× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

উপসম্পাদকীয়

সংকট কাটিয়ে ওঠার পথ দেখাবে এবারের বাজেট

ড. আতিউর রহমান

প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৩ ১৩:৪৭ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

এটা বলাই বাহুল্য যে, বিগত প্রায় দেড় দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আগের তিনটি অর্থবছরেও প্র্রথমে করোনা আর পরে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমরা নানামুখী নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি এবং যতটা সম্ভব মোকাবিলা করেছি। সাম্প্রতিক এই অর্থবছরগুলোতে বড় বড় চ্যালেঞ্জের মুখেও বৃহত্তর জনস্বার্থের প্রতি সংবেদনশীলতার জায়গা থেকে আমাদের নীতিনির্ধারকরা বাজেট প্রণয়ন করেছেন এবং তা বাস্তবায়নে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তাই আসছে অর্থবছরেও তারা এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সক্ষম হবেন বলেই মনে করি।

আশা করা যায়, বিগত তিনটি অর্থবছরে সংকটকালীন বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে, তার ভিত্তিতে আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতি আরও বেশি সংবেদনশীলতা দেখাতে সক্ষম হবেন আমাদের বাজেটপ্রণেতারা। একই সঙ্গে জনগণকেও বুঝতে হবে একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিবেশে এই বাজেটটি প্রণয়ন করতে হচ্ছে। তাই নুন আনতে পান্তা ফুরানোর আশঙ্কা থাকতেই পারে। সবাইকে এই বাস্তবতা মেনেই আগামী বাজেটকে বিশ্লেষণ করার মানসিকতা দেখাতে হবে।

সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে বৃহত্তর জনগণকে বিশেষ করে কম আয়ের পরিবারগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া। এবারের বাজেট অধিবেশনের আগে প্রাক-বাজেট আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনাগুলোতেও কেন্দ্রে থাকছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। তবে এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই শুধু বাজেটারি উদ্যোগ দিয়ে নয়, বরং বাজেট ও মুদ্রানীতির পরিপূরক ও সুসমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমেই কেবল কার্যকরভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গত বছরের শেষদিকে এ প্রসঙ্গে আইএমএফের ফিসক্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক ভিটোর গ্যাসপার যথার্থ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাপক ঋণের বোঝা, বর্ধিষ্ণু সুদের হার এবং ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে মুদ্রানীতি ও জাতীয় বাজেটের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিতকরণ সর্বোচ্চ গুরুত্বের দাবিদার। এ জন্য অধিকাংশ দেশেই জাতীয় বাজেটকে সংকোচনমুখী রাখা বাঞ্ছনীয়।’

অনেকে অবশ্য বাংলাদেশের চলমান সংকট মোকাবিলায় মুদ্রানীতির মাধ্যমে নীতি সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে নাÑ এমন ধারণা দিচ্ছেন। তবে সত্যি হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটি দরকারি ধাপ হালো মুদ্রানীতির মাধ্যমে নীতি সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ নিশ্চিত করা। সুদের হার না বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর নজির নেই। তবে এর সঙ্গে কিছু বাজেটারি পদক্ষেপও দরকার হবে। কেননা সাপ্লাই সাইড সক্রিয় করেও মূল্যস্ফীতি খানিকটা নিশ্চয় কমানো সম্ভব। মূল্যস্ফীতির পেছনে সরবরাহ ঘাটতির বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ ও কম বা বিনামূল্যে কম আয়ের মানুষকে খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে সামাজিক সংরক্ষণে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সংকট উত্তরণের জন্য মুদ্রানীতি ও বাজেটের মধ্যে সুসমন্বয় যে একান্ত জরুরিÑ এ কথা মানতেই হবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হলে সরকারের অর্থ দরকার হবে। কাজেই প্রথমেই ভাবা চাই সরকারের রাজস্ব আয় নিয়ে। রাজস্ব প্রসঙ্গে যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো, আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে সে তুলনায় রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। জিডিপির তুলনায় আমাদের রাজস্ব ১০ শতাংশেরও কম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কখনই এই অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি হতে পারেনি। কিন্তু সমতুল্য অন্য দেশগুলোতে এই অনুপাত আরও বেশি হওয়ায় আমি মনে করি বাংলাদেশে জিডিপির অন্তত ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ কর আহরণ খুবই সম্ভব। ইদানীং আইএমএফসহ অন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরাও সরকারের আয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথাটি জোর দিয়ে বলতে শুরু করেছে। জিডিপির অন্তত আধা শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায়ের তাগিদ দিচ্ছে তারা। তাই আসছে বছরের বাজেটে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিকে আগের তুলনায় বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন নীতিনির্ধারকরা। সন্দেহ নেই, এটি একটি চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য। তবে যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। অনেক কঠিন কাজই আমরা দক্ষতার সঙ্গে সহজ করতে পেরেছি। চাই সুষ্ঠু যথাযথ কর্মপরিকল্পনা ও দায়বদ্ধতা।

পুরো কর-কাঠামোটিই ঢেলে সাজানোর কথা ভাবা দরকার। যেমন বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির ন্যূনতম করের যে ব্যবস্থা আছে, তা বদলানোর কথা ভাবা যায়। বর্তমানে করযোগ্য আয় থাকলেই ঢাকা সিটির মধ্যে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাকে ন্যূনতম ৫ হাজার টাকা এবং অন্য এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা কর দেওয়ার বিধান রয়েছে। তার চেয়ে যার ওপর যতটুকু কর প্রযোজ্য ঠিক ততটুকু দেওয়ার বিধান। যেমন হিসাব অনুসারে কারও প্রদেয় কর দেড় হাজার টাকা হলে তিনি তা-ই দেবেনÑ এমন নিয়ম চালু করা গেলে করদাতার সংখ্যা ও করের পরিমাণ উভয়ই উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব। নিশ্চয় নিয়মনীতি সহজ করাই সবচেয়ে ভালো প্রণোদনা। এরই অংশ হিসেবে ডিজিটালি আয়কর ফাইল দাখিলের যে সুযোগ আছে তাকে আরও কার্যকর করা প্রয়োজন। করদাতাদের এ-বিষয়ক অভিযোগ/জিজ্ঞাসাগুলো শোনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের আদলে একটি স্মার্ট হটলাইন চালু করা জরুরি। রাজস্ব বোর্ড করবিষয়ক মামলা জটের কারণে প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এডিআরসহ মামলা নিষ্পত্তি দ্রুততর করার জন্য যা যা দরকার, তাই করা উচিত। বিশেষ করে বিকল্প কর নিষ্পত্তির সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।

আয় বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় সঙ্কোচনের দিকেও নজর দেওয়া চাই। এবারের বাজেটে সরকারি ব্যয়ের লাগাম তো টেনে ধরতেই হবে। তবে তা হতে হবে বাস্তবতার নিরিখে এবং সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকা মানুষদের সুরক্ষাকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিয়েই। সঙ্গত কারণেই আমাদের বাজেটপ্রণেতারা আসছে বছরের জন্য কিছুটা সঙ্কোচনমুখী বাজেট তৈরি করতে চাইবেন। তবে এ সঙ্কোচনের প্রভাব সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতগুলোর ওপর যত কম পড়বে ততই মঙ্গল।

ভর্তুকি কমিয়ে আনা এবং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাড়তি বরাদ্দের মাধ্যমে নিম্নআয়ের মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার ওপর জোর দিতেই হবে। এ লক্ষ্যে গৃহীত সব কর্মসূচি বাস্তবায়নেও স্বচ্ছতা-দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে সর্বশেষ খানাভিত্তিক আয়-ব্যয়ের জরিপমতে আমাদের দারিদ্র্য হার ১৮ শতাংশের কিছু বেশি এবং অতিদারিদ্র্য ৫ শতাংশের আশপাশে নেমে এসেছে। আর দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য হার যত কমে আসে তা আরও কমিয়ে আনাটি ততই বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে ‘পোভার্টি পকেটস’গুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে সেগুলোর জন্য উপযোগী বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া একটি চমৎকার সমাধান হতে পারে।

চলমান বিশ্ব আর্থিক সংকটের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকরা এখন পর্যন্ত যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন, তার ভিত্তিতে এ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নিশ্চয় রয়েছে। আইএমএফের ঋণের একটি কিস্তি এসে গেছে, আরও আসবে। তাদের দেখাদেখি বাকি আন্তর্জাতিক সহযোগীরাও এগিয়ে আসছে। জুনের আগেই এডিবির অর্থছাড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকও এগিয়ে আসবে বলে আশা করা যায়। এই প্রেক্ষাপটে আসছে মাসে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপিত হতে যাচ্ছে। এটি সংকট উত্তরণের পথনকশা হিসেবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী, করদাতা এবং জনগণের মধ্যে আশা-ভরসা সঞ্চার করবে বলেই আমার মনে হয়।


  • অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা