উপসম্পাদকীয়
শেলী সেনগুপ্তা
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৩ ১৩:৪২ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
সামাজিক, অর্থনৈতিক
ক্ষেত্রে তো বটেই একইসঙ্গে দৈহিক, মানসিক কিংবা নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের নিপীড়ন ও
বৈষম্যকে নারী নির্যাতন বলা যেতে পারে। আরও সহজ করে বললে, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে
নারী যখন অন্যের দ্বারা জোরপূর্বক বঞ্চনার সম্মুখীন হয় এবং শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির
সম্মুখীন হয় ওই পরিস্থিতিতে তিনি ‘নারী নির্যাতন’-এর শিকার। আধুনিকায়নের এই যুগে পৃথিবী
যখন বিন্দু থেকে বিশাল বৃত্তে পৌঁছানোর কাছাকাছি, তখনও নারী নির্যাতন শব্দ দুটি অভিধানচ্যুত
হয়নি। এমনটি কি আদৌ উচিত? এমন কর্ম যেমন নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কুপ্রভাব
বিস্তার করে, তেমনি পরিবার, সমাজ ও অর্থনীতিকেও ধিরগতি করে। নারী নির্যাতন শুধু ঘরে
নয়, কর্মস্থলেও ঘটে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীকে অর্থ উপার্জনের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার
করা হয়, তা-ও জোরপূর্বকÑ এমন অভিযোগও আছে।
সামাজিক অবক্ষয়
নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার প্রতিযোগিতামূলক কাঠামো নারীকে
এমন এক অবস্থানে ঠেলে দেয় যেখানে নারী ভোগ এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ পণ্য আকারে উপস্থাপিত
হয়। প্রযুক্তি ও বয়ঃসন্ধিক্ষণে যেখানে মানুষ জীবনকে উপভোগ করবে, সেখানে আর্থিক নিরাপত্তা,
মানসিক অবসাদ ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের জোর তাগিদ নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ
করছে নানাভাবে। আর্থিক নিরাপত্তা কিংবা রঙিন জীবনের প্রত্যাশায় কেউ কেউ অবৈধ সম্পর্কে
জড়িয়ে পড়ে। আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক মানুষের যোগাযোগের সীমানা অনেক বৃদ্ধি
করেছে কিন্তু চিন্তার জগতে সীমাবদ্ধতা এনে দিয়েছে। আবেগ বৃদ্ধি করেছে, বিবেক নিষ্ক্রিয়
করেছে। প্রেমের নামে ছলচাতুরীর ফাঁদে পড়ে এবং বিশ্বাসের ওপর ভর করে কিশোরী ও তরুণীরা
অজানার পথে পা বাড়াচ্ছে, প্রতারকের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে নিষিদ্ধ পল্লীতে কিংবা বিদেশের
কোনো মানুষ বেচাকেনার হাটে! প্রথমে বিশ্বাসহীনতার নির্যাতন তারপর শুরু হয় শারীরিক,
মানসিক ও যৌন নির্যাতন।
কোনো কোনো বিবাহিত
নারীও নির্যাতনের বাইরে নন। কেউ কেউ স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ি দ্বারা নির্যাতিত হন।
আবার কখনও সখনও বিধবা কিংবা স্বামীপরিত্যক্ত নারী পরিবারের পুরুষ সদস্য দ্বারা নির্যাতিত
হয়ে বাস্তুহারা হন এবং এসব ক্ষেত্রে সম্পদ হয়ে ওঠে মূল উপাত্ত। তা ছাড়া নারী ও শিশু
অপহরণ, আটক করে মুক্তিপণ আদায় বা দাবি, নারী ও শিশু পাচার, নারী ও শিশু ধর্ষণ বা ধর্ষণের
কারণে মৃত্যু ঘটানো, যৌনপীড়ন, যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে
অঙ্গহানি করা ইত্যাদি তো আছেই। এর সঙ্গে রয়েছে যৌতুকের জন্য নির্যাতন, অপহরণ করে মুক্তিপণ
আদায়ের হুমকি। এজন্য কখনও সখনও হত্যার মতো জঘন্য ঘটনাও ঘটে। যে মেয়েটি সারা জীবন শান্তি
এবং ভালোবাসার কামনায় কারও হাত ধরেছিল, অঢেল অর্থ কামনায় সেই হাত তাকে ফ্যানের সঙ্গে
ঝুলিয়ে দিতে কিংবা রেললাইনে তার দেহ ফেলে রাখতে একটুও দ্বিধা করেনি। যে নারীর নিপুণ
হাতে তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে দেশে আসে বৈদেশিক মুদ্রা, সেই হাত একসঙ্গে
জুড়েও নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেনি, পারেনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঁচাতে। আসা-যাওয়ার
পথের কান্ডারি তার সম্ভ্রমের সঙ্গে কোমল প্রাণ ছিনিয়ে নিয়েছে। মেলেনি বিচার। এমনতর
ঘটনা বারবার ঘটছে। এখনও কান্নার ধ্বনি অনুরণিত হচ্ছে চলার পথে কিংবা রাতের যাত্রীবাহনে।
গণপরিবহনেও নিরাপদ
নয় নারী। তার চলার স্বাধীনতা মানুষের ভিড়েই অনিশ্চিত। প্রাণে বেঁচে গেলে এ অভিযোগও
আছে, ভুক্তভোগী কেউ কেউ সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায় অভিযুক্তদের আইনের আওতায়
আনার কথা ভাবেন না। ভয়ভীতি দূর করে সাহস নিয়ে অপরাধীর বিচার প্রত্যাশায় এগিয়ে যেতে
হবে। আমরা জানি, সাম্প্রতিককালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা
বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা রূপ নিয়েছে নারীকে হেয় করার প্রবণতায়। প্রায়ই ঘটছে
নৃশংস ঘটনা। নারীকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে অশোভন আচরণেরও। এ থেকে উত্তরণের
জন্য যেমন নির্যাতিতকে বিচারের জন্য এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ।
সমাজে জাগিয়ে তুলতে হবে সচেতনতা। পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি যুবসমাজকে
নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ
করতে হবে। তাদের মধ্যে নৈতিকতার বীজ বুনে দিতে হবে, সঠিক পরিচর্যাও করতে হবে। করতে
হবে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা।
অনেক ক্ষেত্রেই
বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি কিংবা বিলম্বিত বিচার এ ক্ষেত্রে আরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রায়ই
কেঁদে কেঁদে ফিরছে অসহায় নারী এবং তাদের পরিবার। নারী নির্যাতন বন্ধে প্রচলিত আইনের
পাশাপাশি বাংলাদেশে ২০০০ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ পাস করা হয় এবং ২০০৩
সালে এতে কিছু সংশোধন আনা হয়। এ আইনে বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী ও শিশু অপহরণ,
আটক করে মুক্তিপণ আদায় বা দাবি, নারী ও শিশু পাচার, নারী ও শিশু ধর্ষণ বা ধর্ষণে মৃত্যু
ঘটানো, যৌনপীড়ন, যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে অঙ্গহানি
করা, ধর্ষণের ফলে জন্মলাভকারী শিশুসংক্রান্ত বিধানসংবলিত অপরাধের বিচারের ব্যবস্থা
গ্রহণের বিষয়গুলো এসেছে। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ সর্বশেষ ২৬ নভেম্বর, ২০২০-এ
সংশোধন আনা হয় হয়।
অনেকেরই প্রশ্ন আছে, তার পরও আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কি? নেতিবাচক প্রশ্ন আরও আছে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমন জরুরি তেমনি সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলাও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। নারী নির্যাতনের মতো গুরুতর ব্যাধি যদি সমাজে জিইয়ে থাকে তাহলে বিকশিত সমাজের স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাবে। আর কতদিন নীরবে ঝরবে? কতদিন মৃত্যুসম যাতনায় ভুগবে অঘটনের শিকার নারীরা? আর কতদিন নীরবে কাঁদবে বিচারের বাণী? এই আঁধার দূর করতেই হবে। এখনও কেন কাটেনি আঁধারÑ এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে ন্যায়বিচার।