× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সাগর-রুনি হত্যা মামলা

তদন্তের সেঞ্চুরি, অপেক্ষার সেঞ্চুরি!

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৩ ০০:২৪ এএম

আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৩ ০০:২৪ এএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

দিন যায় কথা থাকে/সে যে কথা দিয়ে রাখল না/চলে যাবার আগে ভাবল না/সে কথা লেখা আছে বুকেÑ প্রয়াত খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গীত এই গানটির মর্মার্থ অত্যন্ত গভীর। সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপটে আমাদের জীবনের দিনগুলো সত্যিই যায়, সময় ফুরোয়, কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয় না। মানবদেহের খুব সংবেদনশীল অংশ বুক। অনেকের বুকেই পাথরচাপা অনেক কষ্ট আছে, অপ্রাপ্তির খতিয়ান আছে, বঞ্চনার ব্যথা আছে, হতাশার স্পর্শও আছে। এই ভারবাহী বুক নিয়েই কতজনের জীবন কেটে যাচ্ছে অনিশ্চয়তা-অনিরাপত্তা-গন্তব্যহীন গন্তব্যের পথে। এই গৌড়চন্দ্রিকার সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট আছে, যে প্রেক্ষাপট কোনোভাবেই প্রীতিকর তো নয়ই, বরং তা আমাদের অধিকতর ক্ষুব্ধ ও জিজ্ঞাসু করে।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হয়েছিলেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। ২০১২ থেকে ২০২৩ সাল। ১১ বছর কেটে গেছে, কিন্তু সাগর-রুনির হত্যারহস্য এখনও উন্মোচন করতে পারেনি রাষ্ট্রের আইনি সংস্থাগুলো। কী বিস্ময়কর ব্যর্থতা! কী উদ্বেগজনক বার্তা! ১১ বছরে একশবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কতটা অস্বাভাবিকতার মোড়কবন্দি, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় যাদের তারা এখনও প্রতিশ্রুতির বাণীই শুনিয়ে যাচ্ছেন! সাগর-রুনি যখন নিহত হন তখন তাদের একমাত্র সন্তান মাহির সরয়ার মেঘ ছিল পাঁচ বছরের শিশু। মেঘ শৈশব কাটিয়ে কৈশোরের গণ্ডি পেরিয়ে যৌবনের দিকে চলেছে। তার বয়স এখন ১৬। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য এই সন্তানের! ১১ বছরেও ভয়াবহতা-বিভীষিকার ছায়া কাটিয়ে ওঠার অবলম্বন সে পায়নি। অবলম্বন বলতে বোঝাতে চাচ্ছি, যদি সে দেখতে পেত তার বাবা-মা হত্যার বিচার ও খুনির দণ্ড নিশ্চিত হয়েছে, তাহলে তার বেদনার ভারবাহী বুক হয়তো একটু হলেও হালকা হতো। ৭ আগস্ট সোমবার আরেক দফা পিছিয়েছে সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ। ওই দিন দুপুরে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার খন্দকার আল মুইন জানিয়েছেন, ‘প্রকৃত অপরাধীরা এখনও শনাক্ত না হওয়ায় সাংবাদিক সাগর সরয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে দেরি হচ্ছে।’ তিনি এও জানিয়েছেন, এই মামলার তদন্ত তারা আন্তরিকতার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানিতে ডিএনএ স্যাম্পল পাঠিয়েছেন। ওখান থেকে আসা প্রতিবেদনে দুজন সন্দেহভাজনের নমুনা পাওয়া গেছে। তার ভাষ্য, এই দুজন সন্দেহভাজনকে তারা শনাক্ত করতে পারেননি তবে চেষ্টা চলছে।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডারের এই বক্তব্য ওপার বাংলার খ্যাতিমান বহুমাত্রিক লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়। তার এই কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলো যেন শুধুই প্রত্যাশার হোঁচট খাওয়া। কিন্তু তারপরও এই কবিতায়ই আছে প্রশ্ন, আক্ষেপ এবং শেষ পর্যন্ত হতাশায় সমাপ্তি। ‘তারপর কত চন্দ্রভুক অমাবশ্যা এসে চলে গেল, কিন্তু সেই বষ্টুমি আর এলো না’; সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার এই লাইনটির সূত্রে আক্ষেপের সঙ্গে সাগর-রুনির হত্যা তদন্তের প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, খুনিদের ধরা তো দূরের কথা, তদন্ত পর্যন্ত শেষ করা গেল না। আর কত অপেক্ষা করতে হবে তদন্ত প্রতিবেদনের? দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। একটি হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম দায়িত্বশীলদের ধারাবাহিক ব্যর্থতায় আর কত প্রলম্বিত হবে? হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে।’ ১১ বছর কাটল, তবু ৪৮ ঘণ্টা শেষ হলো না! এর দুই দিন পর তৎকালীন আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারও বলেছিলেন, ‘তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে।’ এসবই কথার কথা হয়েই রইল। দিন যায় কথা থাকে, তবুও কাজ শেষ হয় না! আমরা সরকারের দায়িত্বশীলদের তরফে অহরহ শুনি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। হ্যাঁ, অবশ্যই আইন একটি গতিশীল বিষয়, তার নিজস্ব গতি আছে এবং সেই গতিতেই চলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমাদের সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এই চলা যেন এমন চলাই হয়ে দাঁড়াল, একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ পেছাতে পেছাতে সেঞ্চুরি হয়ে গেল! এরপরও আইনের নিজস্ব গতিতে চলার কোনো ফল মিলল না! মামলাটির তদন্ত শুরু করেছিল শেরে বাংলা নগর থানা পুলিশ। চার দিন যেতে না যেতেই এর তদন্তভার বর্তায় ডিবি পুলিশের ওপর। ৬২ দিন তদন্ত করার পর ডিবি পুলিশের তরফে হাইকোর্টে জানানো হলো, এর রহস্য উদঘাটন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর মামলার তদন্তের ভার বর্তাল র‍্যাবের ওপর। সেই থেকে দফায় দফায় পেছাতে পেছাতে একশোবারে দাড়িয়েছে।

সাগর-রুনি কোনো অজ্ঞাত স্থানে খুন হননি। তারা তাদের নিজস্ব ফ্ল্যাটে খুন হয়েছিলেন। আমরা জানি, ঢাকা মহানগরীর অধিকাংশ অ্যাপার্টমেন্টেই নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। বিশ্বাস করি, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোতে চৌকস, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা তাদের দক্ষতা-সক্ষমতা-পারদর্শিতার প্রতিফলন ঘটিয়ে অনেক বিভিষীকাময় ঘটনার পরও জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দাঁড়ায়, সাগর-রুনির খুনের রহস্য উন্মোচন করতে ধারাবাহিকভাবে তাদের তরফে ব্যর্থতার খতিয়ান দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে কেন। আজকের ১৬ বছরের কিশোর মেঘকে তার বাবা-মার লাশের পাশ থেকে সজ্ঞান অবস্থায়ই সেদিন উদ্ধার করা হয়েছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাঁচ বছরের একটি শিশুর বিশেষ করে যারা মহানগর-নগর কিংবা শহরে বাস করে, তাদের ওই বয়সেই বেশ কিছু বিষয় আত্মস্থ করার মতো শক্তি সঞ্চিত হয়। মেঘ ওই বয়সেই বীভৎস ঘটনার যে দুঃসহ স্মৃতি ধারণ করেছিল, এর ছায়ামুক্ত আজও সে হতে পারেনি নিশ্চয় এবং হওয়ার কথাও নয়।

একটি তদন্ত কার্যক্রমের এই যে পৌনঃপুনিক পশ্চাৎগামিতা তা আইন কিংবা আইনের দর্শনের কোনো স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে না। আইন কিংবা বিচার কার্যক্রম নিয়ে আমরা অনেক ভাববাদী কথাই শুনি। এই ভাববাদী কথাগুলো আমাদের আহত তো করেই পাশাপাশি জিজ্ঞাসু করে তোলেÑ নিরাপত্তাহীনতার ছায়া কি প্রলম্বিত হতেই থাকবে? আমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে শ্রেণিবিভাজনের বিপক্ষে। একটি রাষ্ট্রের সব নাগরিকের অধিকারের মাঠ অবশ্যই সমতল থাকা উচিত। কিন্তু এরপরও বলতে হয়, সাংবাদিকরা এ দেশে ক্রমেই অশুভ শক্তির অন্যতম টার্গেটে পরিণত হয়ে চলেছেন। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর তো বটেই সর্বসাম্প্রতিক জামালপুরের বকশীগঞ্জে দুর্বৃত্তদের বর্বরোচিত হামলায় বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি গোলাম রাব্বানি নাদিমের নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে ফের প্রমাণিত হলো সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ করার জন্য অশুভ শক্তি কতটা মরিয়া। মনে পড়ছে, ইউনেস্কোর প্রথম নারী মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভার একটি মন্তব্য। তিনি বলেছিলেন, ‘সব হত্যাই বেদনাদায়ক, কিন্তু যখন কোনো সাংবাদিককে রোষানলে পড়ে প্রাণ হারাতে হয়, তখন জনগণ তার পক্ষে কথা বলার একটি কণ্ঠস্বর হারায়।’ একজন সাংবাদিকের এমনভাবে প্রাণহানি যে জনগণের কণ্ঠস্বর রোধ করে দেয় সেই গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি ইরিনা বোকোভার মতো আমাদের দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের উপলব্ধিতে কবে গুরুত্ব পাবে? এ যেন এক অন্তহীন প্রশ্ন।

বিলম্বিত বিচার ন্যায়বিচারকে পরাহত করে, এ কথা আমরা শুনে আসছি। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারাবাহিক ব্যর্থতা এবং উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ন্যায়বিচার পাওয়ার আশাকে দুরাশার দিকে যেমন ঠেলে দিচ্ছে তেমনি সমাজের অশুভ শক্তিকেও আসকারা দিচ্ছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়দায়িত্ব যাদের তাদের ব্যর্থতায় সমাজ হয়ে ওঠে অপরাধীদের চারণভূমিÑ এটাই সত্য। অপরাধীদের চারণভূমিতে মানুষের বসবাস তো দুরূহ। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা