রাসী বাহিনীটির পূর্ব পরিকল্পনারই অংশ। এই হামলার মাধ্যমে তারা ওই অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টি করার পাশাপাশি নিজেদের শক্তিও প্রদর্শন করছে। কেএনএ এর আগেও তাদের শক্তির জানান দিয়েছে। আমাদের স্মরণে আছে, গত মার্চ মাসেও সন্ত্রাসী এই বাহিনী বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ করেছিল। সে সময় তাদের গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন। আহত হয়েছিলেন দুই সেনা সদস্য।

বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রথম বিবেচনার ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেএনএ-এর শক্তির উৎস খুঁজে বের করা। বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এই সশস্ত্র দলটির বিরুদ্ধে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার মতো জঙ্গিগোষ্ঠীকেও বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পাহাড়ে সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী সচরাচর অন্য বাহিনীর সমন্বয়হীনতা কিংবা ঘাটতি অনুসন্ধান করে তাদের পরিকল্পনা সাজিয়ে থাকে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে নির্দিষ্ট এলাকায় আতঙ্ক তৈরি হয়। তাই কেএনএ-এর শক্তির উৎস খুঁজে দেখার পাশাপাশি দ্বিতীয় আরেকটি বিষয়ে ভেবে দেখতে হবে। পার্বত্যাঞ্চলে সামরিক বাহিনীর অভিযান পরিকল্পনা কিংবা কার্যক্রম শান্তিচুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে সেনা অভিযানের সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। অথচ দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকলে এভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। অর্থাৎ ‘সফট অ্যাপ্রোচ’-এর মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানে পৌঁছুনো যাবে না। সামরিক পরিভাষায় বলা হয়, ‘অফেন্সিভ ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’। পার্বত্যাঞ্চলে কেএনএ-এর অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হলে আমাদের অফেন্সিভ পদ্ধতিনির্ভর হয়ে উঠতে হবে। নিকট অতীতে পার্বত্যাঞ্চলে সামরিক বাহিনী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেছে। ওই সময়ে তারা যে কৌশল বা উপায়ে অভিযান পরিচালনা করেছে পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর সেই কৌশল থেকে তাদের বের হয়ে আসতে হয়েছে। আর ওই কৌশল থেকে বের হয়ে আসার কারণেই এই মুহূর্তে সামরিক বাহিনী পার্বত্যাঞ্চলে পুরোপুরি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে রুমা উপজেলার মতো ঘটনা ঘটছে। পার্বত্যাঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে নিশ্চিহ্ন করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ তারা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং পার্বত্যাঞ্চলের স্বাভাবিক জীবনে বিষফোড়ার মতো জিইয়ে আছে। বিষয়টি মাথায় রেখেই ভবিষ্যৎ অভিযান পরিকল্পনা সাজাতে হবে। বিশেষত পার্বত্যাঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রধারী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা কে এবং কিভাবে করবেন তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিত। আলাদাভাবে বিভিন্ন সময়ে একাধিক অভিযান পরিচালিত হতে পারে। যদিও স্বতন্ত্র অভিযান পরিচালনা করা হলে অধিকাংশ সময় সমন্বয়হীনতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর সমন্বয়হীনতা মানেই সশস্ত্র সংগঠনগুলো ফাঁকফোকর খুঁজে পেয়ে অতর্কিত হামলা পরিচালনা করবে। ফলে সামরিক বাহিনীও নানাভাবে ওই অঞ্চলে বিপর্যস্ত হবে। এমনটি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

শান্তিচুক্তি পাহাড়ে শান্তির ছায়া ফেলেছিল। কিন্তু পাহাড়ি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত এবং পাহাড়ে জঙ্গি তৎপরতা যেন শান্তির ছায়া ক্রমেই ফিকে করে তুলছে। কেএনএ বারবার সেনাবাহিনীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে। এর আগেও প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ একটি লেখায় এই সংগঠনের হামলা পর্যালোচনা করে লিখেছি। সেখানে বলা কথাটিরই আবার পুনরাবৃত্তি করে বলি, দেশের এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গিবাদী আদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে তো বটেই, শান্তিচুক্তির পরও চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী পাহাড়ের শান্তি নষ্ট করতে তৎপর হয়ে উঠেছে, তারই সূত্র ধরে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবার একই প্রশ্ন উঠে আসছেÑ পাহাড়ে অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়া আসলে কিসের আলামত? এ কথা অনস্বীকার্য, যারা শান্তিচুক্তির পক্ষে ছিলেন বা আছেন তারা পার্বত্যাঞ্চলের নিরাপত্তা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিক। কিন্তু এই সশস্ত্র সংগঠনগুলো শান্তিচুক্তির পক্ষে নয়। পাহাড়ে শান্তি বিঘ্নিত করার লক্ষ্য নিয়েই তারা সেনা সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনকি পার্বত্যাঞ্চলের সাধারণ মানুষের ওপরও হামলা চালাচ্ছে। অনেক সময় তাদের জিম্মি করছে। অস্ত্রের মুখে পাহাড়ের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে।

একটি বিষয় আমাদের সবারই মনে রাখা প্রয়োজন। শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে শান্তি ধরে রাখার দায় চুক্তির অন্য পক্ষকেও নিতে হবে। অথচ আমরা দেখছি, তারা বরাবরই এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা হওয়া মানে শান্তিচুক্তির ধারা ভঙ্গ হচ্ছে। এ রকম ঘটনা বারবার ঘটলে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে। শান্তিচুক্তির উদ্দেশ্য এভাবে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলে এর গতি শ্লথ হয়ে পড়বে। তাই দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সম্প্রতি কিছু পাহাড়ি গোষ্ঠীর অপতৎপরতার সমান্তরালে জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতাও বাড়ছে। অনেকে ব্যক্তিগত বাহিনীও গড়ে তুলছে এবং নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। নিকট অতীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফে বলা হয়েছে জঙ্গি সংগঠনগুলো পাহাড়কে আর নিরাপদ মনে করতে পারছে না। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতা অনেক সময়ই এর উল্টো সাক্ষ্যও দিচ্ছে। কারণ একসময় জঙ্গি সংগঠনগুলো সমতল অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, চর কিংবা ঘন বনভূমি এলাকায় নিজেদের ঘাঁটি গড়ত। এখন তারা পার্বত্যাঞ্চলে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে সমতলেও ছড়িয়ে পড়ছে। যেহেতু প্রযুক্তির সহজলভ্যতা যোগাযোগের পরিধি আরও বিস্তৃত করে তুলেছে, তাই তাদের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজ হয়ে গেছে। পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে নিজেদের নিরাপদ আস্তানা খোঁজার চেষ্টা করছে। জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততায় এসে পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনগুলোও প্রভাবিত হবে, এমনটা অস্বাভাবিক নয়। আর এই অপপ্রভাবের কারণেই পার্বত্যাঞ্চলে সম্প্রতি কয়েকটি বিচ্ছিন্ন হামলার ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এই বিষয়গুলো বুঝতে পারছে না তা নয়। কিন্তু দুর্গম অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা রয়েছে। তা ছাড়া প্রথমেই বলেছি, পার্বত্য শান্তিচুক্তির কারণে সামরিক বাহিনী অনেক সময় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক এবং তারা প্রতিনিয়ত এ ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনা করছে। এসব অভিযানে সফলতাও মিলছে। কিন্তু বড় সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে যে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে সেগুলোর ক্ষেত্রে আমরা একটু ভিন্ন চিত্র দেখছি। এই মুহূর্তে এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু সামরিক বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাই যথেষ্ট নয়। স্থানীয়দের সহায়তা ও অভিযানের ক্ষেত্রে সমন্বয়মূলক পরিকল্পনা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সবাইকে এ কথা মাথায় রাখতে হবে, সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা নিয়ে এই সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনগুলোকে বিতাড়িত করতে হবে। তবে এখানেই আলোচনা শেষ হয়ে যায় না। অভিযান পরিচালনা করা হলে কিছু ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা থাকবেই। এই ক্ষয়ক্ষতি থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখাটাও কৌশলের অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে আমাদের নতুন কৌশলের কথা ভাবতে হবে। দেখা গেল, কোনো অঞ্চলে সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন হামলা করে না। ফলে সামরিক বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে থাকে ভিন্ন পদ্ধতিতে। এই ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। হামলার সম্ভাব্যতা নানাভাবে যাচাই করে অভিযান পরিচালনা করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। বিশেষত অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক কৌশল নির্ধারণ এবং অভিযান পরিচালনায় দক্ষতা প্রদর্শন জরুরি। আপাতত সামরিক বাহিনী ‘সফট অ্যাপ্রোচ’ অথবা কল্যাণমুখী পদক্ষেপে কোনো ধরনের সুফল পাবে বলে আমি মনে করি না। পার্বত্যাঞ্চলে সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই আরও কঠোর হতে হবে। সেভাবেই অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।


  • নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (আইসিএলডিএস) নির্বাহী পরিচালক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা