শেয়ারবাজার
সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৩ ১৯:২১ পিএম
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২৩ ০০:০৫ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
নিকট অতীতে শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে
ডিএসইর চেয়ারম্যান আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘শেয়ারবাজার ঝিমিয়ে চলছে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই
শেয়ারবাজার দেশের অর্থনীতিকে কাঁপিয়ে তুলছে’। এখানেই প্রশ্ন। ৮০/৯০-এর দশকে বাংলাদেশের
শেয়ারবাজারকে ঝাঁকুনি দিয়েছিল অশুভ চক্র। একটি ওষুধ কোম্পানির প্রতি শেয়ার (ফেস ভ্যালু
১০০ টাকা) প্রিমিয়াম ৮শ টাকা চাপিয়ে দিয়ে আইপিওতে ছিল। প্রয়োজনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি
শেয়ার বিক্রিও হয়েছিল। কোম্পানিটি এখনও কলকাঠি চালনাকারী-এ অভিযোগ অনেকের। তখন অনেক
বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও গ্রীনফিল্ড প্রকল্পের শেয়ারও পর্যাপ্ত বিক্রি হয়েছিল। আইপিওর
জন্য বাংলাদেশ ছিল স্বর্ণখনি। ১৯৯৬ এবং ২০০৯-১০ সালে দুই দফায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের ফলে
অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারী মার্কেট ছেড়ে চলে যান। ডিএসইর চেয়ারম্যান নিশ্চয়ই জানেন, বর্তমানে
সাধারণ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা শতকরা ১/২ ভাগের বেশি হবে না। এ দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে
ঝাঁকুনি-কাঁপানি দেওয়া সম্ভব নয়। নিজেদেরই কাঁপতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে যেন আর কোনো বিপর্যয়
না ঘটে, তার জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা নেতিবাচক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নতুন বিনিয়োগকারীর জন্য আইপিওর দরজা বন্ধ। কেননা আইপিওতে আবেদন
করতে হলে বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। আর শেয়ার কেনাবেচা হোক না হোকÑ বছরে ৫শ টাকা দিতে
হবে। এমনটি মোটেই কাম্য নয়। এমন পরিস্থিতি হলে অ্যাকাউন্টে ২০ হাজার টাকার শেয়ার বিনিয়োগ
থাকতে হবে। অথচ আইপিওর জন্যও তো প্রয়োজনীয় টাকা দিতে হবে। শেয়ারবাজারে ঘোরাফেরা করে
পাকাপোক্ত হয়ে তারপর আইপিওতে আবেদন করা হয়। উচ্চস্বরে বলা হয়, পুঁজিবাজার স্থায়ী পুঁজি
সরবরাহ করবে। ব্যাংক অস্থায়ী পুঁজি দেবে। বিনিয়োগকারী শেয়ার মার্কেটে না এলে দেশের
শিল্প কিংবা অন্য পরিষেবার জন্য পুঁজি আসবে কীভাবে? সব সময় বলা হয়ে থাকে এবং তা যথার্থও
বটে, জনগণের সঞ্চিত অর্থ দেশের উন্নয়ন প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এই পুঁজি তথা
আইপিওর মাধ্যমে। কিন্তু এতে তো দায়বদ্ধতা থাকে না। সঞ্চয়পত্র সরকারের দায়। সে জন্য
বারবার দাবি করা হয়, সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমিয়ে আনা হোক যেন মানুষ শেয়ারবাজারমুখী
হয়।
বাংলাদেশের আইপিওর মাধ্যমে টাকা উঠানোর আর একটা অন্তরায় কিছু
বাণিজ্যিক ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলো যেন ঋণখেলাপিদের খেলার মাঠ। আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার
হচ্ছে, দেশের আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন ব্যাংক খোলার অনুমতি
দেবে, কিন্তু তাও মানা হচ্ছে না। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যতিক্রমÑ এ কথা একাধিকবার সাবেক
অর্থমন্ত্রী মরহুম আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন। তিনি বলেছেন যে বিরাজমান অর্থনৈতিক
পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংক খোলার পরিস্থিতি নেই। কিন্তু তারপরও ব্যাংক খোলা হয়েছে এবং
হচ্ছে। বাংলাদেশের আইপিও ছাড়ার সময় এত কোটা রাখা হয়, যার ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের
জন্য খুব কম শেয়ার রাখা হয়। একজন স্টক এক্সচেঞ্জ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনারা
কি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজারে আসতে নিরুৎসাহিত করছেন? তিনি বললেন, ক্ষুদ্র
বিনিয়োগকারীদের নিয়ে ‘দুষ্ট লোকেরা’ সহজে ম্যানিপুলেট করতে পারে। এ যেন মাথার ব্যথা
দূর করতে মাথা কেটে ফেলার অবস্থা! এ প্রসঙ্গে একটা কথা আসে। এসএমই নিয়ে বেশ তৎপরতা
চলছে স্টক এক্সচেঞ্জে। এসএমইর পুঁজি তুলনামূলকভাবে কম। সেখানে কি দুষ্ট লোকেরা ‘খেলতে’
পারবে না?
বেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের (বিএসইসি)
নেতৃত্বে বিশাল এক দল আন্তঃমহাদেশীয় রোড শো করে এলেন। এতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ডিএসইর
চেয়ারম্যানও এই আক্ষেপ করেছেন। বর্তমান অবস্থা দেখলে, সেই পুরাতন আমলের তৈলাক্ত বাঁশে
বানরের ওঠার অংকের কথা মনে হয়। আমরা দেখছি, সূচক বাড়লে শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ কমে যায়,
আবার শেয়ার লেনদেন বাড়লে সূচক কমে যায়! একটি সেমিনারে পরিকল্পনামন্ত্রী বক্তব্য রেখেছিলেন।
তিনি বলেছেন, ‘তিনি যখন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তখন বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার বাজারে
আনার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি’। বহুজাতিক কোম্পানির কথা দূরে থাক, এক সময় তৎকালীন
অর্থমন্ত্রী নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে বলেছিলেন, রাষ্ট্রের নিকট যে শেয়ার আছে তা আইপিওর
মাধ্যমে ছাড়া হবে। কিন্তু তা হয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে
রূপান্তরিত করা হয়েছে। কিন্তু সেইসব ব্যাংকের সিংহভাগই আজও একটি শেয়ার বাজারে ছাড়েনি।
২০০৯-১০ সালের শেয়ারবাজারে মহাবিপর্যয়ের পর সাবেক অর্থমন্ত্রী
মরহুম মুহিত দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, ‘স্টক এক্সচেঞ্জের সংস্কার করতে হবে’। স্টক এক্সচেঞ্জ
ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হলো। বোর্ড অব ডাইরেক্টরে সরকারের মনোনীত সদস্যদের সংখ্যা বেশি।
প্রত্যাশা এই ছিল স্টক এক্সচেঞ্জে করপোরেট বৈশিষ্ট্যে পরিচালিত হবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে
মনে হচ্ছে, করপোরেট বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক প্রভাব বেশি লক্ষণীয়। বিএসইসি
পরিপূর্ণরূপে স্টক এক্সচেঞ্জকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিনিধিদের
তেমন মূল্য দেওয়া হচ্ছে না। এমতাবস্থায় শেয়ারবাজারকে সত্যিকার পুঁজি সরবরাহকারী
প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। স্টক এক্সচেঞ্জ একটি উপদেষ্টা
পরিষদ গঠন করতে পারে, যেখানে স্টক এক্সচেঞ্জের অভিজ্ঞ সদস্য এবং অন্য শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট
বিশেষজ্ঞরা সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক চেয়ারম্যান
আব্দুল হক হাওলাদার, আহমেদ ইকবাল হাসান, শাকিল রিজভীসহ স্টক এক্সচেঞ্জের অনেক সদস্য
রয়েছেন, যারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে আগ্রহী। যে উদ্দেশ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের
জন্ম হয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে, বর্তমানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে যেভাবে বিনিয়োগকারীবিহীন
হতে চলেছে তাতে অর্থযোগ বাড়বে। বিনিয়োগ মানে পুঁজি সরবরাহÑ যার উদ্দেশ্য উৎপাদন, পরিষেবা
বৃদ্ধি। আর অর্থযোগ হলো অর্থনেতিক ইনস্ট্রুমেন্টকে নিয়ে ব্যবসা করা। বিশ্বের অনেক অর্থনীতিবিদ
তা নেতিবাচকভাবে দেখেছেন। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কোনটা গ্রহণ করব।
আবার আগের কথায় ফিরে আসি। পরিকল্পনামন্ত্রী মহোদয় এখনও চেষ্টা করতে পারেন সরকারের হাতের শেয়ার এবং ব্যাংকের শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে যেন ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। একই সঙ্গে কাটাতে হবে আস্থার সংকট। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার সর্বাগ্রে। তাহলেই স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান সে রকম স্টক এক্সচেঞ্জ পাবেন, যেমনটি তিনি চাচ্ছেন।