× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জঙ্গি তৎপরতা

উগ্রবাদীদের শিকড় এক জায়গায় প্রোথিত

মোহাম্মদ আলী শিকদার

প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৩ ০৬:০১ এএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

ঈদের জামাতে উগ্রবাদীদের হামলা ও ধর্মীয় ভিন্ন মতাদর্শের অনুসারীদের মধ্যে হামলার আশঙ্কায় পুলিশের সব ইউনিটকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। ইতোমধ্যে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়ার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য এলাকায় তাদের আশ্রয়দাতা কুচি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রধান জঙ্গি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু শামিন মাহফুজ আত্মসমর্পণের প্রস্তাব ফিরিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে পাল্টা প্রতিরোধের ঘোষণা দেন। এই জঙ্গি নেতাকে সস্ত্রীক ২৩ জুন গ্রেপ্তার করা হয় রাজধানীর ডেমরা অঞ্চল থেকে। পার্বত্যাঞ্চল থেকে সমতল, সর্বত্র জঙ্গি অপতৎপরতা দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আগে থেকেই যে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, তাদের এই কর্মতৎপরতা সাধুবাদযোগ্য।

দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনের তৎপরতা নতুন কিছু নয়। ধর্মান্ধ ও উগ্রবাদী চিন্তা-চেতনার রাজনৈতিক ভাবনা যারা বহাল রেখেছে, তাদের অনেক তথ্যই আমাদের জানা। এই মুহূর্তে উগ্রবাদী সংগঠনগুলো রয়েছে কোণঠাসা অবস্থায়। কিন্তু মূলধারার রাজনীতিকে তারা নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়ার নাম বেশি শোনা যাচ্ছে। জঙ্গি সংগঠনের নাম যা-ই হোক না কেন, তাদের রাজনৈতিক ভাবনা উগ্রবাদী। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, নতুন বোতলে পুরোনো মদ। এই জঙ্গি সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে। ধর্মীয় উগ্রবাদী রাজনৈতিক চেতনা অতীতে আমাদের ওপর বিষফোড়া হয়ে চেপে বসেছিল। ওই সংকট থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেও দেশ থেকে সব উগ্রবাদী সংগঠন একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে-এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। এখন তারা যেহেতু কোণঠাসা অবস্থানে রয়েছে, তাই সুযোগের সন্ধান করছে যাতে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নাজুক করে তুলতে পারে। সেজন্য ঘন ঘন নাম বদলাচ্ছে এই জঙ্গি সংগঠনগুলো। উগ্রবাদীদের শিকড় মূলত এক জায়গায়।

আগেই বলেছি, নতুন নামে আত্মপ্রকাশিত জঙ্গি সংগঠনগুলো নতুন কিছু নয়। ২০১৬ সালে জরিপের মাধ্যমে ১২২ থেকে ১২৫টি জঙ্গি সংগঠনের নাম জানা গিয়েছিল। তখন বহু ধর্মীয় উগ্রবাদী চেতনার নামধারী দলের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছিলাম। নিজেদের সুবিধার জন্য এই সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় নাম পরিবর্তন করে। কিন্তু নাম বা দল ভিন্ন হলেও এই সংগঠনগুলোর লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। এসব সংগঠনের মধ্যে পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য কিছু ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনের মদদপুষ্টদেরও পাওয়া যাবে। এ কথা সত্য, তাদের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নেতৃত্ব, অর্থ আর কৌশলের সমন্বয়ে বিভিন্ন সময় তাদের ভোল পালটাতে হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই সংগঠনগুলোর বক্তব্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ২০১৫-১৬ সালে বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সম্পৃক্ততা জানা যায়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের দূতাবাসে কর্মরত মাজহার খান নামের এক ব্যক্তি আনসারুল ইসলাম, জেএমবিসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনকে অর্থ বিতরণ করছিলেন। তিনি পুলিশের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েন। তাকে বনানী থানায় আটকে রাখা হয়। কিন্তু যেহেতু তিনি দূতাবাসের কর্মকর্তা, তাই কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশে প্রবেশে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরবর্তী সময়ে শিরিন আখতার নামের আরেক দূতাবাস কর্মরতাকেও অর্থ বিতরণের সময় আটক করা হয়।

পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন লস্কর-এ-তৈয়বা, আল মুজাহিদীন ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনও একসময় দেশে অপতৎপরতা চালিয়েছে। তাদের বহু সদস্য ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত তৎপরতা চালিয়েছে। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ থেকে ২০১১ সালে অনেক জঙ্গি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছিল। আইএসআই বিভিন্ন ছদ্মবেশে বাংলাদেশে জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে। তাদের উদ্দেশ্য প্রধানত দুটি। প্রথমত, দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা। যদি তা সম্ভব হয় তবে দেশের ভেতর তারা বড় পরিসরের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। এভাবেই একাত্তরে পরাজিত হওয়ার প্রতিশোধ তারা নিতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা আমাদের পরিস্থিতিকে অশান্ত করে তুলতে চাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন গড়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গেও যে আইএসআই ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা রয়েছে তার প্রমাণও ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি। ২০১৬ সালের ১২ মের ঘটনা। তখন আমি লিখেছিলাম, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বিষফোড়া হয়ে উঠতে পারে। রোহিঙ্গাদের একাংশ যারা জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত তারা পার্শ্ববর্তী আনসার ক্যাম্পে হামলা পরিচালনা করে। সেখান থেকে অস্ত্র লুটসহ তারা বেশকিছু অপতৎপরতা চালিয়ে পালিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন আনসার সদস্যও নিহত হন। পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রধানকে আটক করতে সক্ষম হয়। তাকে আটক করার পর জানা যায়, তিনি পাকিস্তানের নাগরিক। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গেও পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠনের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

পার্বত্যাঞ্চলে কুকি চীনকে নিয়ে আমাদের এত ভাবার কিছু নেই। এরা সংখ্যালঘু জাতিসত্তার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। এই অঞ্চল বাদে তারা আর কোথাও সক্রিয় নেই। অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতাবাদী এই সংগঠনগুলোর বড় সমর্থন নেই। তারা মূলত পার্বত্যাঞ্চলে আধিপত্য চায়। সম্প্রতি কুকি চীনদের সংখ্যা বেশি দেখা যায় ভারতের মণিপুরে। সম্ভবত এদের একাংশ এখানে আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে লুটপাট করে কিছুদিন আরামে থাকার জন্য। এ ছাড়া এদের বৃহত্তর কোনো স্বার্থ নেই। তবে ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের বিষয়টি আমাদের জন্য বিপদের। কুকি চিন বা অন্যান্য সংগঠন সামরিক বাহিনীকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য বারবার হামলা করছে। কিন্তু এরা আমাদের এখানে বেশিদিন প্রভাব বিস্তার করে রাখতে পারবে না। এদের ব্যবহার করে পরিস্থিতি যেন আরও ঘোলাটে না হয়ে ওঠে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তো বটেই, সামাজিক পর্যায়েও সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এই দুয়ের সমন্বয়ই পারে উগ্রবাদীদের পরিকল্পনা রুখে দিতে। এজন্য কঠোর নজরদারি জরুরি।

কয়েক বছর ধরেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কোনোবারই তারা সফল হয়নি। তাদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী যথেষ্ট তৎপর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানে জঙ্গিরা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও তারা নিজদের আদর্শের পথ থেকে সরে গেছে এমনটি বলা যাবে না। বরং তারা সুযোগ সন্ধান করছে নিজেদের পুরোনো রূপ ফিরে পেতে। এ ক্ষেত্রে ঈদ জঙ্গিদের জন্য একটি বড় সুযোগ। কারণ ঈদে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে থাকে লম্বা ছুটি। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অনেক সদস্যও অর্জিত ছুটি কাটান। সঙ্গত কারণেই নিরাপত্তা পরিস্থিতি কিছুটা ঝুঁকির মুখে থাকে। মানুষের মধ্যেও কিছুটা স্বস্তি কাজ করে। মানুষ তার সহজাত বৈশিষ্ট্য অনুসারেই ছুটির আমেজে অসতর্ক অবস্থানে থাকে। তাই ঈদের আমেজকে সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়ে জঙ্গিরা হামলা চালাতে পারে, এমন শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। স্মরণে আছে, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান ঘটনার পর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানের ঈদ জামাতে জঙ্গিরা হামলা পরিচালনা করে। অতীতের ঘটনা থেকেই বলা যায়, জঙ্গি তৎপরতা যখন বাড়ে তখন ছুটির সময় বড় জমায়েতে হামলার আশঙ্কা থাকে। ঈদ জামাতে জঙ্গি হামলার বিষয়টি যেহেতু পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনীর নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেই পাওয়া, তাই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিতে হবে। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে সম্ভাব্য কিছু জায়গাও হয়তো চিহ্নিত। ওইসব স্থানে বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তাহলে জঙ্গিরা অঘটন ঘটাতে সক্ষম হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী যদি তাদের নির্ভরযোগ্য তথ্যানুসারে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে পারে, তাহলে জঙ্গিরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পারবে না।

সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরেকটি বিষয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে মাথায় রাখতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসছে। এই জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে যেহেতু রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তাই দেশের ভেতর এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে রাজনৈতিক সংকট তৈরির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জঙ্গিরা যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে অন্যদিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে পারে, তাহলে রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা প্রবেশ করার একটা পথ খুঁজে পাবে। তাই কঠোর নজরদারির বিকল্প নেই।

  • বীর মুক্তিযোদ্ধা; অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা