খেলাপি ঋণ
এম হাফিজ উদ্দিন খান
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৩ ১৪:১৭ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
‘চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংকও ডুবছে খেলাপি ঋণে’ শিরোনামে ২ আগস্ট
প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে তা কোনোভাবেই স্বস্তির
নয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দেশের ব্যাংক খাতের উন্নতিতে বড় বাধা হয়ে উঠেছে খেলাপি
ঋণ। দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ২০১৩ সালে অনুমতি পাওয়া
চতুর্থ প্রজন্মের ৯টি ব্যাংকও রক্ষা পায়নি এই খেলাপি ঋণের কবল থেকে।’ খেলাপি ঋণ, ব্যাংক
খাত তো বটেই আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্যও কতটা বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ
অতীতে এই কলামেই করেছিলাম। এ-ও লিখেছিলাম, খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক
সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। খেলাপি ঋণ নতুন কোনো বিষয় নয় এবং বর্তমানে এই ঋণের চিত্র যেভাবে
স্ফীত হয়ে উঠেছে তা অনিয়মের ফল। ইউনিয়ন ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মধুমতি
ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, সাউথবাংলা ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক ও গ্লোবাল
ইসলামি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের যে তথ্য ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাতে সঙ্গতই প্রশ্ন দাঁড়ায়,
এই ব্যাধি কি অনিরাময়যোগ্য হয়ে উঠল? গত এক দশকে নতুন যে ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেওয়া
হয়, এর লক্ষ্য ছিল ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নতুনত্ব আনা। কিন্তু পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা
যাচ্ছে, নতুনত্ব তো নয়ই বরং খেলাপি ঋণের কারণে এই ব্যাংকগুলোর উপসর্গ এতই বেড়েছে যে
তাতে ব্যাংকের গ্রাহকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
আমাদের মনে আছে, সরকারের তরফে ইতঃপূর্বে বলা হয়েছিল, ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের’
নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে এবং বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি
আইনে পরিবর্তন আনা হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এসবই কথার কথা হয়ে আছে। ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’দের
মধ্যে বড় ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পপতিরা তো আছেনই এমনকি ব্যাংকের মালিক, পরিচালকও রয়েছেন।
এই কলামেই লিখেছিলাম, সুশাসন নিশ্চিত করা ছাড়া আর্থিক খাতে, শৃঙ্খলা ফেরানো কঠিন। দেশ
থেকে যারা বিদেশে অর্থ পাচার করছেন কিংবা ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’দের তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন
তারা নিশ্চয়ই অচিহ্নিত নন। বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে ঋণ ফেরত না দেওয়ার ক্ষমতা তারাই দেখান,
যারা বলবান। আমাদের এ-ও স্মরণে আছে, বর্তমান অর্থমন্ত্রী ইতঃপূর্বে এ-ও বলেছিলেন, তার
আমলে খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। অবশ্য এজন্য তিনি দৃশ্যত কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ব্যাংক খাতের ‘বিষফোঁড়া’ খেলাপি ঋণের মতো গুরুতর ব্যাধির
কোনো উপশম তো হয়ইনি, উপরন্তু আরও জটিল হয়েছে। আমরা জানি, ইতঃপূর্বে খেলাপি ঋণের প্রসঙ্গে
কিছু শ্রেণীকরণ করা হয়েছিল, লক্ষ্য ছিল এর সূত্র ধরে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনা। কিন্তু
শেষ পর্যন্ত তা-ও যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি এবং সব আশাই দুরাশায় পরিণত হয়েছে।
খেলাপি ঋণের ক্রমবৃদ্ধি, কম আদায় নিয়ে উদ্বিগ্ন আইএমএফ-এই বার্তা
সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছিল, যা দূর অতীতের নয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি
ঋণের চিত্রও অনেক স্ফীত। আইএমএফকে বাংলাদেশের তরফে বলা হয়েছিল, ব্যাংকের পুনঃ তফসিল
করা ঋণকে খেলাপি ঋণের হিসাবের আওতায় হচ্ছে, যা আগামী জুনের মধ্যে কার্যকর করা হবে।
গত এপ্রিল মাসে সংবাদমাধ্যমে এই তথ্য জানা গিয়েছিল। আইএমএফকে আরও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ
ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে এই তথ্য থাকবে এবং পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে
আর্থিক প্রতিবেদনে ঝুঁকি ও খেলাপি ঋণের তথ্য সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের
ব্যাপারে এ রকম আশার কথা ইতঃপূবে আরও বহুবারই শোনা গেছে। কিন্তু বিষয়টি শেষ পর্যন্ত
বৃত্তবন্দিই থেকে গেছে।
এই কলামেই আরও লিখেছিলাম, খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে বিপর্যস্ত
অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে বললে কম বলা হয়। বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বলতে হচ্ছে,
প্রকৃতপক্ষে দেশের অর্থনীতির জন্য বিসংবাদ সৃষ্টি করেছে খেলাপি ঋণের কশাঘাত। অতীতে
উচ্চ আদালত ব্যাংকের ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের তালিকা তৈরি করে দাখিলের নির্দেশ
দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তরফে এ ব্যাপারে কতটা
কী করা হয়েছে, এর সুস্পষ্ট তথ্য জানা নেই। খেলাপি ঋণ আদায় না করতে পারার কারণে ব্যাংক
খাতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, এ থেকে উত্তরণ সহজসাধ্য নয়। নানাবিধ সংকটে রয়েছে বৈশ্বিক
ব্যবস্থা। আর্থিক খাতও এর অন্তর্ভুক্ত। এই সংকটের ছায়ামুক্ত নই আমরাও। দেশের অর্থনীতির
বিকাশ ইতোমধ্যে এত প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা ডিঙিয়েও যেটুকু হয়েছে তা আরও অনেক বেশি
দৃশ্যমান হতো, যদি আর্থিক খাতের ক্ষতগুলো উপশম করা যেত। খেলাপি ঋণের বৃত্ত থেকে কেন
বের হতে পারছে না দেশের ব্যাংকগুলোÑ এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান কঠিন কোনো বিষয় নয়। আর্থিক
খাতে বিশেষ করে ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতার বিরূপ ছায়া পড়েছে। ঋণ বিতরণে
রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ শিথিলতা ইত্যাদি নানা
কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ স্ফীত হয়ে উঠেছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, খেলাপি
ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা কি দুরূহ? প্রশ্নটি মোটেই সুখকর নয়। ঋণখেলাপিদের হাত কোনোভাবেই আইনের
হাতের চেয়ে লম্বা হতে পারে না। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই
দেশের অনেক ব্যাংকের অবস্থা নাজুক। ব্যাংক খাতে অসাধু কর্মকর্তাদের দাপট ও আধিপত্যের
কারণেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে, এই সত্যও অস্বীকার করা যাবে না।
খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাত ও জাতীয় অর্থনীতির জন্য যে শঙ্কার কারণ হয়ে
দাঁড়িয়েছে, এর নিরসন দ্রুত যদি করা না যায়, তাহলে দেশ-জাতির জন্য পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল
হয়ে দাঁড়াবে। নির্মোহ অবস্থান নিয়ে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া
ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সুশাসন নিশ্চিত
করা। খেলাপি ঋণ নিয়ে ইতোমধ্যে আলাপ-আলোচনা কম হয়নি, সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে অনেক; কিন্তু
কাজের কাজ কতটা হয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর মোটেও প্রীতিকর নয়। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ
প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে কয়েকটি ব্যাংকের
বিবর্ণ চিত্র উঠে এসেছে এর বাইরেও আরও অনেক ব্যাংক রয়ে গেছে। ঋণখেলাপিদের অপছায়ায় যেগুলোর
অবস্থা মোটেও ভালো নয়। জনগণের গচ্ছিত আমানতের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে ঋণখেলাপিদের
কারণে। ব্যাংক খাত দেশের সামগ্রিক আর্থিক খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত, যে খাতটিকে
দেশের রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করা অমূলক কিছু নয়। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে
দায়ের করা মামলাগুলোর যেমন দ্রুত নিষ্পত্তি প্রয়োজন, তেমনি এ জন্য বিশেষ বিচারব্যবস্থা
প্রয়োজন বলেও মনে করি। ঋণখেলাপিদের কারণে সৎ ঋণগ্রহীতা, যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন,
তারাও নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ব্যাংকের কোনো ঋণগ্রহীতা যদি ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে
যান, তাহলে অন্যরা কেন ঋণ পরিশোধ করবেন, এমন প্রশ্ন ইতঃপূর্বে অনেক অর্থনীতিবিদই উত্থাপন
করেছেন। তাদের এই প্রশ্ন অযৌক্তিক নয়। ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা যেমন
জরুরি, তেমনি দেশের অর্থনীতি বা ব্যাংকব্যবস্থা যে আইনকানুনের ভিত্তিতে চলে, এর যথাযথ
কার্যকারিতা প্রয়োজন। বারবার ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় তো করা যায়ইনি, উপরন্তু খেলাপি
ঋণ আরও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পথ সুগম করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা
একই সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখার জরুরি স্বার্থে ঋণখেলাপিদের কোনো রকম অনুকম্পা
দেখানোর অবকাশ নেই।
এমন দৃষ্টান্তও আছে কোনো কোনো বড় ঋণের ক্ষেত্রে এতটাই অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে যা অচিন্তনীয়। অভিযোগ আছে, অধিকাংশ বড় ঋণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজ করে। এজন্যই এই ব্যাধি উপশমে রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং এর বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা কাঠামোর সংস্কারও একই সঙ্গে জরুরি। আইন থাকা আর আইনের যথাযথ প্রয়োগ এক নয়। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অধিকারের মাঠ সমতল করা জরুরি। যেভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে এর লাগাম টেনে ধরাই শেষ কথা নয়, কীভাবে খেলাপি ঋণ আদায় করা যায়, এর জন্য প্রয়োজন কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনায় নজরদারি কঠোর করা।