× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাজনীতি

জামায়াতের ফের আবির্ভাবের অন্তর্নিহিত রহস্য কী

আবদুল মান্নান

প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৩ ১৪:০৯ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

দেশের সাধারণ মানুষ তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে অনেকটা হতভম্ব করে দিয়ে প্রশাসন গত ১০ জুন একাত্তরের ঘাতক দল জামায়াতে ইসলামীকে ১০ বছর পর প্রকাশ্যে সভা করার অনুমতি দিল! অনুমতি পেয়ে জামায়াত ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বেশ প্রস্তুতি নিয়েই তাদের সভা করেছে। সভা থেকে সরকারবিরোধী অন্য দলগুলোর নেতারা যে ভাষায় কথা বলছেন, জামায়াত নেতারাও সেই ভাষায় কথা বলেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়েছেন। অথচ এই জামায়াতকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি সন্ত্রাসী দল বলে নিষিদ্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর সরকারের আইনমন্ত্রী নিয়মিত বিরতি দিয়ে বলছেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার আইন হচ্ছে। জামায়াত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। ক’দিন আগে তাদের কয়েকজন নেতা ঢাকার পুলিশ প্রশাসনের কাছে সমাবেশ করার অনুমতি চাইতে গেলে আটক করা হয়। অবশ্য পরে তাদের ছেড়েও দেওয়া হয়। পুলিশ প্রশাসন তখন বলেছিল, একটি অনিবন্ধিত দলকে তারা সামাবেশের অনুমতি দিতে পারে না। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পুলিশের কাছে ভুল তথ্য ছিল। কিন্তু কী ভুল তথ্য ছিল, তিনি তা পরিষ্কার করেননি। এর আগে যখনই জামায়াত বা ছাত্রশিবির ঘরোয়া কোনো সভা করার চেষ্টা করেছে, পুলিশ তখন ওই গোপন বৈঠকে হানা দিয়েছে, তাদের আটক করেছে।

দেশে কিংবা রাজনীতিতে হঠাৎ এমন কী প্রয়োজন হলো জামায়াতের মতো একটি যুদ্ধাপরাধী দলকে সরকার ফের আলোয় আসার সুযোগ দিয়েছে? দেশের কোনো বিবেকবান মানুষ এই ঘটনাকে সহজভাবে নেয়নি এবং নেওয়ার কোনো কারণও নেই। সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষীদের ধারণা, সরকারের ভেতর বসে থাকা খন্দকার মোশতাকের প্রেতাত্মারা এমন একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে প্ররোচিত করছে। সরকারের ভেতরে-বাইরে এমন ব্যক্তিরা এখন কিলবিল করছেন। অনেকের সঙ্গে আলাপ করে মনে হয়েছে, সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে। ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল এই বলে, এ এলিট বাহিনী তাদের ভাষায় মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত। র‌্যাব জঙ্গিবাদ দমনে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। জামায়াত একটি স্বীকৃত জঙ্গি সংগঠন এবং তারা যদি অতীতের মতো দেশে যখন অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করবে, তখন র‌্যাব তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। কেন নিতে পারবে না, তাও স্পষ্ট করা দরকার। নিতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র চিৎকার শুরু করবে, র‌্যাব বিরোধী রাজনৈতিক দলকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে বাধা দিচ্ছে। ১০ জুন জামায়াতের সমাবেশ দেশের রাজনীতিতে ফের আরেকবার কালো অধ্যায়ের সূচনার পরিষ্কার পূর্ব লক্ষণ। এটি মনে রাখতে হবে, বিশ্বের ভয়াবহতম জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি আর যুক্তরাষ্ট্রের বদৌলতে তাদেরই অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা এখন বেশ দাপটের সঙ্গে আফগানিস্তান শাসন করছে। জামায়াতের কর্মকাণ্ডে দেশে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে, যেমনটি হয়েছিল এক-এগারোর আগে। তারপর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য আর একটি ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিন সরকার সৃষ্টি করবেÑ এমন কথাও দুর্মুখেরা বলছেন। তেমনটি যে হতে পারে তা বোঝা গেল দেশের একটি বেসরকারি টিভির টকশো শুনে। ওই টকশোর সঞ্চালকের একটি নিজের এনজিও আছে, যেটি চৌদ্দটি বিদেশি সংস্থার অর্থায়নে চলে, যার মধ্যে আছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও একাধিক সংস্থা। এই ব্যক্তি এক এগারোর পর বঙ্গবন্ধুর আত্মাস্বীকৃত খুনি কর্নেল (বরখাস্ত) আবদুর রশিদকে তার অনুষ্ঠানে হাজির করেছিলেন। তিনি দুদিন আগে তার অনুষ্ঠানে প্রশ্ন রেখেছেনÑ ‘তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র জাল গোটাতে শুরু করেছে।’ তার চেয়ে অন্য কেউ এ বিষয়ে ভালো জানার কথা নয়।

কারও কারও মতে সরকার জামায়াতকে প্রকাশ্যে আসতে দিয়েছে রাজনৈতিক কিছু লক্ষ্য সামনে রেখে। তাদের ধারণা হলো, জামায়াতকে বিএনপি থেকে আলাদা করার এটি একটি চেষ্টা। জামায়াতের হয়তো এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই, কিন্তু তা পাওয়ার ব্যবস্থাও সময়মতো করা হবেÑ এ কথাও বাতাসে ভাসছে। জনমনে এই শঙ্কা দেখা দিয়েছে, তাহলে কি সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেবে? কিছু মানুষ তাদের চিন্তাধারাকে একটু সামনে নিয়ে আরও বলছে, হয়তোবা সরকার নির্বাচনে কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার অঙ্গীকারও করতে পারে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে তো কিছু নেই। স্মরণে আছে, সরকার এমন আত্মঘাতী কাণ্ড হেফাজতকে নিয়েও করেছিল। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এই সত্যটা বুঝতে সম্ভবত অপারগ, হেফাজত বা জামায়াতের মতো জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসনির্ভর কোনো মৌলবাদী সংগঠনকে যতই তোষণ করা হোক না কেন তারা কখনও আওয়ামী লীগকে কোনো প্রকার সমর্থন দেবে না, ছাড়ও দেবে না। বরং এটাই সত্য, তারা যদি কখনও সুযোগ পায় তাহলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আর সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে তাদের কচুকাটা করবে। দেশে আরও একটি রক্তাক্ত  অধ্যায়ের সৃষ্টি হতে পারে, যার আলামত ২০০১ সালের নির্বাচন শেষে দক্ষিণবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন জনপদে দেখা গিয়েছিল। ওই দুঃসহ স্মৃতি শান্তিপ্রিয় মানুষকে এখনও তাড়া করে। এও সত্য, সৃষ্ট ওই ক্ষত এখনও শুকায়নি।

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে ১০ জুন জামায়াতকে সমাবেশ করতে দেওয়া ছিল একটি টেস্ট কেস। প্রশ্ন হচ্ছে, কীসের টেস্ট কেস? বিষাক্ত সাপ যে ছোবল মারে তা কি প্রমাণ করতে হয়? ২০১৩ সালে অগ্নিসন্ত্রাসের মূল কারিগর তো ছিল জামায়াত শিবির। তাদের নিয়ে নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কি এমন প্রয়োজন হলো আবার? এ দেশে রগ কাটার অপসংস্কৃতির জন্মদাতা জামায়াত, তা সচেতন কে না জানেন। একাত্তরে তাদের ভূমিকার কারণে জামায়াতকে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাদের নেতাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সংবিধান পরিবর্তন করে জামায়াতকে ফের রাজনীতি করতে দিয়েছিলেন। কোন বোকায় বিশ্বাস করবে, জামায়াতকে ছাড় দিলে তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে চলে আসবে?

আওয়ামী লীগ সম্ভবত এখনও বুঝতে পারে না, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সংঘবদ্ধ থাকলে তাদের পরাজিত করতে পারে এমন শক্তি এখনও বাংলাদেশে জন্ম হয়নি। আওয়ামী লীগের সমস্যা হচ্ছে নিজেদের শক্তির ওপর তাদের অনেকেরই আস্থা কম। তার ওপর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের মূল দর্শনই হচ্ছে ‘নগদ যা পাই হাত পেতে নেই বাকির খাতা শূন্য থাক’। এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তারা সর্বদা সরকারকে ভুল পথে পরিচালনা করতে তৎপর। একজন শেখ হাসিনা কি সবকিছুই করবেন? তাকেই যদি সব করতে হয় তাহলে এত এত সভা পারিষদ জনগণের অর্থে লালন-পালন করে কী লাভ? জামায়াত প্রসঙ্গে সরকারের চিন্তাধারা পরিবর্তন না করলে এ দেশে স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ওপার হতে অভিশাপ দেবেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধাকরা যেন ভ্রান্তি কাটিয়ে ওঠেন।  

আবারও বলি, একজন শেখ হাসিনা দশভুজা নন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের চিত্র অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালোÑ তা অস্বীকারের পথ নেই। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে আমরাও চলমান সংকটের বাইরে থাকতে পারি না। অনেক ভোটার তা নাও বুঝতে পারেন। দলের দায়িত্বশীলদের কাজ হলো তাদের বোঝানো এবং এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা। যদি দেশের মানুষকে এই বিষয়গুলো বোঝানো যায়, তাহলে আওয়ামী লীগকে জামায়াতের মতো অপশক্তির ওপর ভর করতে হবে না। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করে নতুন ভোটারের বাজারে বাজিমাত করেছিল আওয়ামী লীগ। এই বিচার প্রক্রিয়া এখনও চলমান। ইতোমধ্যে অনেকের দণ্ডও কার্যকর হয়েছে। আওয়ামী লীগ এর মধ্য দিয়ে যে অর্জন করেছে, তার যেন বিসর্জন না দেয় কোনো ভুল সিদ্ধান্তের কারণে-এও প্রত্যাশা।

আশা করব, জামায়াতের অতীত কর্মকাণ্ড সরকার, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ভুলে যাবে না। তাদের বিশ্বাস করলে বিষয়টি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাজনীতিতে কৌশল অবশ্যই অপরিহার্য, কিন্তু মনে রাখতে হবে, অপকৌশল পরিত্যাজ্য। রাজনীতির মাঠে কিংবা সংবাদমাধ্যমে এক দশক পর জামায়াতকে মাঠে নামার সুযোগ করে দেওয়ায় যেসব নেতিবাচক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে, এর নিরসন ঘটলেই স্বস্তি। সঙ্গতই এও প্রত্যাশা করি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের পথে ফিরে আসুক বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ।

 

  • শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সাবেক চেয়ারম্যান, ইউজিসি
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা