রাজনীতি
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৩ ১৪:১৫ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
বিএনপির গুগলিতে
আওয়ামী লীগ বোল্ডআউট হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম
আলমগীর। ৩১ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলীয় এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘২৮ জুলাই বর্তমান
সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ রায় দিয়েছেÑ এ মুহূর্তে গদি ছাড়তে। সেদিন বিএনপির গুগলিতে আওয়ামী
লীগ বোল্ডআউট হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ বুঝতেই পারেনি কোন দিক দিয়ে বলটা এলো।’ (প্রতিদিনের
বাংলাদেশ, ১ আগস্ট, ২০২৩)। বিএনপি মহাসচিবের এ মন্তব্য উপভোগ্য সন্দেহ নেই। কেননা রাজনীতিকে
যখন ক্রীড়ার সঙ্গে তুলনা করা হয় তখন তা উপভোগ্য হওয়ারই কথা। তবে এই খেলায় জনগণ দর্শক
হলে আম্পায়ার বা রেফারি কেÑ এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকে আমরা
আম্পায়ার হিসেবে ধরে নিতে পারি। তাদের পরিবেশিত খবর এবং মন্তব্য থেকে খেলায় কোন পক্ষ
পয়েন্ট বেশি পেল তা অনুমান করা সম্ভব। সংবাদমাধ্যম বিএনপির বর্তমান আন্দোলনকে কীভাবে
বিশ্লেষণ করছে, তা একটু খতিয়ে দেখা দরকার।
প্রথমেই বলে নেওয়া
দরকার বিএনপির গুগলিতে আওয়ামী লীগ আউট হয়ে গেছেÑ মির্জা আলমগীরের উক্তিটি আমার যথার্থ
মনে হয়নি। কেননা কোনো খেলোয়াড় আউট হয়ে গেলে তার আর ব্যাট হাতে পিচে থাকার কথা নয়। কিন্তু
দৃশ্যমান সত্যি হলো, আওয়ামী লীগ এখনও বহাল তবিয়তে পিচে আছে এবং ভালোভাবেই প্রতিপক্ষের
বল মোকাবিলা করে চলেছে। এটা ঠিক, ২৮ জুলাই বিএনপি চলমান আন্দোলনে একটি বড় ধরনের ঢেউ
তুলতে পেরেছিল। তবে সে ঢেউয়ের ধারাবাহিকতা তারা রক্ষা করতে পারেনি। পূর্বনির্ধারিত
না থাকা সত্ত্বেও মহাসমাবেশের মঞ্চ থেকে হঠাৎ করে পরদিন রাজধানীর চারটি প্রবেশমুখে
অবস্থানের মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া ছিল এক ধরনের হঠকারিতা। ফলে আগের দিনের মহাসমাবেশের
তুলনায় ওই অবস্থান কর্মসূচি ছিল সুপার ফ্লপ। শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার এবং স্থায়ী
কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ অনেকের আহত হওয়া। এরই বিরূপ ফল। সমাবেশ থেকে নেতাকর্মীদের নির্দেশ
দেওয়া হয়েছিল ঢাকায় অবস্থান করে সরকার পতনের ধারাবাহিক আন্দোলনে শরিক হতে। তাদের ওপর
এ নির্দেশও জারি করা হয়েছিল, প্রত্যেক নেতাকর্মীকে পরদিন অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিতে
হবে। কিন্তু নেতাকর্মীর বেশিরভাগ ওই নির্দেশ মানেননি। মহাসমাবেশে যে পরিমাণ জনসমাগম
হয়েছিল, অবস্থান কর্মসূচিতে তার এক দশমাংশও ছিল না। তাহলে আগের দিনের লাখ লাখ নেতাকর্মী
কোথায় গেলেন? ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, ২৯ জুলাইয়ের অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণার
আগ পর্যন্ত শীর্ষনেতাদের কেউই জানতেন না। এ নিয়ে আগের কোনো সভায় আলোচনাও হয়নি। রাজনৈতিক
পর্যবেক্ষকদের মতে, বিশেষ কোনো স্থান থেকে আসা নির্দেশেই ওই আকস্মিক কর্মসূচি ঘোষণা
করা হয়েছিল। ফলে অধিকাংশ নেতাকর্মী তাতে অংশ নিতে উৎসাহ বোধ করেননি।
অন্যদিকে বেশ
কিছুদির ধরেই আওয়ামী লীগের ছোটবড় নেতারা বলে আসছেন ‘খেলা হবে’। যদিও সেই খেলার স্বরূপটা
কী, তা তারা খোলাসা করেননি। তবে বিএনপি নেতারা গোড়া থেকেই বলে আসছেন, আওয়ামী লীগের
এ খেলা হলো পেশিশক্তির প্রয়োগ। তারা আওয়ামী লীগকে পুলিশ ছাড়া খেলতে আসারও আহ্বান জানিয়েছেন
অনেকবার। তা সত্ত্বেও এতদিন এই রাজনৈতিক খেলা সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা-বিবৃতি আর বাগ্যুদ্ধের
মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বিএনপির ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি এবং তাতে পুলিশের
মারমুখী আচরণ আগামী দিনের রাজনীতিতে সহিংসতার আভাস দিচ্ছে।
‘গরম’ কর্মসূচির
পর বিএনপি আবার ‘নরম’ কর্মসূচিতে ফিরে গেছে। সরকার পতনের লক্ষ্যে সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের
রাজধানীতে সমবেত করে পুনারায় তাদের তৃণমূলে ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ
বিএনপির এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে ‘হার্ডলাইন
থেকে সরল বিএনপি’ (৩১ জুলাই, ২০২৩)। তাতে বলা হয়েছে, রাজধানীকেন্দ্রিক লাগাতার কর্মসূচির
জন্য মহাসমাবেশকে উপলক্ষ করে সারা দেশ থেকে নেতাকর্মী জড়ো করে আবার মহানগর ও জেলায়
জেলায় ফিরে যাওয়াÑ এটাকে অনেকেই এক দফা আন্দোলনের টানা কর্মসূচি থেকে বিএনপির সরে যাওয়া
হিসেবে দেখছেন। অবস্থান কর্মসূচির মতো ‘কঠোর’ কর্মসূচির পর প্রতিবাদ সমাবেশের মতো
‘নরম’ কর্মসূচি দেওয়ায় বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে হতাশা। তাদের
প্রশ্নÑ আন্দোলনের হার্ডলাইন থেকে বিএনপিকে এক দিনের মাথায় কেন সরে দাঁড়াতে হলো? অবশ্য
বিএনপি নেতারা মনে করেন এটা তাদের কৌশল এবং আন্দোলনে হার্ডলাইন-সফটলাইন বলে কিছু নেই।
তারা আন্দোলনে আছেন। সরকারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে যখন যে কর্মসূচি প্রয়োজন তা দেওয়া
হবে। তবে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের বক্তব্য, একটি দল কর্মীদের প্রস্তুত না করে হঠাৎ ‘কঠোর’
কর্মসূচি দিলে তা থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল আসা অসম্ভব। যেকোনো কর্মসূচি নির্ধারণে নীতিনির্ধারক
ফোরামের বৈঠকে তা আলোচিত হওয়া অত্যাবশ্যক। কিন্তু বিএনপির ২৯ জুলাইয়ের অবস্থান কর্মসূচি
ছিল ‘ওঠ ছেমরি তোর বিয়া’র মতো। রাজনীতির পরিভাষায় এ ধরনের কর্মসূচিকে হঠকারী বলা হয়।
এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ। পল্টন ময়দানে জাসদের জনসভা মঞ্চ থেকে সভাপতি
মেজর (অব.) এমএ জলিল হঠাৎ করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের ঘোষণা দিয়ে মিছিল
শুরু করেন। এর পরিণতি কী হয়েছিল তা সবারই জানা। এজন্যই রাজনৈতিক বোদ্ধারা যেকোনো কর্মসূচি
প্রণয়নের আগে এর প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি সম্পর্কে ভালোভাবে চিন্তাভাবনার কথা বলে থাকেন।
কিন্তু বিএনপির বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত আসে দূর থেকে এবং আলোচনা ছাড়াই। ফলে তা বস্তবায়নে
দেখা দেয় সমন্বয়ের অভাব।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপির ছোড়া গুগলি-ফার্স্ট সব ধরনের বলকেই মোকাবিলা করে চলেছে। তাতে তারা ছক্কা না মারতে পারলেও উইকেট টিকিয়ে রাখতে পারছে। তবে যে ম্যাচ চলছে তার ফলাফল নির্ধারণের সময় এখনও আসেনি। অনেক সময় শেষ বলেও জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। তেমনি একটি ঘটনার কথা আজও মনে আছে। ১৯৮৭ কি ’৮৮ সালে শারজাহ কাপ ক্রিকেটের ফাইনাল ম্যাচ খেলছিল পাকিস্তান ও ভারত। ম্যাচ জিততে পাকিস্তানের দরকার ছিল ১ বলে ৪ রান। ব্যাট করছিলেন আবদুল কাদের। রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। শেষ বলে কাদের হাঁকালেন এক বিশাল ছক্কা। সুতরাং সব গুগলি যে ব্যাটারকে আউট করতে পারবে এমনটি ভাবার অবকাশ কম।