ফ্রান্সে সহিংসতা
কেইথ মেজি
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৩ ০০:১১ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
২৭ জুন প্যারিসের পশ্চিমের শহরতলিতে ১৭ বছর বয়স্ক আলজেরিয়া বংশোদ্ভূত ফরাসি গাড়িচালককে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা করা হয়। ট্রাফিক স্টপেজে সঠিক সময়ে না থামার অভিযোগে তাকে গুলি করা হয়। এ ঘটনায় টানা তিনদিন ফ্রান্সে বিক্ষোভ ও সহিংসতা চলে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রায় ৪০ হাজার পুলিশ কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করা হয়। তিনদিনে শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের দায়ে মামলা করা হয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নাহেল হত্যাকাণ্ডকে ক্ষমার অযোগ্য বলে অভিহিত করেছেন। তবে তিনি এও জানিয়েছেন, এই হত্যাকাণ্ডের উপযুক্ত বিচার করার মতো আইনি কাঠামো নেই। আমি নিশ্চিত নাহেলের মৃত্যুর মীমাংসা সহসাই হচ্ছে না। আমার এই বক্তব্যের পক্ষে দুটো ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, বর্ণবাদী আচরণের দায় রাষ্ট্র স্বীকার করতে রাজি নয় এবং দ্বিতীয়ত, ট্রাফিক স্টপেজের সময় পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র ব্যবহারের নিয়মনীতি সম্পর্কে আইনি অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।
যুক্তরাজ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে এই
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে নিহতের ধর্মীয় পরিচয় বেশি গুরুত্ব পেত। কিন্তু ঘটনাটি
ফ্রান্সের। তাই এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে বর্ণবাদের দায় বেশি। বিস্ময়কর হলেও সত্য, সংবাদমাধ্যমগুলো
এ বিষয়ে কোনো উচ্চবাক্য করেনি। ব্যতিক্রম যে নেই তাও নয়। তবে এই সংখ্যা কম। তাদের
সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকই সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগের
অধিকার রাখে। তবে ব্যক্তির ক্ষেত্রে হিসাবটা আলাদা। রাষ্ট্রকাঠামো শুধু নাগরিক পরিচয়কে
প্রাধান্য দেয়। প্রজাতন্ত্রের আদর্শের সঙ্গে একাত্মবোধ করেন যারা, তাদের সমান
সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার
নিশ্চয়তা দেয়। ১৯৭৮ সালের এক আইন অনুসারে কারও ব্যক্তিগত তথ্যে জাতি, বর্ণ, ধর্ম ও
অন্যান্য পরিচয় উন্মুক্ত না করার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ রয়েছে। ফরাসি সমাজে বর্ণাবাদী
আচরণ অনেকটা অদৃশ্য অবস্থায় রয়েছে।
ফ্রান্সের জনসংখ্যার অধিকাংশই অভিবাসী। আফ্রিকা, ক্যারিয়ান
দ্বীপপুঞ্জ এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এবং তাদের বংশধররা দেশটির জনসংখ্যার
সিংহভাগ দখল করে আছে। বিগত কয়েক দশক ধরেই অভিবাসী বংশোদ্ভূতরা বৈষম্যের অভিযোগ জানাচ্ছেন। কিন্তু
প্রচলিত আইন তো বর্ণ, ধর্ম বা
জাতির ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহে বাধা দিয়ে আসছে। তাই পিছিয়ে পড়া এই নাগরিকদের সঠিক
সংখ্যাও যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা
ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কতটুকু বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে তাদের, তাও আমাদের
জানা নেই। এভাবেই ফ্রান্সে বর্ণবাদী আচরণ অনেকটা অদৃশ্য হয়ে আছে। অবশ্য ২০২২ সালে
ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল কনসালটেটিভ কমিশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অন্তত ১
দশমিক ২ মিলিয়ন ফরাসি নাগরিক বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন। ৬৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার
একটি দেশে এত বড় সংখ্যার বর্ণবাদী আচরণ সচরাচর
ব্যক্তিগত আক্রমণ বলে অভিহিত হয়। কাঠামোবদ্ধভাবে
বর্ণবাদের বিষয়টি কখনই সামনে আসে না। প্রমাণ করারই বা সুযোগ কোথায়?
বর্ণবাদী
আচরণ যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই এক ধরনের বিষফোঁড়া। কৃষাঙ্গ হিসেবে আমি যুক্তরাষ্ট্র
এবং যুক্তরাজ্যÑ এই দুই দেশেই বাস করেছি। তাই এই দুই দেশের পুলিশি
অত্যাচারের চিত্র ভালোভাবেই জানি। এটি শুধু আমার মুখের কথা নয়। পরিসংখ্যানও একই
কথা বলে। ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে এই নির্মমতার অবসান আমি দেখতে চাই। দুঃখজনক হলেও
সত্য, ফ্রান্সে এমনটি সম্ভব হয়। ফ্রান্স নিজেকে
বর্ণবাদবিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করে। বাস্তবে তারা বর্ণান্ধ। কাঠামোগতভাবেই
তারা বর্ণবাদী।
ফ্রান্সের অভিবাসীদের সিংহভাগই কৃষাঙ্গ কিংবা উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত। সচরাচর
তাদের শহরতলি অঞ্চল কিংবা বড় শহরের প্রান্তিক অঞ্চলে ঠাঁই নিতে হয়। সেখানে সামাজিক
ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা থাকে কম। বর্ণবাদী আচরণের শিকার এই মানুষদের
পক্ষে দুর্দশা ও হতাশাচ্ছন্ন হওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। কিন্তু ছাইচাপা আগুনের
মতো তাদের বুকেও কাঠামোর প্রতি ক্ষোভ জমে আছে। বর্ণবাদী
আচরণের শিকার তরুণ নাহেলের মৃত্যু ওই আগুন আবার জাগিয়ে তুলেছে।
২০১৭ সালে জঙ্গি তৎপরতা বাড়ায় ফ্রান্সে
নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি
পায়। আর এই আইনই তাদের বর্ণবাদী আচরণের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ করে
দেয়। শুধু ট্রাফিক স্টপেজে না থামার কারণে তারা এক তরুণকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। ২০২২
সালে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে এই
আইনের বাহানায় অন্তত ১৩ জনকে হত্যা করা হয়। চলতি বছর নাহেল এই
আইনের স্বেচ্ছাচারিতার তৃতীয় শিকার। ২০১৭ থেকে এখন পর্যন্ত যত মানুষ এই আইনের
আওতায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তাদের
অধিকাংশই কৃষাঙ্গ নয়তো আরব বংশোদ্ভূত। বিগত কয়েকদিনে ফ্রান্সে সহিংসতা আমাদের
দেখিয়ে দিচ্ছে শহরতলিতে বর্ণবাদী আচরণ কতটা উগ্র রূপলাভ
করেছে।
যারা বিক্ষোভ করছেন তাদের অনেকেই প্রজাতন্ত্রের
প্রতীকের ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে হামলা করছেন। টাউন হল এবং
বিদ্যালয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ এবং অগ্নিনির্বাপণ বাহিনীর ওপরও হামলা
করা হচ্ছে। নাহেলের মায়ের নেতৃত্বে ৬ হাজার মানুষের পদযাত্রাও পুলিশের সঙ্গে
সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফ্রান্স সরকারের উচিত দ্রুত এই আইনের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া।
তা ছাড়া
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও তাদের নিতে
হবে। ফরাসি পুলিশ এবং পুরো সমাজকাঠামোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা বর্ণবাদী আচরণকে
তদন্তসাপেক্ষ চিহ্নিত করা না গেলে শহরতলিতে বর্ণবাদী আচরণের নির্মম শিকারের সংখ্যা
বাড়তেই থাকবে। ফ্রান্সের শহরতলি এলাকায় বিক্ষোভ বাড়লে উগ্র ডানপন্থীরাই বেশি
লাভবান হবেন। নির্বাচনকালীন
স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা নানাভাবে বর্ণবাদের বীজ বপন করবেন এবং মানুষকে
শতধাবিভক্ত করবেন।
‘স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব’Ñ ফ্রান্স
প্রজাতন্ত্রের এই তিন মূলমন্ত্রই দেশটিকে গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত
করে তুলেছে। কিন্তু কাঠামোবদ্ধভাবে তারা বর্ণবাদ জিইয়ে রেখেছে। অসংখ্য নাগরিক
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা নিজেদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে। তাদের দাবি-দাওয়াও থাকে উপেক্ষিত।
গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে
দুর্দশার ঘটনা আর কিই-বা হতে পারে।
আমাদের প্রত্যাশা, নাহেলের এই
মৃত্যুর ঘটনায় প্রচলিত কাঠামোতে সুপ্ত বর্ণবাদী বীজের বিষয়টি অন্তত সচেতন মহলের
নজরে এসেছে। ফ্রান্সের নাগরিকদের অনুধাবন করতে হবে, কীভাবে
বর্ণবাদ ও বৈষম্যের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা যায়। গণতান্ত্রিক একটি দেশেও যখন ‘ঘটনাটি ভুল’ বলা নিষিদ্ধ, তখন
প্রত্যাশার পাল্লা ভারী করার সুযোগ থাকে কম।
সিএনএন থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন